- গাজীউল হাসান খান

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিস্তাপারের পাঁচটি জেলার উপদ্রুত মানুষ এ অঞ্চলের ১১টি পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিল। আন্দোলনকারীরা বলেছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বৃহত্তর রংপুর এলাকার পাঁচটি জেলায় বিএনপির নেতৃত্বে গৃহীত কর্মসূচি পালন উপলক্ষে দলনেতা তারেক রহমান বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যে অভিন্ন ৫৪টি নদী, তার ন্যায্য হিস্যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য। অথচ তিস্তার পানির জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আন্দোলন করতে হচ্ছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কিংবা এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু এগিয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা ওয়াকিফহাল নন।
বাংলাদেশ তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে বিগত ৫০ বছর অপেক্ষা করেছে, যা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সে উল্লেখযোগ্য সময়টিতেও প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের দিক থেকে দেখা গেছে বিভিন্ন স্বার্থপরতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন অজুহাত ও গড়িমসি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-পরবর্তী অবস্থায় বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ সেসব ব্যাপারে আর অহেতুক সময়ক্ষেপণ করতে রাজি নয়। এ ক্ষেত্রে কারো আর কোনো অজুহাত কিংবা স্বার্থপরতা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের বর্ষায় প্রবল বন্যা, তিস্তাপারের মানুষের সহায়-সম্বল সব কিছু নিয়ে ভেসে যাওয়া এবং নদীভাঙনের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া আর কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। চলতে দেওয়া যায় না শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি বা পানি সেচের অভাবে এক সর্বনাশা মরুকরণ, যাতে কোনো ফসল বা রবিশস্য ফলানো সম্ভব হয় না।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময়ে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেননি। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। শেখ হাসিনা তিস্তা ইস্যুতে কখনো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়েছেন নতুবা গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়েছেন। এতে তাঁর সমূহ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিংবা রাজনৈতিক দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। চীনের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্পের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে বারবার হোঁচট খেয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতের মোদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য শেখ হাসিনা ভারতের কূটচালে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। এতে তিনি দিশা হারিয়েছেন তাঁর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের বাস্তবভিত্তিক কোনো অগ্রগতি বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। ভারত প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে চীনের কোনো প্রকৌশলী ও কর্মীর কাজ করার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের আপত্তির মূল কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত। তারা বলেছে, চীনের প্রকৌশলী ও কর্মীরা এ প্রকল্পে কাজ করলে সেটি শিলিগুড়ি করিডরের (চিকেন নেক) নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এমন যুক্তি অতীতে আর কখনো শোনা যায়নি। ভারতের সে বাধার মুখে শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের নির্মাণকাজটি তাদের হাতে (ভারতের) ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। কিন্তু সে মুহূর্তেই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অনেক ওয়াকিফহাল নাগরিক। তাদের মতে, ভারত শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে না। ফলে তারা পরিকল্পিতভাবেই প্রকল্পের কাজটি সম্পূর্ণভাবে ঝুলিয়ে দেবে এবং শেষ পর্যন্ত মোটেও তা বাস্তবায়িত হবে কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দেবে। তা ছাড়া চীন যে প্রযুক্তিতে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের কাজটি বাস্তবায়িত করবে, সে প্রযুক্তি ভারতের কাছে আছে কি না, সেটিও জানা নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ প্রকল্পের পরিকল্পনাটি ভারত আবার নতুন করে তার সুবিধা অনুযায়ী প্রণয়ন করতে চাইবে বলে অনেকে ধারণা করে।
ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময় একটু বেশিই উদ্বিগ্ন থাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা বিভাগ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ লালমনিরহাটের পুরনো বিমানবন্দরটি সংস্কার করে বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ব্যবহার উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর গড়ে তোলার খবরেও তাই বাধা দিয়েছিল ভারত। তাদের ধারণা, এই বিমানবন্দরটি চালু হলে তা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা ছাড়া চট্টগ্রামের উপকূলে পেকুয়ায় বাংলাদেশের একটি সাবমেরিন ঘাঁটি গড়ে তোলার খবরেও বাধা দিয়েছে ভারত। অথচ শিলিগুড়ি করিডর এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ওপারে ভারত গড়ে তুলেছে এক বিরাট নিরাপত্তাব্যবস্থা। সেখানে ভারত চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ এবং এমনকি ‘চিকেন নেক’কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে ভারত স্থাপন করেছে বিভিন্ন রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্র। বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী হাসিমারাসহ আসামের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ক্ষমতার সেনাঘাঁটি। সেখানে ফ্রান্স থেকে কেনা ভারতের বহুমুখী জঙ্গিবিমান রাফায়েলের একটি বহর ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ তার সার্বভৌম সীমান্তের অতি নিকটবর্তী এলাকায় ভারতের সামরিক বা প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কখনো কোনো কথা বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারেনি। অথচ ভারত বাংলাদেশে যেকোনো সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার উদ্যোগের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। আর তা যদি হয় ভারত সীমান্তের কাছকাছি, তাহলে তো কথাই নেই। সেই একই কারণে তারা চীনের তত্ত্বাবধানে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এবং চীনকে নিয়ে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চীনকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে তারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন অজুহাতে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পেরেছে, তবে বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেগুলো আর আগের মতো মোটেও কাজ করবে বলে কেউ মনে করে না। কারণ বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা মনে করে, এখন তাঁবেদারির দিন শেষ। বাংলাদেশে সূচিত হয়েছে কারো কাছে মাথা নত না করার এক নতুন প্রত্যয়।
উপরোল্লিখিত এই সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার চায়নার তিস্তা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখিত বিভিন্ন শর্তে একমত হলে চীন সরকার প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে এগোতে পারে নতুবা নয়। বাংলাদেশ তাদের শর্তে রাজি হলে দুই দেশের মধ্যে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। তবে চুক্তির বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আরো আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এই প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যাপারে চীন সরকারের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। তবে বাকিটা নির্ভর করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ওপর। যদি এ ব্যাপারে আমরা একটি শক্তিশালী ঐকমত্যে পৌঁছতে পারি, তবে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে চীনের যথেষ্ট উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত বিনির্মাণ ও উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ চীনের বহু বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার পথ প্রশস্ত হতে পারে। সামরিক ও বেসামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের দ্বার অপ্রত্যাশিতভাবে উন্মোচিত হতে পারে। এতে চীন দিনে দিনে বাংলাদেশের আরো ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে অনেকের বিশ্বাস। তবে আমাদের জাতীয় স্বার্থে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্যের সুদৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। আমরা যেন তাতে ব্যর্থ না হই, সেটিই হচ্ছে একমাত্র প্রত্যাশা।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক