অবরোধে তৃণমূলে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি

সরকার পতনের এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলন মোকাবিলায় সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তারে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। ইতোমধ্যে অনেক নেতাকর্মী কারাগারে। গ্রেপ্তার এড়াতে কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ে বেশির ভাগ নেতা আত্মগোপনে। এমন অবস্থায় নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের হাল ধরেছেন তৃণমূল নেতাকর্মী। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশল বদল করে ঘোষিত কর্মসূচি সফল করছেন তারা। এ জন্য মূল্যও দিতে হচ্ছে তাদের। গ্রেপ্তার এড়াতে প্রায় প্রত্যেকেই ঘরছাড়া। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় আত্মগোপনে গেছেন। আবার অনেকে নিরাপদে রাত যাপনে নিচ্ছেন নানা কৌশল। এ ক্ষেত্রে কেউ বনে-জঙ্গলে, কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ও কেউ অন্যের রান্নাঘরে রাত পার করছেন বলে জানিয়েছেন নেতারা। সেখান থেকেই তারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, দেশের ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীর তালিকা করে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। নেতাকর্মী বাড়ি থাকতে পারছেন না। তাদের না পেয়ে আত্মীয়স্বজনকে আটক করা হচ্ছে। বাবাকে না পেলে সন্তানকে, ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক নেতাকর্মীর বাসাবাড়িতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হামলা করছেন, তাদের ধরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তারাও অভিযানে সঙ্গে থাকছেন। ১৯৭১ সালে যেভাবে মুক্তিকামী জনতাকে ধরিয়ে দিতে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে, সে রকমটাই এখন চলছে। বাড়িতে মা-বোনরাও নিরাপদ নয়। তাদের সঙ্গেও অকথ্য আচরণ করা হচ্ছে।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, সারাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মী গ্রেপ্তারে যে অভিযান চলছে তাকে ‘ক্র্যাকডাউন’ বলছেন তারা। এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা তারা আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঘাত ঘটিয়ে, হামলা-মামলা, বাধা দিয়ে উস্কানি সৃষ্টি করছিল। এতদিন বিএনপির শীর্ষ নেতারা সরকারের সেই ফাঁদে পা না দিলেও ২৮ অক্টোবর আর রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার সফল হয়।

তারা বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব রকম দ্বন্দ্ব-কোন্দল ভুলে এ মুহূর্তে আন্দোলন সফল করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকতে বারবার বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা রয়েছে। গত কয়েক দিনে সারাদেশে গ্রেপ্তার অভিযানে যেসব সাংগঠনিক ইউনিটে নেতৃত্ব শূন্য হয়েছে, সে রকম অন্তত দশটি কমিটিতে তাৎক্ষণিক নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, যারা ভাবছেন সরকারের প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে ও মিডিয়ায় অপপ্রচারের সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, তাদের উদ্দেশে বলতে হয়– বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার ভিত্তি তৃণমূল জনগণের শিকড়ে। গত কয়েক দিনে যাকেই যেখানে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানেই তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে জনগণের মধ্য থেকে।

থাকছেন বনে-জঙ্গলে আর নদীর মাঝখানে

কয়েক দিন ধরে সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান থেকে নিরাপদে থাকতে নেতাকর্মীরা বাসাবাড়ি ছাড়ছেন। ভিন্ন এলাকায়, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।

দলটির নেতারা জানিয়েছেন, অনেকে আ‏ত্মীয়স্বজনকে বিপদে না ফেলতে নানা কৌশল নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে তারা বাড়ির আশপাশে বনে-জঙ্গলে, ধানক্ষেতে, নৌকায় মাঝ নদীতে, পুকুর পাহারা দেওয়ার মাচায়, মানুষের রান্নাঘরে আত্মগোপনে থাকছেন। মানবেতর রাতযাপন করছেন। খাওয়া-দাওয়ার কোনো বালাই নেই। অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে তাদের জীবন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রকম অনেক ছবি ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে একটি ধানক্ষেতে ছাত্রদল নেতার রাতযাপনের একটি ছবি বেশি ভাইরাল হয়েছে।

জানা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার একটি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম গ্রেপ্তার এড়াতে ধানক্ষেতে থাকার এ কৌশল নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তিনি জানান, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দিনে কিংবা রাতে তারা বাড়িতে থাকতে পারেন না। গ্রেপ্তার কিংবা হামলা থেকে বাঁচার জন্য তিনি একেক সময় একেক জায়গায় থাকেন। কোনোদিন জঙ্গলে, কোনোদিন নদীর মধ্যখানে নৌকা নোঙর করে আবার কোনোদিন ধানক্ষেতে থাকেন।

একই ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি ফেরদাউস আকনও থাকেন নদীতে। তারা দু’জনই বলেন, দুপুরে যখন বাড়িতে খেতে যান তখন বাবা-মা রাস্তায় পাহারা দেন। খাওয়া শেষে তারা দ্রুত বাড়ি ছাড়েন। তাদের মতো করে দলের অন্য নেতাকর্মীরাও আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে রাজপথে আর আন্দোলনে। এভাবেই নিরাপদে থেকে কর্মসূচি সফলে কৌশল নিয়েছেন নেতাকর্মীরা।

বরিশাল ছাত্রদলের সহসভাপতি সবুজ আকন জানান, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর গ্রেপ্তার এড়াতে একেক সময় একেক জায়গায় থাকছেন। তবে কারও বাড়ির ভেতরে না থেকে মানুষের রান্নাঘরকেই বেশি নিরাপদ মনে করেন তারা। যাতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান টের পেয়ে আগে থেকেই সরে যেতে পারেন।

সিরাজগঞ্জের তানভীর, পঞ্চগড়ের ওমর ফারুক তারাও বাড়িতে থাকতে না পেরে ক্ষেতের পাশের রাস্তায়, কখনও উঁচু গাছে মাচা তৈরি করে থাকছেন। তাদের ছবিও ভাইরাল হয়েছে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সারাদেশের এমন চিত্রের সঙ্গে কোনো তফাত নেই রাজধানীতেও। ঢাকা মহাসমাবেশের পর থেকেই নেতাকর্মীরা নিজ বাসা ত্যাগ করে অন্যত্র উঠেছেন। সেখানেও এক দিনের বেশি তারা থাকতে পারছেন না। একদিকে পুলিশি তল্লাশি, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর নজরদারি এড়িয়ে তারা একেক দিন একেক জায়গায় থাকছেন। তাদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগ করেন– এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বাসাবাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।

সক্রিয় করা হচ্ছে সাবেক জনপ্রতিনিধিদের

অন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে এবার রাজপথে সক্রিয় করা হচ্ছে বিগত দিনে দলের সমর্থনে নির্বাচিত সাবেক ও বতর্মান জনপ্রতিনিধিদের। বিগত দিনে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলনের মাঠে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। তারাও সে সময় দলের প্রয়োজনে, দেশের গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনের কথা বলেছিলেন। এবার সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সারাদেশে স্থানীয় সরকারের এমন ৫ হাজারের বেশি সাবেক জনপ্রতিনিধি রয়েছে বলে জানা গেছে।

নিষ্ক্রিয়দের বিষয়ে কঠোর দল

সারাদেশে যখন নেতাকর্মীর এমন বাস্তব চিত্র, তখন এর ভিন্নটাও দেখছেন দলের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে আন্দোলন-কর্মসূচি থেকে নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা করতে গঠন করা হয়েছে মনিটরিং সেল। সেখানেই ওইসব নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কোন জেলায়, কোন নেতার কী ভূমিকা– সেসব নিয়েও তৈরি হচ্ছে আমলনামা। যারা পদপদবি দখল করে ফোন বন্ধ রেখে রাজপথ থেকে সটকে পড়েছেন, তাদের বিষয়ে কঠোর হচ্ছে দল।

সমকাল
 

1 COMMENT

  1. Who is this writer, publishing in details the strategy and tactics of the opposition parties in a newspaper? Friend or foe?

Comments are closed.