অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও উৎকণ্ঠা

  • এম এ মাসুম
  •  ২৫ জুলাই ২০২২, ২০:১০

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও উৎকণ্ঠা – ফাইল ছবি

দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য করোনা মহামারী (কোভিড-১৯) ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মানুষের আয় কমেছে, অনেক মানুষ বেকার হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০১৭ সালে দেশের ২২ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। করোনা মহামারীর কারণে সেটি বেড়েছে। কোনো সমীক্ষায় ৪২ শতাংশ আবার কেউ কেউ বলেছে ৪৫ শতাংশ। তার মানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার আগে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, করোনার মধ্যে তাদের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছিল।

করোনা যখনই কমে আসছিল, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে তখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে আবারো সঙ্কটের মধ্যে পতিত করে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য মূল্যস্ফীতি হয়তো বিরক্তিকর বিষয়, কিন্তু গ্রাম ও শহর এলাকায় দরিদ্র মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি জীবিকার সঙ্কট সৃষ্টি করছে।

মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করা মানেই দুঃসংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জুন মাসে তা আরো বাড়ল। দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরে এই জুন মাসের মতো এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি।

কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বাজারে। সব ধরনের পণ্যেরই দাম বাড়তি আছে। এর ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয় ধনি-গরিব নির্বিশেষে গড় হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরিব মানুষের ওপর প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের মতো আছে। মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের আয় না বাড়লে প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পরও দেশে ডলারের সঙ্কট কাটছে না। অনেক ব্যাংক এখন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০২ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। আর কোনো কোনো ব্যাংক ডলারপ্রতি ১০১ টাকা দিয়েও প্রবাসী আয় পাচ্ছে না। ফলে সঙ্কট কমার পরিবর্তে যেন আরো বেড়েই চলেছে।

ডলার-সঙ্কট নিরসনে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলো হলো ব্যাংকের ডলার ধারনের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রফতানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর। এ ছাড়া ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে বিলাস দ্রব্যে আমদানিতে শতভাগ মার্জিনসহ ব্যাংক ঋণে নিরুৎসাহিত করা হয়।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স হ্রাসের কারণে গত কয়েক মাস ধরে চাপে রয়েছে রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। কিন্তু দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। আবার রিজার্ভ হিসাবায়নেও আইএমএফ আপত্তি জানিয়ে আসছে। জানা যায়, বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে চার কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এটা রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।

দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। আবার রফতানি বাড়লেও তা আমদানির মতো নয়। প্রবাসী আয়ও বাড়েনি, বরং তা কমেছে। ফলে দেশে ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এতে বেড়ে গেছে প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রাটির দাম। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের দাম ৯৪ টাকার মধ্যে থাকলেও প্রবাসী আয় ও পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

পণ্য আমদানি কমলেও গেল অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়ে রেকর্ড হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রতিফলন হয়েছে আমদানি ব্যয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমদানি ব্যয় কখনো এত বেশি হয়নি। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো গেল অর্থবছরে পুরোটা সময় ধরে বৈশ্বিক বাজারে পণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি।

দেশের অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, তার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন ১৫ মাস আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কয়েক দিনের টানা দরপতনের কারণে বাজারে লেনদেনের এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দিনের টানা পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক ভর করেছে। আবার ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশের পোর্টফোলিওর শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়েছে। একদিকে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে, অন্য দিকে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে বেড়েছে বিক্রির চাপ। দুই মিলে বাজার ছিল নিম্নমুখী।

জ্বালানি খাতে লোকসান কমাতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ১৭ জুলাই থেকেই বন্ধ রাখা হয়েছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। সেই সাথে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হছেয়ে। ইতোমধ্যেই রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। সেই সাথে বিশ্বে জ্বালানি তেল এবং তরলিকৃত গ্যাস বা এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার এর আমদানি কমিয়েছে। এর ফলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত এবং ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খেলাপি ঋণের পাহাড় ক্রমেই বৃহৎ হচ্ছে। ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে মহামারী করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সঙ্কট মোকাবেলায় ঋণের কিস্তি না দিয়েই খেলাপি নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। ২০২০ সালে খেলাপি বা মন্দ ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। কিন্তু ২০২১ সালের তা বেড়ে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকায় ঠেকে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২২ সাল) মার্চ মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

এ দিকে ব্যয় সঙ্কোচন নীতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ে সরকারি সব দফতরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের জন্য পরিপত্র জারি করাসহ আট দফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করতে হবে। অধিকাংশ সভা অনলাইনে করতে হবে। অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোটের মাধ্যমে মজুদদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ অন্যান্য পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে।

এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী পরিবহনে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার যৌক্তিককরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। আর অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়াতে অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজস্ব ক্রয় পরিকল্পনা পুনঃপর্যালোচনা করে রাজস্ব ব্যয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে অফিসের গাড়ি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। সকাল ৯টায় অফিসের কার্যক্রম শুরু করে বিকেল ৫টার মধ্যেই অফিস ত্যাগ করতে হবে। এ দিকে গরমের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের স্যুট পরে অফিস না করার পরামর্শ দিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতি স্থিতিশীলতার জন্য দু’টি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া। মূল্যস্ফীতি বেশি হলে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে একে সংযত রাখার জন্য দৃষ্টি দিতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে বহির্খাত

(আমদানি-রফতানি)। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের মধ্যে ডলারের দামের পার্থক্য বেশি, এটি কমিয়ে আনতে হবে। না হলে অবৈধপথে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের শক্তিশালী উৎস রেমিট্যান্স। অনেক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। কিন্তু বৈধপথে সে তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে না। সেই সাথে দুর্নীতি ও পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেল : ma_masum@yahoo.com