অর্থনীতিতে মন্থরতা কাটিয়ে গতি ফিরছে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর (২ মে ২০০৪-৩০ এপ্রিল ২০০৯)। অর্থ ও বাণিজ্য খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এবং কোন কোন দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনা রয়েছে সে বিষয়ে কথা বলেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই মাস পেরিয়েছে। এর মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো এবং আপনি এর গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা রয়েছে। স্থিতিশীলতা আনতে আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

প্রথমত, গত দুই মাসে অর্থনীতি কিছুটা মন্থর ছিল, স্থবির নয়। কয়েক মাস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এরই মধ্যে কৃষিতে গতি সঞ্চার হয়েছে, ছোট-বড় শিল্প-কারখানা চালু হয়েছে। অর্থনীতিকে পুরোপুরি উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সামনে মূলত দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথম থেকেই আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ব্যাংক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যেমন মন্থর হয়ে আসা শিল্পগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে।

ব্যাংক খাতে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। যেসব ব্যাংকে সমস্যা ছিল সেগুলোর সমাধান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ওপরও জনগণের আস্থা ফিরে আসছে। বিদেশী ব্যাংকগুলোও দেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রশাসনিক সংস্কার করে কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হচ্ছে। কর প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে অনলাইনে কর প্রদানের সুবিধা চালু হওয়ায় অনেকেই অনলাইনে কর দিচ্ছেন। সম্প্রতি শ্রমিক আন্দোলনের ফলে তৈরি পোশাক সেক্টরের অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের দাবি মেনে নেয়া হয়েছে এবং বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসছে, বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলোর আস্থা ফিরে আসছে এবং তারা সহযোগিতা করতে আগ্রহী।

আমরা অর্থ পাচারের রিপোর্ট আগেও পেয়েছি, বর্তমানে আরো বিস্তারিত তথ্য জানতে পারছি। এ বিপুল পরিমাণ পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

অর্থ পাচার শনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে এনবিআর প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যাক্স ফাইল পর্যালোচনা করছে এবং তদন্ত করছে। যেসব বড় উদ্যোক্তার অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির সন্দেহ রয়েছে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে। তবে তাদের ব্যবসা চালু রাখা হয়েছে, যাতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে কোনো স্থবিরতা না আসে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে। এরই মধ্যে তারা ২১-২২টি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মতো জাতীয় ইস্যুতে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ বিষয়গুলো তদারকি করছেন এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে কাজ করছেন।

আগের অর্থনৈতিক স্থবিরতা অনেকটাই কমে গেছে। অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে চুক্তি আছে সে আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আগে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তেমন কাজ করেনি। প্রতিটি তদারকি সংস্থাকে সচল করায় অন্তত নতুন করে দুর্নীতির কথা কেউ চিন্তা করছে না। আমদানি-রফতানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার কমে এসেছে।

অলিগার্ক তোষণ আমাদের অর্থনীতির একটি বড় ক্ষত। বৃহৎ কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে বেশি ঋণখেলাপি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির বিকাশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আপনাদের ভাবনা কী?

সম্প্রতি ত্রিশের অধিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে। অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ খেলাপি হয়। ফলে আমাদের অর্থ ও ঋণ সাশ্রয় করতে হবে।

আমরা বারবার ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দটি উচ্চারণ করছি। কিন্তু অর্থায়ন না পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দাঁড়াতে পারবেন না। এটি কর্মসংস্থানের একটি বড় খাত। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে তাদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য বলেছি। কারণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপির ঘটনা খুবই কম। সাধারণত বড় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেই ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটে এবং এ ক্ষেত্রে টাকার অংকও বড় হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংককেও বলা হয়েছে প্রয়োজনে এসএমই ঋণগুলোকে রি-ফাইন্যান্স করতে।

এসএমই ফাউন্ডেশনকে আরো কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন এনজিও, মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট ও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশনকে অবশ্যই সংযোগ স্থাপন করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এখানে দায় রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকবার সুদের হার বাড়িয়েছে। অনেকে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে প্রশ্ন করছেন। মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অংকের কাছাকাছি। কবে নাগাদ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন বলে মনে করছেন?

মূল্যস্ফীতি গত মাসে ১ শতাংশ কমেছে। এটি অফিশিয়াল ফিগার এবং বাস্তব চিত্র। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য কমতে শুরু করেছে। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন ডিমের দাম বেড়েছে। যদিও ডিমের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। আমাদের চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি। সাম্প্রতিক বন্যার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমেছে, তবে তার ফলে সমগ্র দেশে ডিমের দাম বাড়া অযৌক্তিক। এখানে বাজারের সিন্ডিকেট ও মনোপলির প্রভাব রয়েছে। আমরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের অধীনে এর বিরুদ্ধে কাজ করছি। পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আরো সতর্ক হতে হবে।

অন্যদিকে সুদের হার কমানো হলে কেবল বড় উদ্যোক্তারাই লাভবান হন। এক্ষেত্রে ঋণ চাহিদায় ভারসাম্য আনাই মূল লক্ষ্য। বড় উদ্যোক্তারা প্রায়ই চাহিদার অতিরিক্ত ঋণ নেন, ফলে ভারসাম্য আনতে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদের হারের পরিবর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। সরবরাহকারীদের অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া যায় কিনা, সেটাও ভাবা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিছু লোক পণ্য আমদানি করে, আবার কিছু লোক মজুদ করে। আমরা জানি কারা করছে। বড় বড় আমদানিকারক ছাড়া পণ্য আমদানি করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমদানির পর যারা পণ্য বিতরণ করে বা সরবরাহ করে, তাদের কিছু অনৈতিক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আমদানি খরচ এবং বাজারে বিক্রয়মূল্যের মাঝে বিস্তর ব্যবধান থাকে। ভোক্তার সুবিধার্থে এসব গোষ্ঠীকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনা হবে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় আপনারা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর দৃশ্যমান প্রভাবও পড়েছে। তবে সাধারণ আমানতকারীরা নগদ অর্থ তোলার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ছেন। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট কাটানোর জন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নানাভাবে সাহায্যও করা হচ্ছে। তারল্য সংকট কবে নাগাদ কমতে পারে?

সামগ্রিকভাবে তারল্য সংকট নেই। শুধু যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে, যেমন কিছু ইসলামী ব্যাংক এবং পদ্মা ব্যাংক, সেগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এর মূল কারণ হলো এসব ব্যাংকের অতীত দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা। এ ব্যাংকগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়েছিল। তবে এমন ব্যাংকের সংখ্যা সীমিত। আমরা এ ধরনের ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করছি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বেশকিছু গ্রাহকের চেক ও পে-অর্ডার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনার করা হয়েছে। তবে এটি নিয়মিতভাবে করা সম্ভব নয়।

ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সংস্কারের মাধ্যমে দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন আনলে ব্যাংক খাতে স্বস্তি ফিরে আসবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের বড় অংকের টাকার জন্য চেক গ্রহণের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই অন্যান্য ব্যাংকের গ্রাহকদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগবে। কিছু ব্যাংক বেশি সমস্যায় রয়েছে এবং সেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও মূলধন বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা ব্যাংক খাতে তারল্য সহযোগিতা ও ব্যবস্থাপনা ভালো করার মাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

দেশে তীব্র বেকারত্ব রয়েছে। কর্মে সম-সুযোগের জন্যই আন্দোলনের সূত্রপাত। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকার কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

প্রথমত, তাৎক্ষণিকভাবে বেসরকারি খাতে যাতে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায় সেজন্য কাজ করছি। শুধু কর্মসংস্থান নয়, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এটি কীভাবে তরুণদের জন্য করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবছি। সিএসএমই, মূলধন ও সম-অংশীদারের বিষয় আছে—সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করছে, যাতে তরুণরা সৃজনশীল ও স্ব-উদ্যোগে কাজ করতে পারে। যারা এরই মধ্যে এসব কাজ করছে তাদের যাতে কোনোক্রমেই অর্থ সংস্থান কিংবা অন্য কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছি। দ্বিতীয়ত, অনেক শিক্ষিত তরুণ সরকারি চাকরির জন্য ক্যারিয়ার তৈরি করে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে সংস্কার করতে হবে, যাতে তরুণরা দ্রুত সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক শূন্য পদ আছে, সেখানে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজ করছে সরকার। তৃতীয়ত, মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে যাতে আমাদের দেশ থেকে আরো জনশক্তি নেয়। প্রধানমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন তারা বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেবেন। এছাড়া আবুধাবি, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। এরই মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীরা ইমিগ্রেশনে যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হন এবং বিদেশে যেতে বেশি অর্থ খরচ করতে না হয় তা নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের বাইরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের ভেতরেও কর্মসংস্থান বাড়াতে কাজ করছি।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ, এফডিআই ও বিদেশী কারখানা স্থাপনের আলোচনা কেমন এগিয়েছে?

দেশে অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বৈদেশিক বিনিয়োগ। বিনিয়োগ নিয়ে বিদেশীদের সঙ্গে যখন আলোচনা হয় তখন তারা বলেছে, দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। পরিবেশ বলতে তারা বোঝায় প্রণোদনা, ট্যাক্স, দ্রুত অনুমোদন পাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতিসাধন। সরকারি-বেসরকারি খাতের পরিবেশ উন্নয়নে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) বেসরকারি খাতবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছি। এখানে দক্ষ ব্যক্তি নিয়োগকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যাতে বেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে। আগে বিডা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করত, যেটা এখন পরিবর্তন হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেছি। আরেকটি বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি, সেটি ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট (এফপিআই)। কারণ বাংলাদেশে স্টক মার্কেটের বিকাশ এখনো সেভাবে হয়নি। আমরা ইদানীং এ মার্কেটে উন্নতির চেষ্টা করছি। আগে আমাদের পুঁজিবাজারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন না। আগে যে দুই প্রফেসর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তারা ও বাকিরা মিলে গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজার ধ্বংস করে দিয়েছে। বর্তমানে যিনি চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি একজন দক্ষ ব্যাংকার। যদিও অনেক উৎসাহী মানুষজন এখন বলছেন এ চেয়ারম্যান পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ নন, এটা করতে হবে-সেটা করতে হবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, তারা গত ১৫ বছরে তাহলে কী করলেন? তারা তো খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা। আমরা তাদের স্বার্থে কাজ করব যাতে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যায়। তাছাড়া এরই মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কারে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। পুরো পুঁজিবাজারটি ঠিক হলে আমাদের স্টক মার্কেট আরো বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবে বলে আশা রাখি।

সরবরাহ চেইন সংকট ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা কীভাবে দূর করা যাবে? এখনো সিন্ডিকেটের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।

সরবরাহ শৃঙ্খলের দুটি দিক আছে—এক. উৎপাদন ও দুই. বাজারজাত। আমাদের উৎপাদনে কমতি নেই। বিশেষ করে কৃষিজাত ভোগ্যপণ্য। তবে উৎপাদন ব্যাহত হলে দাম কিছুটা ওঠানামা করে। যেমন বন্যায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর কিছুটা সরবরাহ সংকটে হুট করে অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আবার কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ঢাকায় শাকসবজির দাম বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদনের পর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো বিপণন বা বাজারজাত। এক্ষেত্রে উৎপাদনস্থল থেকে বাজারে আসা পর্যন্ত যাদের হাতবদল হয়ে পণ্য মূল মার্কেটগুলোয় আসে, তারাই দামটি নির্ধারণ করে। এটিই হলো দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের অন্যতম সমস্যা। আমরা চেষ্টা করছি মনিটরিং বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেটটি ভাঙার। কিন্তু সমস্যা হলো যারা সড়কে চাঁদাবাজি করে তাদের আমরা রুখে দিতে পারি কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যেমন পাইকারি বিক্রেতা, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এটি কেবল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কিছু কর্তব্য রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এ বিষয়ে নৈতিক অবস্থান নেয়া জরুরি। কারণ তারা জানে যে এসব সিন্ডিকেট করে কারা দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতাদেরও এ বিষয়ে সতর্ক করা জরুরি। এরই মধ্যে আমরা কয়েকটি চেম্বার অব কমার্সের ব্যক্তি ও মালিক সমিতির সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে সরবরাহ শৃঙ্খলে সংকট ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার বিষয়টি কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। প্রশাসনকে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

তাছাড়া সরবরাহ সংকট দূর করতে আমরা আমদানির বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছি। বিশেষ কিছু পণ্য আমদানি করা হবে। রোজার সময় যেমন প্রচুর পরিমাণে খেজুরের চাহিদা থাকে। সেই সময় খেজুর আমদানি করা হবে। এছাড়া নিত্য ভোগ্যপণ্য চাল-ডাল-তেল ইত্যাদির জোগান যেন না কমে সেদিকে নজর রাখা হবে। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনের জন্য সার, কীটনাশকের সরবরাহ যাতে না কমে সেটিও খেয়াল রাখা হবে। একই সঙ্গে জ্বালানি তথা এলএনজি সংকট যেন না হয় সেটিও দেখব আমরা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, কৃষক, ব্যবসায়ী ‍তিন শ্রেণীর মানুষের কারোরই যাতে অসুবিধা না হয় সেটিকে আমরা অগ্রাধিকার দেব। এতে আশা করি নিকট ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতিও অনেক কমে আসবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে সংস্কার ঘিরে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে এ দুই মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘমেয়াদি কী সংস্কার দেখতে চান?

অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার হিসেবে দেশের ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণ যেন ডিজিটালাইজ হয়, দুর্নীতি কমে এ সংস্কারগুলো দেখতে চাই। বাণিজ্য ক্ষেত্রে শুল্ক ও প্রণোদনার যৌক্তিকীকরণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রক্রিয়া আরো সহজীকরণ এসব করতে দেখতে চাই। এছাড়া এই প্রথম বাণিজ্যে সেবা খাত যুক্ত হয়েছে। এর পূর্ণ সুবিধা যাতে মানুষ পায় সেটি নিশ্চিত করা হবে। জ্বালানি ক্ষেত্রে প্রণোদনা কীভাবে কমানো যায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো যায় তা নিয়েও কাজ করা হবে। বিদ্যমান সব প্রকল্প পর্যালোচনা করা হবে। আর অন্যদিকে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। সব মিলিয়ে আমরা কিছু তাৎক্ষণিক, কিছু মধ্যমেয়াদি আর কিছু দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য কাজ করব। সর্বোপরি সরকারের অর্থ, ঋণের অর্থ কোনোভাবেই যেন অপচয় না হয় সেদিকে নজর রাখা হবে।

Bonik Barta