ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : তারা দু’জন ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা সেই ষাটের দশকে। ছাত্ররাজনীতির রাজকীয় ফসল ও পরবর্তীকালের জাতীয় নেতা বা নেত্রী। উচ্চকণ্ঠ বক্তা, চিন্তক এবং ছিলেন বামপন্থার ধারক ও বাহক। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন, বেঙ্গল অন্তরেও দুই বাইরেও দুই। এই দুই তরুণ যৌবনেও ছিলেন ক্ষমতাসীনদের মূর্তিমান প্রতিপক্ষ, বড্ড বেয়াড়া সমালোচক। পরবর্তীকালে দেখা গেল, তারা রীতিমতো ভোল পাল্টে বাম থেকে ডানে এসে শামিল হয়েছেন। এদের একজন এই সেদিন সুন্দর স্বগতোক্তি করলেন, ‘আজকাল ক্ষমতার লোভে বামরাও ডানে’।
এত সুন্দর স্বগতোক্তিতে শেকসপিয়রের কুশীলবরাও এত স্মার্ট ছিলেন না। রাজা না থাকলেও রাজনীতিপাড়ার আশপাশের অনেককে আজকাল সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা এবং পরের দিন ভোরে নিজের অবস্থান নিজে অকপটে খণ্ডন করেন এবং এ ধরনের বর্ণচোরারা এমন সব মহাজনবাক্য আওড়ান যে, তাতে অন্যেরা বুঝতে পারে তার বা তাদের উপলব্ধির চত্বরের সাধারণ ঘাস এখন অসাধারণ এস্ট্রোটাফ হিসেবে চিক চিক করছে। শেকসপিয়রের বেদনাবিধুর রোমান্টিক নাট্যকাব্য ‘ওথেলো’র ইয়োগো যেমন বারবার নিজের কূটচাল প্রকাশ ও প্রয়োগ করতেন। আজকাল প্রতিপক্ষকে অপশক্তি, তাদের অপরাজনীতির ফল-ফসল বলে শনাক্ত করতে গিয়ে নিজেদের আসল চেহারা আড়ালের চেষ্টা চলে, অন্যকে স্বেচ্ছায় হেনস্তা করে শক্ত করতে চান নিজের অবস্থানকে। ফিয়দর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ কিংবা টলস্টয়ের ‘ওয়্যার অ্যান্ড পিস’ এবং এমনকি পার্ল এস বাকের ‘গুড আর্থের’ মতো কালজয়ী উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে আত্মসমালোচনা ও শোচনার যে সব টেকনিক লক্ষ করা যায় অধুনা অনেকের, দেশে ও বিদেশে, ঘরে ও বাইরে হরহামেশা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিনা প্ররোচনায় প্রকাশ পায়। সবার নমস্য ঠাকুর পৈতায় হাত বুলাতে বুলাতে যেমন ভেবেছিলেন, পুরোহিত আর পণ্ডিতগিরি একসাথে চলে না। দেখা যায় ‘কারো প্রতি রাগ কিংবা অনুরাগের বশবর্তী না হওয়া’র শপথ নিয়েও নিজের পাটাতনের মুখপাত্র সেজে প্রতিপক্ষকে যেকোনো ভাষা ও ভঙ্গিতে আক্রমণ চালাতে কসুর করেন না। সর্বজনীনতার আদর্শপক্ষপাতিত্বের, কালোতীর্ণ বিষয় কালের মধ্যে, জাতীয় নেতা দলীয় নেতায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। রাজনীতির নাট্যশালায় এমন ‘নাটক’ রচিত হয় যা মঞ্চস্থ করা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। এটি যে চরম আত্মঘাতী প্রবণতা-কালেভদ্রে স্বগতোক্তিতে তা বাঙময় হয়ে ওঠে। অন্যের মর্ম যাতনা নিজের মধ্যে আমদানির প্রয়োজন পড়ে না, এলসি না খুলে তা শিপমেন্ট হয়ে যায়।
ধ্বনি ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-৬৯) সাড়ে ছয় দশক আগে ১৩৬৪-এর ফালগুন-চৈত্র সংখ্যা সমকাল পত্রিকায় ‘তোষামোদের ভাষা’ এবং একই পত্রিকার ১৩৬৫-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘রাজনীতির ভাষা’ শিরোনামে দু’টি প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধ দু’টি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তার ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ গ্রন্থভুক্ত হয়। সেকাল ও একালে রাজনীতির ভাষা ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ধারা সন্ধান শনাক্ত করতে তার এ লেখা। প্রথমে সাধু স্বীকৃতি (ডিসক্লেমার) দিয়ে রাখা ভালো যে, রাজনীতি ও এর ভাষা প্রক্রিয়া-প্রকরণ নিয়ে এ রচনা নিছক একাডেমিক ও নির্মোহ- নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে রচিত, এতে কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো কালের কোনো সংগঠনের প্রতি অনুরাগ কিংবা বিরাগ প্রকাশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কেননা, অনেক সমাজে ‘রাজনীতি’ নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যেও রাজনীতির গন্ধ খোঁজার সংস্কৃতি আগেও যেমন ছিল, বর্তমানে তা আরো বড় করে বলবতকরণের বড় বড় আইন বিদ্যমান আছে। সে সব দেশ ও সমাজে মুক্তবুদ্ধিচর্চা নানা ঘেরাটোপের মধ্যে আছে।
এটি ঠিক, যেকোনো ভাষার নাম শুনলে সবার কাছে সে ভাষার একটি সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে। সেই ভাষার গঠন প্রকৃতি ও আঙ্গিক ইত্যাদির মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলাজনিত যে নানা খুঁটিনাটি ভাগ আছে সেটি ধরা পড়ে সমাজে ভাষার ব্যবহার থেকে। অধ্যাপক হাইয়ের মতে, ‘সমাজজীবন গড়ে তোলার জন্যই মানুষের ভাষার উদ্ভব বলে সমাজজীবনে ভাষার ব্যবহারের বেলায় তার সত্যিকার স্বরূপটি ধরা পড়ে। ভাষার কাজ হলো পারস্পরিক সমঝোতা তা কমপক্ষে দু’জনের মধ্যেই হোক কিংবা বহুজনের মধ্যেই হোক, দুটো মানুষ যখন কথা বলে তখন একসাথে নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয়েই তারা আলাপ-আলোচনা করে… তখন বিষয়োপযোগী ভাষাই সে ব্যবহার করে। সমাজজীবনের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে ওই ক্ষেত্রোপযোগী যেসব শব্দের হার গাঁথা হয়, তা-ই ভাষাকে তার সামগ্রিক রূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নানা ভাগে ভাগ করে দেয়। এ কারণেই সমাজজীবনের বিচিত্র পরিবেশে ভাষারও বিচিত্র প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। সে নিরিখেই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো রাজনীতির ভাষারও… বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন রকমের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ নিজ নিজ ভাষায় উপযোগী শব্দ সৃষ্টি করে নেয়। এসব শব্দ এক দিনে সৃষ্টি হয় না, রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যাদের হাতে থাকে, প্রয়োজনের তাগিদে তারা কিছু শব্দ এবং এর প্রকাশ-প্রক্রিয়া বা ভঙ্গি সৃষ্টি করিয়ে নেন।’
চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, নিয়ত বা পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে যেমন কাজের গতি-প্রকৃতি, তেমনি রাজনীতির ভাষা খোদ রাজনীতির চরিত্র, নীতি ও প্রকৃতি অনুযায়ী উৎসারিত -উচ্চারিত হয়ে থাকে। রাজনীতির সংস্কৃতি-রুচি চাহিদা ও উদ্দেশ্য-বিধেয় অনুযায়ী তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে।
পরিবেশ অনুসারে ভাষার শব্দাবলির ব্যবহার থেকে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও ভাবনাচিন্তার বাহন হিসেবে মানুষের চিন্তাধারার সাথে সঙ্গতভাবে সেই চিন্তার আধার তথা ভাষার গভীরতর রহস্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। সরকার বা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য একেক দেশে বহু রকম রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে তাবৎ দেশে দল-মত নির্বিশেষে প্রত্যেকটি দলই দেশের অধিবাসীদের কাছে তাদের আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে উপস্থিত হয়, আর সাধারণকে তাদের মতে দীক্ষিত করতে ভাষার সাহায্যে জোর প্রচারণা চালায়। অন্য কথায়, ভাষা রাজনীতিকদের হাতের পুতুল হয়ে ওঠে। সে ভাষা দিয়ে তারা নিজের বক্তব্য যেমন প্রচার করিয়ে নেন, তেমনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অপপ্রয়োগ করতেও কুণ্ঠিত হন না।
পশ্চিমের উদার মতাবলম্বী দেশনিচয়ে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে যে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তা অবারিত নয়। সেখানে ব্যক্তিবিশেষ কি পার্টিবিশেষ যা খুশি বা যেমন খুশি তেমন করে ভাষা প্রয়োগ করতে পারে না। সে সব দেশে রাজনৈতিক মতামতের স্বাধীনতা আছে কিন্তু সে স্বাধীনতা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য নয় বা রাষ্ট্রের স্বার্থ বা অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে, এমন অন্তর্ঘাতী কোনো কিছু কাজ করতে নয়। রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য বহুমুখী করে তোলাই এবং মতামতের পার্থক্য সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কতকগুলো কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করে যাওয়ার জন্য তাদের একত্রিত করার এই ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল অনেক দেশে স্বৈরতন্ত্রে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তাদের তাড়াতে বেগতিক হয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই নিজেদের শত্রু বনে যায়। দেশে মানবাধিকারের সঙ্কট মোকাবেলা করতে না পেরে বিদেশের কাছে নালিশ দিতে বাধ্য হয়। বিদেশীরাও এ সুযোগে স্বৈরতন্ত্র বা ক্ষমতাসীনকে শক্তিশালী ক্ষমতা প্রয়োগর ব্যাপারে দরকষাকষির মাধ্যমে গোটা দেশ ও সমাজকে রীতিমতো অসহায় করে ফেলে।
আজ থেকে সাড়ে ছয় দশক আগে, ঔপনিবেশিক পরিবেশে, অধ্যাপক আবদুল হাই যা দেখেছিলেন, আজ স্বাধীন সার্বভৌম পরিবেশেও তার অবস্থানে তেমন হেরফের ঘটেনি; বরং বিপর্যস্ততার মাত্রা ও গতি বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। পরিশেষে এ ব্যাপারে অধ্যাপক হাইকে উদ্ধৃত করা যায় :
‘রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করার জন্য তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য অনুসারে জনমত গড়তে গিয়ে দেশের ভাষাকে তাদের প্রচারমুখী আদর্শের বাহন করে তোলে। রাজনৈতিক দলের আদর্শ যদি উন্নত না হয়, লক্ষ্য যদি অভ্রান্ত না থাকে এবং দেশের বৃহত্তর কল্যাণের দিকে নজর না দিয়ে আদর্শগত ও আর্থিক ব্যবস্থাজনিত কর্মসূচি যদি তারা তৈরি না করে কিংবা রাজনৈতিক দর্শন অনুসারে দলের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের না থাকে, তাহলে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতাসীর হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কলহ-কোন্দলে লিপ্ত হয়- ফলে রাজনীতির ভাষা শালীনতা হারায়। আদর্শগত সংগ্রাম বা নীতি প্রচারের বাহন না হয়ে ভাষা তখন কবিওয়ালাদের খেউর গানের বাহনের মতো হয়ে ওঠে এবং ভাষার মানও অচিন্তনীয়ভাবে নিচে নেমে যায়। আমাদের অতীত রাজনৈতিক জীবনের দুর্গতির মধ্যে আমাদের নেতাদের ভাষা ব্যবহারের রূপ ও ধরনই আমাদের এ উক্তির সমর্থন করে।’
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
নয়াদিগন্ত