অবিনাশী আফগানিস্তান, অবিনাশী পর্বতমালা

  • হামিদ মীর
  •  ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪৬
লেখক : হামিদ মীর – ফাইল ছবি

ইসলামাবাদে জারি করা হাই-অ্যালার্ট কেন্দ্রীয় রাজধানীতে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ার থেকে আগত গাড়িগুলোর তল্লাশি করা হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিদিন অসংখ্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করছে এবং নামসর্বস্ব তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত উগ্রবাদীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছু দিন আগে ইসলামাবাদ পুলিশের ওপর আত্মঘাতী হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত হয়েছে।

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২-এর আত্মঘাতী হামলায় ২২ বছর বয়সী সাকিবুদ্দিন জড়িত ছিল। তার বাড়ি কুরমে। সে কারাক থেকে মরদান আসে। ওখানেই রাত কাটায়। এরপর সওয়াবি থেকে এক মদদদাতার সাথে যাত্রীবাহী বাসে রাওয়ালপিন্ডি আসে। রাওয়ালপিন্ডিতে অপর এক মদদদাতা তাকে বারুদে পূর্ণ একটি জ্যাকেট প্রদান করে। সে রাওয়ালপিন্ডি থেকে কয়েকটি ফোনও করে। ওই ফোনকলের ঠিকানাও পাওয়া গেছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ট্যাক্সিতে বসে সে ইসলামাবাদের রেড জোনের দিকে রওনা হয়। কিন্তু পথে পুলিশ থামিয়ে দেয়। ওই সময় সে আত্মঘাতী হামলা করে বসে। মারগালা পর্বতমালা থেকে ইসলামাবাদের পার্লামেন্ট হাউজের ভিডিও বানিয়ে হুমকি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টকারী ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সূত্র মোতাবেক ওই ব্যক্তির সাথে টিটিপির সম্পর্ক রয়েছে।

টিটিপি ২৯ নভেম্বর, ২০২২ সেনা নেতৃত্বে পরিবর্তনের পরের দিন কোয়েটায় এক আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করে এ বার্তা দেয় যে, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ শুরু করেছে। ইমরান খানের শাসনামলে টিটিপি তাদের কিছু বন্দী সঙ্গীদের মুক্তির বিনিময়ে অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইমরান খানের সরকার বিদায় নেয়ার পর এ অস্ত্রবিরতি বাতিল করে দেয়া হয়। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, টিটিপির সাথে আর আলোচনা করা হবে না।’ এটা আর গোপন থাকে না যে, খায়বারপাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে টিটিপির বৃদ্ধি পাওয়া হামলার পর একটি বড় ধরনের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আর এ জন্যই প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, পাকিস্তানে হামলাকারীদের আশ্রয়স্থল হচ্ছে আফগানিস্তানে। এ বক্তব্য থেকে এ কথা ধরে নেয়া হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে টিটিপির আশ্রয়স্থলে হামলা করা হতে পারে। ইমরান খানের শাসনামলে সীমান্তপারে টিটিপির আশ্রয়স্থলে বিমান হামলা করা হয়েছে। এ জন্য আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের দায়িত্বশীলরা খাজা আসিফের বক্তব্যের শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না যে, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের কাবুল দখলের পর পাকিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দীর্ঘ দিন পর পাক-আফগান সীমান্তের বেসামরিক মানুষ একে অন্যের বোমাবর্ষণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ও তালেবান নেতাদেরকে যে সূক্ষ্ম দূরদর্শিতা ও কার্যকৌশল প্রকাশের প্রয়োজন ছিল, তা নজরে পড়ল না। ইমরান খান তো আগেভাগেই খায়বারপাখতুনখাওয়াতে শান্তি-নিরাপত্তার বিঘ্নিত পরিস্থিতির দায়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ইমরান খানের ওপর আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাস আমদানির অভিযোগ আরোপ করেন।

তালেবানের কিছু মন্ত্রী ও অন্যতম তালেবান কমান্ডার জেনারেল মুবীন খানের বক্তব্য থেকে আরো ভুল বোঝাবুঝি ছড়িয়ে পড়ে। উভয় দেশের দায়িত্বশীলদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা ও শক্তি চিরদিন থাকে না। এটা আসা-যাওয়া করে। ক্ষমতা ও শক্তিকে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করবেন না। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান গঠিত হলো, তখন জাতিসঙ্ঘে আফগানিস্তান প্রতিনিধি পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, তাকে দুর্বল করা যায়নি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শাসকদের মাঝে দ্বন্দ্বের ইতিহাস মাত্র ৭৫ বছরের পুরনো। কিন্তু উভয় দেশের জনগণের মাঝে ভালোবাসার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। এখনো লাহোরে হজরত আলী হাজবেরী রাহ. (দাতা গঞ্জবখশ)-এর ওরস হয়। ওই সময় মানুষ ওরসে শরিক হওয়ার জন্য আফগানিস্তানের গজনি শহর থেকে পাকিস্তান আসেন। কেননা এই দরবেশ গজনির হাজবের মহল্লা থেকে লাহোর আসেন এবং এ জন্যই তাকে হাজবেরী বলা হয়।

আফগানিস্তান থেকে আগত সুফিগণ আমাদের অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। আফগানিস্তানের বলখ শহরে জন্মগ্রহণকারী মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি আমাদের প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবালের আধ্যাত্মিক মুরশিদ ছিলেন। ইকবাল তার কাব্যে আফগানিস্তানকে এশিয়ার হৃৎপিণ্ড অভিহিত করেছেন। ইকবাল বলেছেন, আফগান বাকি, কোহসার বাকি/ আলহুকমু লিল্লাহ, আলমুলকু লিল্লাহ।- আফগান অবিনাশী, পর্বতমালা অবিনাশী। হুকুম আল্লাহর, রাজত্ব আল্লাহর। যত দিন পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন পাকিস্তানিদের অন্তর থেকে আফগানদের সম্মান ও ভালোবাসা মুছে ফেলা যাবে না। উভয় দেশের জনগণের মাঝে নানা ধরনের ভুল বোঝাবুঝি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। উভয় দেশের সম্মিলিত শত্রুরা চায়, আমরা যেন পরস্পর লড়াই করি। এ জন্য উভয়পক্ষের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সতর্কতার সাথে পা ফেলা উচিত। কঠিন সময়ে আমরা যদি একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েই থাকি, সেটা কারো ওপর আমাদের কোনো অনুগ্রহ ছিল না। সেটা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ছিল। আজ আফগানিস্তানে পাকিস্তানকে মন্দ বলা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান প্রশাসন শুধু পাকিস্তানের সমালোচনা করে, বাস্তবতার প্রতি খেয়াল করে না। সম্প্রতি তালেবান পুরো আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি সংস্থা ওআইসিও এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। ৫৭টি ইসলামী রাষ্ট্র এক দিকে আর তালেবান আরেক দিকে দাঁড়িয়ে আছে। পাকিস্তানের যে উলামা ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল বিজয়ে তালেবানকে মোবারকবাদ জানিয়েছিলেন, এখন তারাও তালেবানের কাছে অনুরোধ করছেন যে, নারীদের উচ্চ শিক্ষার দরোজা বন্ধ করা ইসলাম পরিপন্থী।

মুফতি তকি উসমানী সাহেব ও মাওলানা জাহেদ আর-রাশেদীসহ কয়েকজন পাকিস্তানি আলেমকে আফগান তালেবানের শিক্ষকদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তারা যদি কোনো সিদ্ধান্তকে নিরীক্ষণের জন্য চাপ দেন, তাহলে তাদের অভিমত উপেক্ষা করা হবে না। অনুরূপ বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সাহেবও যেন এ কথা ভুলে না যান যে, আফগান বিদ্রোহীদের পাকিস্তানে আশ্রয় দেয়ার ধারা শুরু হয়েছে তার নানা জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে, যে সময় বুরহানুদ্দিন রাব্বানি, আহমদ শাহ মাসউদ ও গুলবদ্দিন হেকমতিয়ারকে আইজিএফসি নাসিরুল্লাহ বাবরের অনুগ্রহ ও সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছিল।

পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না, তবে পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতাকেও সামনে রাখতে হবে। আপনারা পারমাণবিক শক্তির অধিকারী অবশ্যই, তবে অন্যদের হুমকি দেয়ার আগে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ঐকমত্য তো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যদি কঠিন হয়, তাহলে বড় বড় বুলি আওড়ানো বন্ধ করুন। কেননা এই সব বক্তব্যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা আপনাদের আরো দুবর্লতাকে উন্মোচন করে দেবে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৫ জানুয়ারি, ২০২৩ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট