অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষে ভূমিকা রাখেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা

বাংলাদেশের সর্বশেষ গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়ে ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লেখেন ছয় মার্কিন জনপ্রতিনিধি। চিঠিতে তারা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন। তারা লেখেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অসম্মানজনক কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া।’

অভ্যুত্থানের আগের দিন (৪ আগস্ট) অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষে মহাখালী ডিওএইচএসে রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ইকবাল করিম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত এ রাজনৈতিক সংকটকালে আমরা ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি রাজপথ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। অনুরোধ করে বলছি, এ সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না।’

লিখিত বক্তব্যে সাবেক সেনাপ্রধান আরো বলেন, ‘আক্রমণকারীরা গণ-অভ্যুত্থানে পিছপা হতে বাধ্য হলে পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবহার করা হলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে। তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কখনো সম্মুখভাগে, কখনো পেছনে ও পাশে দাঁড় করিয়ে অন্য বাহিনীগুলো এ গণ-আন্দোলনের ওপর তাদের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতির দায় দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর নেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অতীতে কখনো দেশবাসী বা সাধারণ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি, তাদের বুকে বন্দুক তাক করেনি।’

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের এ ভূমিকা প্রসঙ্গে মেজর (অব.) মঞ্জুর কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। চাকরিরত সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানানোর ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। এর মধ্য দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা এ অভ্যুত্থানের এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের এ ভূমিকা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনয়নের পক্ষে।’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মেজর (অব.) মঞ্জুর কাদের আরো বলেন, ‘তাদের আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের হিসাবনিকাশ পাল্টে যায়। কেননা সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর পর কর্তৃত্ববাদী সরকার মনে করেছিল, তারা আন্দোলন দমন করে সরকারের পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু তাদের আহ্বানের পর পরই কর্মরত সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সামনে সরাসরি মুখোমুখি হতে অস্বীকার জানায়। অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।’

৪ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের সেনাবাহিনী তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সেনাসদস্যদের আমি বলব, আন্দোলনকারীরা আপনাদেরই সন্তান। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা। আসুন আমরা আমাদের দেশটা রক্ষা করি।’

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক সেনাপ্রধান এম নুরুদ্দিন খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর পাশাপাশি আজ যে ক্ষয়ক্ষতি, দুর্দশা ও রক্তপাত হয়েছে, তা মর্মান্তিক। আমি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে তাদের মাগফিরাত কামনা করছি। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল (৩ আগস্ট) যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে আমি আশ্বস্ত হয়েছি। আশা করছি, তিনি সে সিদ্ধান্ত বলবৎ রাখবেন এবং আমাদের দেশে আর রক্তপাত হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘একবার ডিএমও (ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস) থাকাকালে ক্যু হয়। আমি নিজে ১৭টি ক্যু হ্যান্ডেল করেছি। প্রতিটি অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল আমাদের সহকর্মীদের সহযোগিতায়।’

এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য আমরা জাতিসংঘের মিশনগুলোয় গিয়ে থাকি। আর এখানে নিজ দেশে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হবে! এটা হতে পারে না। একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনে ১০০ সৈনিক মারা যাবে।’

ছাত্র-জনতার পক্ষ নেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষায় ন্যূনতম বল প্রয়োগ, যেমন লাঠি দিয়ে আঘাত করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারত। এরা তো সবাই সাধারণ শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় আমরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ হোক, সেটি আমরা চাইনি।’

শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিনও (৫ আগস্ট) মাঠে ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। সেদিন রাওয়া ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ান তারা।

ছাত্র-জনতার পক্ষ নেয়া কমডোর মকসুমুল কাদের (অব.) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে শিক্ষার্থী ও জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো ঠিক নয়। সেজন্য আমরা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিই—কোনো ক্রমেই দায়িত্বরত সামরিক কর্মকর্তাদের যেন জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো না হয়। পাশাপাশি তারা যেন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, আমাদের সেই আহ্বানে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর উনারা গুলি করা বন্ধ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনটি বাহিনীতে যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদের মোবারকবাদ জানাই; আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটেছে।’

Bnik Barta