জানুয়ারি ১২, ২০০০…
বিমান বাংলাদেশ ফ্লাইট (বিজি ০৯২) কলকাতা থেকে ঢাকা আসার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এমন সময় ভারতীয় গোয়েন্দারা বিমানের ফ্লাইটে অভিযান চালিয়ে ১১ বিদেশি নাগরিককে আটক করে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল ঢাকায় কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খুনিদের মুক্ত করতে বাংলাদেশি বিমান ছিনতাই করা হবে। ওই ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তারা বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই জানা যায় আসল রহস্য। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে ইসরায়েলের পাসপোর্টও জব্দ করে। আসলে তারা ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রশিক্ষিত এজেন্ট। ইসরাইল থেকে মুহুর্মুহু চাপ আসতে থাকে। ২৪ ঘন্টাও যেতে পারেনি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের তেল আবিব ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ১৬ বছর আগের এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। তখন নানা প্রতিবেদনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের কোনো একটি জঙ্গি সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে তারা মিশন শুরু করতে চেয়েছিল।
তখন থেকেই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের ইন্টিলিজেন্স এজেন্সীগুলো,২০০১ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে এমন ঘটনা যেকোন দেশের নিরাপত্তার জন্যই বেশ চিন্তার কারন।আর এর ৩ বছর পরেই বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পরে মোসাদ এজেন্ট…
নভেম্বর ২৯, ২০০৩। বিজি ০৮৪। বাংলাদেশ বিমানের এই ফ্লাইটটি ব্যাংকক ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশি গোয়েন্দারা আটক করেন সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী নামের এক সাংবাদিককে। বাংলাদেশে ইসরায়েলের হয়ে কাজ করেন তিনি। এবং এটা ছিল প্রকাশ্য। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে নিজ নামেই লিখতেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের জেলে এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ৭ বছরের সাজা খাটছেন।
২০০৩ সালের ১ ডিসেম্বর দ্যা ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে গ্রেফতার করার সময় তার কাছে একটি প্রজেক্ট প্রোফাইল পাওয়া যায়, যাতে তিনি ইসরাইলের কাছে তিনটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য ১২ কোটি টাকা সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। তিনি তার আবেদনে ইসরাইলী বন্ধুদের মুসলিম প্রধান দেশে মিডিয়া গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, কোটি কোটি ডলার খরচ করে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চেয়ে মিডিয়া সৃষ্টি করুন, এতে ইসরাইল বেশি লাভবান হবে। তিনি তেল আবিবে একটি সেমিনারে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। ২০০৫ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্তি পান। ৩০ এপ্রিলের ডেইলি স্টার বলেছে যে আদালত তাকে জামিন দিয়েছে সেই আদালতই ২ এপ্রিল জামিন নাকচ করে বলেছিল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে বর্তমান মার্কিন সিনেটর ও তখনকার কংগ্রেসম্যান মার্ক স্টিভেন কির্ক ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর চাপ প্রয়োগ করায় তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। সালাউদ্দিন শোয়েবের মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরবর্তীসময়ে কংগ্রেসে একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছে।
সেখান থেকেই ধারনা করা হয় বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার পিছনে মোসাদেরও বড়সড় হাত ছিলো।শুধু তাই নয়,বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপির কয়েকজন সদস্যও মোসাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন।গত ৫ মার্চ থেকে ০৯ মার্চের মধ্যে ভারতে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বা বর্তমানে আলোচিত ইসরাইলী এক উপমন্ত্রীর উপদেষ্টা মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের যে সাংবাদিক মধ্যস্থতা করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে তিনি হলেন ওই সঞ্জীব চৌধুরী, যিনি হরকাতুল জেহাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং যিনি ঢাকায় ইসরায়েলের ক্যাম্পেইনার শোয়েব চৌধুরী ও ইহুদি মানবাধিকার কর্মী বেনকিনের ঘনিষ্ঠজন।
এছাড়াও সাফাদি প্রায় এক বছর ধরেই বলে আসছেন বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতারা যারা ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের অনেকে তাকে লবিস্ট নিয়োগ করতে চান। তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান যেন বাংলাদেশের সরকারকে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কাজটি করে।
এসব তথ্য উপাত্ত প্রমাণ করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বা ইহুদিদের সঙ্গে বিএনপির কোনো না কোনো যোগাযোগ অনেক আগেই হয়েছে। আন্দোলন করে সরকারকে হটাতে না পেরে তারা আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করছে। সেটাও তেমন কোনো দোষের হতো না যদি তারা পৃথিবীর একমাত্র যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নেই তাদের সঙ্গে হাত না মেলাতো।
এর আগে ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপি জঙ্গিদের ছাড় দিয়েছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এখন তারা ইসরায়েলের সঙ্গেও হাত মেলাতে পারে- এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস দলগতভাবে বিএনপি এই সিদ্ধান্তটি নেয়নি। ইহুদি লবিস্ট সাফাদি যে মি : রহমানের কথা সাক্ষাৎকারে বলেছেন হয়তো সেই রহমানের ইশারায়ই এটা হয়েছে। এখন বিএনপিকে দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রহমানদের কথায় দল চলবে নাকি জনগণের উপর ভরসা করে ভবিষ্যতের কথা ভাববে।
এছাড়া এরপরে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ও মার্কিন নাগরিক ইহুদি মানবাধিকার কর্মী রিচার্ড এল বেনকিনের উদ্যোগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে হুজি প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো প্রতিবেদনে জানায় আলোচনায় অংশ নিয়ে সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী বলেন, আইডিপির আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন রাজনীতির জন্ম হলো। তিনি বলেন, আইডিপির সঙ্গে হরকাতুল জিহাদের নাম জড়িত। অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী বলেন, ‘আফগানফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মূলধারার সদস্যরা আইডিপি গঠন করেছে। পরিচয়সূত্রে আমি এদের সঙ্গে অনেক কাজ একত্রে করেছি। আমরা এই অনুষ্ঠান আরো আগে করতাম, কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনুমতি পেতে দেরি হয়েছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ দ্যা ডেইলি স্টারকে বেনকিন জানিয়েছেন তার এবং সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তেই ওই উদ্যোগ সফল হয়েছে।
উল্লেখ্য এপ্রিল ১০ ২০০৬ দ্যা ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী তখনকার বিএনপি সরকার মাসিক ৪৫ হাজার মার্কিন ডলারের চুক্তিতে দুটি ফার্মকে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। একই সঙ্গে একজন স্বঘোষিত এই মার্কিন মানবাধিকার কর্মী রিচার্ড এল বেনকিনকেই লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলবে বলে চুক্তি করে।
লেখক: সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ