অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বাড়লেও আয়ে ভাটা

দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি বাড়ছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ের প্রবাহ কমে গেছে, আবার আসছেও দেরিতে। আগে যে আয় ৪০-৫০ দিনে দেশে চলে আসত, তা এখন আসছে নির্ধারিত সময়ের (১২০ দিন) শেষ দিকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস—জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এতে চলমান ডলার-সংকট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

সম্প্রতি শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৈঠক করেন। তখন ব্যাংকগুলোকে দেশে নিয়মিত ভিত্তিতে রপ্তানি আয় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মাস গেলেই রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা বাড়ছে। সামনে ডলারের দাম আরও বাড়বে, এমনটাই আশা করেন রপ্তানিকারকেরা। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও অনেকে বাইরে আয় রেখে দিচ্ছেন। এসব কারণে রপ্তানি আয় আসা কমে গেছে। সে জন্য ডলার-সংকটও কাটছে না।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রত্যাবাসিত আয় দেশে আনার জন্য গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। দেশে আনা হয়নি, এমন আয়ের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

তিন মাসের চিত্র

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশে এসেছে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয়। এই রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের চেয়ে ৩০০ কোটি ডলার কম।

সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার, গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ২৪৯ কোটি ডলার। এই তিন মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ।

যে মাসে রপ্তানি হয়, সেই মাসে আয় চলে আসে, বিষয়টি এমন নয়। তবে রপ্তানি আয় আসার ধারাবাহিক যে চিত্র রয়েছে, ডলার-সংকটের সময় তাতেই ছেদ পড়েছে। ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ কমে গেছে।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানির তথ্য যদি সত্য হয়, সেই আয় আসবেই। রপ্তানির যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেই পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে কি না, সেটা আগে নিশ্চিত করা জরুরি। তা ছাড়া ক্রেতারাও সময়মতো আয় পাঠাচ্ছেন না। ১০-২০ জন দুষ্ট ব্যবসায়ী যে নেই, তা বলা যাবে না। এই কারণে আয় আসা কমেছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সেই তালিকা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। পেলে আমরাও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’

রপ্তানি ও আয় দুটিই কমছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি ব্যবসা করে, এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০টির একটি প্রিমিয়ার ব্যাংক। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রায় ৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৬৫ কোটি ডলার। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে রপ্তানি আয় আসাও কমেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ৪৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় নগদায়ন করেছে ব্যাংকটি, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৮ কোটি ডলার।

একই অবস্থা রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংক ইউসিবিও। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির মাধ্যমে ৭২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯২ কোটি ডলার। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে রপ্তানি আয় আসাও কমেছে। ইসলামী ব্যাংকসহ বেশির ভাগ ব্যাংকেই এমন অবস্থা চলছে। ফলে সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় আসা কমেছে। যদিও সরকারি হিসাবে বাড়ছে রপ্তানি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি আয় কেন আগের মতো আসছে না, তা বোধগম্য নয়। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছে। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে রপ্তানি আয়ের প্রবাহ ধরে রাখা জরুরি।

নেপথ্যে কি ডলারের দাম

ডলারের দাম কত হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখন নিচ্ছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সংগঠন দুটি মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। গত জুন মাসে রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা, যা বেড়ে এখন ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। ফলে গত জুন মাসে যাঁরা রপ্তানি করেছেন, তাঁরা এখন প্রতি ডলারে তিন টাকা বেশি পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে রপ্তানি হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে আয় দেশে আনতে হয়। না হলে নতুন করে ওই রপ্তানিকারকের ঋণপত্র (এলসি) খুলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এখন প্রতি মাসে ডলারের দামের পরিবর্তন হচ্ছে। কোনো কোনো মাসে ডলারের দাম একাধিকবারও বাড়ানো হয়েছে। ফলে ডলারের দাম আরও বাড়বে, এমন আশায় অনেকে আয় আপাতত বিদেশে রাখছেন। ডলারের দাম আরও বাড়লে রপ্তানি আয় দেশে আনবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষ পর্যায়ের রপ্তানিকারক বলেন, ‘১০-১৫ দিন পর আয় আনার ফলে প্রতি ডলারে ৫ টাকা  বেশি পাচ্ছি। এই সুযোগ নিতে কে চাইবে না। নির্ধারিত ১২০ দিন সময়ের মধ্যে আয় আনলেই হলো। আগে ৪০-৫০ দিনে আনতাম, এখন শেষ দিন আনি।’

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি আয় আসতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো পরিকল্পনা করেই বিলম্বে আয় আনছেন। ডলারের দাম স্থিতিশিল হলে আয় আগের মতো আসবে। কারণ, তখন বাড়তি মুনাফা করার বিষয়টি থাকবে না।

ফেরেনি ১০০ কোটি ডলার

এদিকে সময় চলে গেলেও রপ্তানি আয়ের একটা অংশ দেশে ফেরত আসছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছর ধরে বিদেশে আটকে আছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। অপ্রত্যাবাসিত এই আয় দেশে ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, সে ব্যাপারে অর্থনীতিবিদেরা সন্দিহান।

গত ২ অক্টোবর ব্যাংকগুলোকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ রপ্তানি মূল্য ৩১ অক্টোবরের মধ্যে দেশে আনতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূল্য প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে, এই বিধিতে মামলা করার ব্যবস্থা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য রপ্তানি হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে অর্থ দেশে আনতে হয়।

দেশে যে ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় আনা হয়নি, তার মধ্যে জালিয়াতি, ভুয়া রপ্তানি, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাওয়া-সম্পর্কিত রপ্তানি আয়ও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ভুয়া রপ্তানি বিলও এর মধ্যে রয়েছে। করোনার সময় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, এমন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছেও অর্থ আটকা পড়েছে। এ নিয়ে বিদেশে মামলা চলছে। ফলে এসব আয় আনতে সময় লাগবে। তবে এখনো প্রত্যাবাসন হয়নি, এমন অর্ধেকের বেশি আয় দ্রুত দেশে ফেরানো যেতে পারে।