অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয় হলো- গ্রামীণ ব্যাংক

logo

 

ড. আমীর খসরু

৩১ আগস্ট ২০২৩

আমার পিএইচডি-তে গবেষণার বিষয় ছিল “সামাজিক ব্যবসা কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে”? গবেষণার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাকে গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রকাশিত অনেক জার্নাল থেকে গবেষণা পেপার পড়তে হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের উপর অসংখ্য গবেষণা রয়েছে এবং তথ্যমতে পৃথিবীতে ১০০-এর অধিক গবেষক রয়েছেন, যারা শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের উপর তাদের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাদের গবেষণা-পর্যালোচনার তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রিত করে, উভয়ের মধ্যে কোথাও সাদৃশ্য রয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করা হয়।‌ গ্রামীণ ব্যাংক কী এবং এর উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে না জেনে আমরা অনেকেই তাচ্ছিল্য ভাষায় সমালোচনা করে থাকি। তাই উভয় ব্যাংকের সেবার ধরণ এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে , আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির উপর নজর রাখি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন আধুনিক মাইক্রোক্রেডিট এবং সামাজিক ব্যবসার পথ নির্দেশক। বর্তমান সময়ে সামাজিক ব্যবসা কর্পোরেট জগতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সামাজিক ব্যবসার কার্যক্রমকে সাবলীলভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন: সামাজিক ব্যবসা টাইপ -১। অর্থাৎ এক বা একাধিক সামাজিক সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগকারী কোনো পণ্য বা সেবার মাধ্যমে উক্ত সমস্যার সমাধান করে থাকে। যেমন: গ্রামীণ ডানোন ফুডস লিঃ। এবং সামাজিক ব্যবসা টাইপ-২। অর্থাৎ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণে উদ্যোক্তা প্রোগ্রামের মাধ্যমে আর্থিক সেবা প্রদান করে। যেমন: গ্রামীণ ব্যাংক ।

এখন দেখা যাক, প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কীভাবে কাজ করে?

একটি দেশের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমোদন পেয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

এজাতীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে, ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী তার সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেয় ।

কীভাবে ব্যাংক টাকা তৈরি করে থাকে:

# ডিপোজিটর বা গ্রাহক তাদের আমানত নিশ্চয়তার লক্ষ্যে তার পছন্দের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। এভাবেই একটি ব্যাংকের যত বেশি গ্রাহক সংখ্যা থাকবে ততই ব্যাংক তার তারল্য অর্থ পেতে থাকবে। এভাবে জমাকৃত তারল্য অর্থ থেকে ব্যাংকের টাকা তৈরির উৎস হয়।

সেটা কীভাবে?

# ব্যাংক বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে তার গ্রাহকদের স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধার জন্য লোভনীয় সব অফার দেয়। কারণ তার কাছে গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা থাকে। এই টাকা থেকে কোনো ঋণ আবেদনকারীর আবেদন অনুমোদন হলে তাকে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় বা রিজার্ভ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের থেকে প্রদেয় ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ নিয়ে থাকে। আর, এভাবেই একটি ব্যাংক তার চলতি দায় এবং খরচ বাদ দিয়ে বছর শেষে একটি মুনাফা লাভ করে। অর্থাৎ কৈ মাছের তেল দিয়ে কৈ মাছ ভাজা। এবার আমরা দেখবো এই ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য:

বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন হয়ে থাকে?

# ঋণ গ্রহণকারী ঋণ পেতে হলে, তাকে তার দৃশ্যমান স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি যা ব্যাংকে বন্ধকী বা জামানত রাখতে হয়।

# এই ব্যাংকের সব ধরনের সেবা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে ব্যাংকে যেতে হয়।

# তাদের সেবা কেবল শুধু শহরকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।

# তারা শুধু সচ্ছল ও বিত্তবানদের জন্য ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে।

# তাদের প্রদানকৃত ঋণের অর্থ ঋণগ্রহীতা সঠিকভাবে ব্যবহার করে কিনা, তার কোনো তদারকি বা জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সুবিধাভোগী তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকে জামানত রেখেই অর্থ গ্রহণ করে। সুতরাং ঋণের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে, ব্যাংক তার সম্পত্তি বিক্রি করে তার প্রদানকৃত অর্থ সমন্বয় করে নেয়। এটা হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকিং সেবার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এখন দেখবো, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি সামাজিক কী ধরনের ভূমিকা (Social Impact) পালন করে থাকে:

– বাণিজ্যিকভাবে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।

– বিনিয়োগকারী তার সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের আশা করে থাকেন।

– বিনিয়োগকারী সবসময় ROI  রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের) উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি (focus) দিয়ে থাকে।

-ব্যাংকগুলো CSR (স্যোশাল কর্পোরেট রেসপনসিবিলিটি ) কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তবে, সেগুলো সাময়িক প্রণোদনামূলক কাজের অংশবিশেষ। এ ধরনের কাজের স্থায়ীত্বকাল নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য হয়ে থাকে, যা সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে না।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে সমাজের বিশাল অথচ অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী কী করবে বা তারা কি তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো ব্যাংকের সেবা বা আর্থিক সহযোগিতা পাবেন না?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে দেখা মিলবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সাজানো হয়েছে কেবলই শুধু ধনীদের আরো ধনী করার জন্য। এই অর্থনীতি সুবিধাবঞ্চিত বা গরীবের জন্য কোনো কাজ করে না। কেবলই, তারা ধনীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই দুরবস্থা থেকে বিশাল এই অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন “গ্রামীণ ব্যাংক”। যে ব্যাংকে কোনো দান বা অনুদানের অর্থের উপর নির্ভরশীল না হয়ে ড. ইউনূস তার নিজ পকেট থেকে মাত্র ৭০ ইউএসডি ডলার দিয়ে তিনি একটি পাইলট প্রকল্প যা চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ১৯৭৪ সালে শুরু করেন। আর সেই ছোট্ট গ্রাম জোবরা থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের উৎপত্তি যা বাংলাদেশ পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান সামাজিক উদ্দেশ্য হলো- দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ছোট্ট একটি ব্যবসার জন্য আর্থিক সহায়তা বা বিনিয়োগের পুঁজি প্রদান করা। এজন্য গ্রামীণ ব্যাংককে বলা হয় “গরীবের ব্যাংক” ( Bankers to the Poor) । গ্রামীণ ব্যাংক সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষ যারা বংশপরম্পরায় দারিদ্র্যতা থেকে কখনো মুক্তি পায়নি, তাদেরকে উদ্যোক্তা প্রোগ্রামের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করে চলেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেছিল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। এজন্য তিনি বলেন, একটি ব্যবসা একজন মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে। কারণ, তার ছোট্ট একটি ব্যবসায়ের মাধ্যমে তার নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে এবং এভাবে একটা সময়ে সে তার দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে। এজন্য গ্রামীণ ব্যাংক কেবলই শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রের সেই সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে থাকে।

গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য থাকে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখা। এজন্য গ্রামীণ ব্যাংক তার ঋণগ্রহীতাদের জন্য সহনশীল পর্যায়ে ঋণের বিপরীতে সুদ আরোপ করে থাকে।

কারণ, গ্রামীণ ব্যাংক কখনোই তার ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসা করে না (তথ্যসূত্র: সরকার কর্তৃক নিয়োজিত গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের রিপোর্ট )। ব্যাংকটিকে আর্থিকভাবে সাবলম্বী রাখতে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু সুদের হার নির্ধারণ করা হয়। কারণ, সারা বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা ৮৮ লক্ষ ঋণগ্রহীতা বা গ্রামীণ ব্যাংকের সম্মানিত সদস্যদের সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করেন। তাদের বেতন-ভাতা এবং প্রশাসনিক যাবতীয় খরচ, এই আরোপিত সুদের অর্থ দিয়ে মেটাতে হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি, গ্রামীণ ব্যাংক কখনো দান বা অনুদানের অর্থের উপর নির্ভরশীল নয়। ড. ইউনূস মনে করেন, মানবজাতি কখনো দান ও অনুদানের অর্থের উপর নির্ভরশীল থাকতে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেননি। দারিদ্র্যতা দরিদ্র মানুষ তৈরি করে না। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক যারা রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন করেন সেখানে, তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে ধনীদের আরো সুবিধা দিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঠামোয় তাদের তৈরিকৃত রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সাজিয়ে থাকেন। ফলে, রাষ্ট্রের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে বংশপরম্পরায় অক্টোপাসের মতো আটকে থাকে। সেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই কৃত্রিম বলয় থেকে কখনো তাদের মুক্তি মেলে না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসাকে সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ৭টি নীতিমালা দিয়েছেন। যেখানে এই ৭টি নীতিমালার মধ্য থেকে যদি একটি নীতিমালা অনুসরণ না করা হয় তাহলে, উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীর ব্যবসাটি সামাজিক ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হয় না।

এই নীতিমালার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো তৃতীয় নীতিমালা, যেখানে মানবজীবনের সবচেয়ে বড় নির্দেশনা যা সবসময়ে অদৃশ্যমান ( Invisible) এবং স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতার গুণাবলী যা মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে জড়িয়ে থাকে। আর তা হলো : বিনিয়োগকারী শুধু কেবলই তার বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবেন। উক্ত ব্যবসা থেকে কোনো মুনাফা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসা মুনাফামুখী ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকে। সামাজিক ব্যবসা সামাজিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকে । তদ্রূপ, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কোনো মুনাফা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যাংকের ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ নিতে পারেন না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের একজন প্রতিষ্ঠাতা যিনি কেবলই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তিনি, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তার পারিশ্রমিক পেতেন। বিভিন্ন গবেষণার পেপার পড়ে দেখতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী যতটুকু নির্ধারিত ছিল তার থেকে অনেক কম পারিশ্রমিক তিনি নিতেন।

এবার, প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের বার্ষিক মুনাফা কোথায় যেতো? হ্যাঁ, এর জবাব খুঁজতে আমরা একটু দেখে নিই, গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল কীভাবে কাজ করে থাকে:

# গ্রামীণ ব্যাংকের যিনি ঋণগ্রহীতা বা সন্মানিত সদস্য হয়ে থাকেন, তিনিই আবার ব্যাংকের একজন ডিপোজিটর’স বা অর্থ জমাকারী, আবার তিনিই ব্যাংকের একজন শেয়ারহোল্ডার হয়ে থাকেন।

অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যগণ তাদের ব্যবসা থেকে আয়ের একটি অংশ ব্যাংকে জমা রাখেন বা সহজ কথায় ডিপিএস করে থাকেন। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক ভবিষ্যতে তাকে আরো সাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকতে তাদের সঞ্চয় মনোভাব তৈরি করতে শেখায়। আর, তাদের এই জমাকৃত টাকা হলো গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা তৈরির প্রধান উৎস। বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরবর্তী যে উদ্বৃত অর্থ যা মুনাফা হিসেবে থাকে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৮ লক্ষ সম্মানিত সদস্য সকলের মধ্যে মুনাফার একটি অংশ বণ্টন করে দেয়া হয়। কারণ তিনিই গ্রামীণ ব্যাংকের একজন শেয়ারহোল্ডার। এই তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে (ঋণগ্রহীতা=ডিপোজিটর’স=শেয়ারহোল্ডার) গ্রামীণ ব্যাংকের একজন সম্মানিত সদস্যকে সম্মানিত করা হয়। অতিরিক্ত অর্থ বা মুনাফা যেটা ব্যাংকের উদ্ধৃত থাকে সেই অর্থ দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক তার সন্মানিত সদস্য এবং তার পরিবারের সকলকে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, তাদের সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তিসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে।

গ্রামীণ ব্যাংকের উপর গবেষকগণ তাদের গবেষণায় তুলে ধরেছেন, বাৎসরিক মুনাফা থেকে একটি টাকাও ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ নিতে পারেন না।

এখন আমরা দেখবো গ্রামীণ ব্যাংক কেন পৃথিবীর একমাত্র গরীবের ব্যাংক নামে পরিচিত হলো:

এক নজরে দেখে নিই রাষ্ট্রীয় প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে গ্রামীণ ব্যাংকের তফাৎটা কোথায়?

# গ্রামীণ ব্যাংক হলো পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যা গরীবের ব্যাংক বা Bankers to the Poor হিসেবে পরিচিত।

# গ্রামীণ ব্যাংকের সম্মানিত সকল সদস্য সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষ।

# গ্রামীণ ব্যাংক একমাত্র ব্যাংক যা পৃথিবীর একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যাংক ।

# গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণে কাজ করা ।

# গ্রামীণ ব্যাংকই একমাত্র ব্যাংক তার গ্রাহকের সেবার জন্য ব্যাংকে যেতে হয় না বরং ব্যাংকের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে সেবা দিয়ে থাকেন।

# গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শুধুমাত্র গ্রামীণ জনপদে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কোনো শহরকেন্দ্রীক এদের কার্যক্রম নেই।

# গ্রামীণ ব্যাংকই একমাত্র ব্যাংক যেখানে দরিদ্র মানুষদের ঋণ সুবিধা পেতে তাকে তার পছন্দের ব্যবসার উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাশাপাশি তার ব্যবসা পরিচালনার জন্য সে উপযুক্ত ব্যবসায়িক প্রয়োজনীয় Basic জ্ঞান লাভ করলে, কেবল তখনই ব্যবসার জন্য তাকে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পুঁজি দেয়া হয়।

# গ্রামীণ ব্যাংকই একমাত্র ব্যাংক যেখানে সাপ্তাহিক উঠান বৈঠকে ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা দেখভাল করে থাকেন।

# গ্রামীণ ব্যাংক, পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যা ঋণের বিপরীতে সম্মানিত সদস্যদের থেকে কোনো জামানত (Collateral) নেয়া হয় না। অর্থাৎ পৃথিবীর একমাত্র জামানতবিহীন ব্যাংক।

# গ্রামীণ ব্যাংক একমাত্র ব্যাংক যে ব্যাংকের মডেল পৃথিবীর ৫৪টি দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে চলেছে। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে: আমেরিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

# গ্রামীণ ব্যাংক একমাত্র ব্যাংক যাদের ঋণের বিপরীতে সুদের হার সহনশীল পর্যায়ে থাকে।‌ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সুদের হার কখনো উঠানামা করে না।

# গ্রামীণ ব্যাংকই একমাত্র ব্যাংক যার বোর্ডের ৭ জন সম্মানিত বোর্ড সদস্য যারা গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।

 

এখন আমরা দেখবো গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে সামাজিক কাজে ভূমিকা রাখতে পারে:

– গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে।

– গ্রামীণ ব্যাংক ২৫৬৮ শাখার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে সব গ্রামে জনসাধারণের সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে চলেছে।

– বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মোট সুবিধাভোগী সদস্যদের সংখ্যা ৮৮ লক্ষ। একজন সদস্য তার পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা গড়ে ৫ জন ( kids+spouse) হলে (৮,৮০০,০০০ X ৫) = ৪ কোটি মানুষ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল থেকে ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সরাসরি সুবিধা পেয়ে থাকেন।

– গ্রামীণ ব্যাংক তার ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরীর নিশ্চিয়তা দিয়ে থাকে।

– পৃথিবীর ৫৪টি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল ব্যবহার করে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি আরো কোটি কোটি মানুষ তাদের রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।

– গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীর মানচিত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে, যেখানে একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের ভূমিকার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।

– গ্রামীণ ব্যাংক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, যেখানে মানুষ কেবলই টাকা তৈরির মেশিন নয়। মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দিকগুলোর সাথে স্বার্থপরতার পাশাপাশি স্বার্থহীনতা কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

– গ্রামীণ ব্যাংক SROI (=Social Return on Investment) উপর ফোকাস দেয়।

এভাবে হাজারো সামাজিক ভূমিকা রয়েছে যা লিখে শেষ করা যাবে না। অথচ, আমরা অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে না জেনে, অনেক সময় আবেগবশত বা প্রকৃত ঘটনাকে আড়ালে রেখে বা প্রকৃত তথ্যর অভাবে আমাদের মনগড়া সমালোচনা করে থাকি। বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা পর্যালোচনা এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন আপনিই বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যাংক দুটির কোথায় দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান পার্থক্য রয়েছে, খুঁজে দেখতে পারেন- ” Making money is a happiness, making other people happy is a super-happiness”,-Yunus, 2016। ধন্যবাদ।

 

সহকারী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ
তাইনান, তাইওয়ান।
ইমেইল– [email protected]