- ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
- ০৫ মে ২০২৩, ২০:৪১
মানুষ বিভিন্ন অনুভূতির মিশ্রণ দিয়ে গড়া। রাগও তেমনি এক প্রকার মানবীয় অনুভূতি। রাগ কোনো মানসিক রোগ নয়, তবে অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানসিক রোগ। রাসূল মোহাম্মাদ সা: রাগ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের অন্তর একটি উত্তপ্ত কয়লা’। (তিরমিজি) রাগ হলো মানুষের সংক্ষিপ্ত উন্মাদনা। মনীষী পিথাগোরাস বলেছেন, ক্রোধ মূর্খতা দিয়ে শুরু হয় এবং অনুতাপের সাথে শেষ হয়। ক্রোধ হলো শয়তানের প্রতারণার বড় ফাঁদ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে মানুষ তার মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না, তাদের মনেই অনেক রাগ হয়।’ রাগ একটি সর্বজনীন আবেগ। আমরা সবাই বিভিন্ন কারণে বিরক্ত, হতাশ বা ক্ষুব্ধ বোধ করি। কিন্তু রাগ জন্মগতভাবে ভালো বা খারাপ নয়। অনেক সময়ই রাগ আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য অন্তর্নিহিত গাইড হিসেবে কাজ করে। তবুও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা এমন রয়েছে যে, রাগ মানেই উচ্চস্বরে ও হিংসাত্মক আচরণ দেখিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। বাস্তবে, রাগ একটি জটিল আচরণ।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘তোমার ক্রোধের জন্য তোমাকে শাস্তি দেয়া লাগবে না, তোমার ক্রোধের দ্বারাই তুমি শাস্তি পাবে।’ সাধারণত মানুষের যখন কোনো দুঃখ থাকে তখন কেবল তাদের অবস্থা নিয়ে কাঁদে। কিন্তু একজন মানুষ যখন রাগ করে তখন তার নিজের ও অন্যের বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একজন রাগান্বিত ব্যক্তি রাগের সময় যুক্তিহীন অবস্থায় থাকে কিন্তু রাগ প্রশমিত হলে এবং যুক্তিতে ফিরে এলে আবার নিজের সাথেই রাগ করে। ক্ষেত্রবিশেষে রাগ একটি পঙ্গু, নষ্ট ও গন্ধযুক্ত আবেগ, যা লেগে থাকলে গন্ধ বের হবে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘রাগ মানুষের ঈমানকে এমনভাবে নষ্ট করে যেমন তিক্ত ফল মধুকে নষ্ট করে দেয়।’ এরিস্টটল বলেছেন, ‘যে কেউ রাগ করতে পারে, এটি সহজ, তবে সঠিক ব্যক্তির সাথে সঠিক ডিগ্রিতে এবং সঠিক সময়ে সঠিক উদ্দেশ্যে ও সঠিক উপায়ে রাগান্বিত হওয়া বেশির ভাগের ক্ষমতার মধ্যে নেই এবং সহজও নয়।’ গান্ধী বলেছেন, ‘ক্রোধ অহিংসার শত্রু ও অহঙ্কার। এটি এমন এক দৈত্য যা তাকে গ্রাস করেই তবে ছাড়ে।’ রাগ করা মানে অন্যের দোষের কারণে নিজের বিরুদ্ধে নিজেরই প্রতিশোধ নেয়া। ক্রোধ ধরে রাখা মানে জ্বলন্ত কয়লা অন্য কারো দিকে ছুড়ে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেই আঁকড়ে ধরে রেখে জ্বলেপুড়ে মরা।
মানুষকে ধোঁকাদান ও প্রতারণার ক্ষেত্রে ক্রোধ তথা রাগ হচ্ছে অভিশপ্ত শয়তানের বড় অস্ত্র। শয়তান মানুষকে ক্রোধের বশবর্তী করে বিচ্যুতির ফাঁদে ফেলে এবং বিপথগামীর দিকে নিয়ে যায়। হিংসাত্মক উত্তেজনার কারণে মানুষ তার বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং তার মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে। এ কারণে কিছু মানুষ শিষ্টাচার ও ভদ্রতার ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ক্রোধ হচ্ছে দুর্বলতা; কিন্তু মানুষ একে শক্তি বলে মনে করে। প্রকৃতপক্ষে ক্রোধ হচ্ছে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যা আপনাকে আগুন ধরিয়ে আর আপনি অন্যদের দগ্ধ করেন। সুতরাং, এই আগুন কেবল আপনাকেই আহত করে না; বরং অন্যদেরও করে।
ক্রোধের বিধ্বংসী প্রভাব
ক্রোধ মানুষের মানসিক অবস্থাকে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অপরাধবোধ ও হতাশার দিকে নিয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অব রোচেস্টারের গবেষকরা জার্নাল অব সাইকোসোমাটিক রিসার্চ নামের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় জানিয়েছেন, ‘যারা নিজেদের আবেগ চেপে রাখে তাদের দ্রুত মৃত্যুবরণ করার আশঙ্কা, যারা মন খুলে নিজের আবেগ প্রকাশ করেন তাদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
শারীরিক কারণে রাগ : রাগের বহিঃপ্রকাশের কারণ যখন শারীরিক কোনো কষ্ট বা যন্ত্রণার অনুভূতি থেকে হয় তখন তাকে ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গার বলে। যেমন- ক্ষুধা পাওয়া, অসুস্থ হওয়া। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ফিজিক্যাল অ্যাঙ্গারের লক্ষণ বেশি প্রকাশ পায়। এ ধরনের রাগ তাড়াতাড়ি ওঠে ও নেমেও যায়।
মানসিক সমস্যার কারণে রাগ : মানসিক অসন্তুষ্টি, দীর্ঘদিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনবরত কাজ করে চলা, আকাক্সক্ষার অতৃপ্তি, গ্রহণযোগ্যতা বা মান্যতার অভাব ইত্যাদি। এ সব রাগের উৎস হলো- ভয়, হতাশা, অপরাধবোধ, হীনম্মন্যতা, অহংবোধ, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, ঈর্ষা ও সামাজিক মর্যাদা, মাদকাসক্তি, আকাক্সক্ষার অতৃপ্তি এবং মতাদর্শের পার্থক্য, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবা, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যতিক্রমী মানসিক সমস্যা যেমন- ব্যক্তিত্বের ত্রুটি, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, শুচিবায়িতা, মাদকাসক্তি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, কনডাক্ট ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া ইত্যাদির অন্যতম উপসর্গ হলো রাগ। খুঁতখুঁতে স্বভাব, হীনম্মন্যতাবোধ, অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, সব কিছুতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, ব্যর্থতা মেনে না নেয়ার মনোভাব ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মানুষের মধ্যে অল্পতেই রেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
ফ্রয়েডের মতে, অন্যের প্রতি আক্রমণ মানুষের নিজের প্রতি ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির এক রকম আত্মরক্ষামূলক আচরণই হলো রাগ। আলবার্ট বান্দুরার মতো মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তির অনিয়ন্ত্রিত রাগ মূলত তিনি পরিবেশ থেকেই শেখেন। তার মতে, ব্যক্তি তার আগ্রাসীভাবের কারণে চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়। অনেক সময় অন্যের আগ্রাসনও যখন পরিবার ও সমাজ কর্তৃক নানাভাবে উৎসাহিত হতে দেখে, সেটিও তাকে উৎসাহিত করে। তবে এ বিষয়ে অন্যতম শক্তিশালী তত্ত্ব জন ডোরাল্ডের ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন মতবাদ। রাগ মূলত মানুষের আশাভঙ্গ, নিষ্ফলতা, ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে সে আশাভঙ্গ বা বিফলতার মাত্রা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় বা এর মাত্রা যদি গভীরতর হয়। ছোটবেলায় যদি কেউ এমন পরিবেশে বড় হয়, যেখানে মা-বাবা বা অভিভাবকরা অল্পতেই রেগে যান, সেই পরিবারে শিশুরাও একই ধরনের আচরণ শেখে।
রাগ প্রকাশের ধরন
সাধারণভাবে মানুষ রাগান্বিত হলে মূলত চার ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে-
আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া : রাগের এই প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত মারাত্মক যেমন চিৎকার চেঁচামেচি করা, অন্যকে আঘাত করা, জিনিসপত্র ভাঙচুর করা, নিজেকে নিজেই আঘাত করা, আত্মহত্যা করতে উদ্যত হওয়া ইত্যাদি বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো।
নিষ্ক্রিয়/আক্রমণাত্মক মিশ্ররাগ প্রতিক্রিয়া : রাগের এই ধরনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয় বাহ্যত রাগ সুপ্ত রেখে আর সময় সুযোগমতো আক্রমণাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে এর শেষ হয়।
নিষ্ক্রিয় রাগ প্রতিক্রিয়া : এ ধরনের রাগের বাহ্যত বহিঃপ্রকাশ হয় না। অর্থাৎ ব্যক্তি রাগ সহ্য করে নেয়। কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
দৃঢ়তাপূর্ণ যৌক্তিক রাগ প্রতিক্রিয়া : এ ধরনের রাগের বাস্তবে যৌক্তিকতা থাকে এবং এর বহিঃপ্রকাশও ঘটে ন্যায্য নীতিতে। দৃঢ়তাপূর্ণ রাগ আসলে রাগের প্রকাশের একটি গঠনমূলক বহিঃপ্রকাশ। এতে হতাশা বা রাগের অনুভ‚তি সাধারণত ইতিবাচক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে রাগকে চেপে রাখা হয়। মৌখিক অপমান এবং শারীরিক বিস্ফোরণ অবলম্বন করার পরিবর্তে, রাগ এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যা গঠনমূলক পরিবর্তন তৈরি করে যা একজন ব্যক্তিকে তাদের ইচ্ছা পূরণের কাছাকাছি নিয়ে আসে- কষ্ট বা ধ্বংস না করে। এভাবে দৃঢ় ক্রোধের অভিব্যক্তি অন্য মানুষের অধিকার ও সীমানা লঙ্ঘন না করেই একজন ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করতে পারে। দৃঢ় ক্রোধ হলো একটি শক্তিশালী প্রেরণা যা ভয়কে কাটিয়ে উঠতে, অন্যায়কে মোকাবেলা করতে এবং জীবনে আরো কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আচরণগত রাগ
আচরণগত রাগ একটি শারীরিক এবং প্রায়ই আক্রমণাত্মক, রাগান্বিত অনুভূতির প্রতিক্রিয়া। এটি মানুষকে রাগ প্রকাশের চরম প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে এবং হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের আচরণে বাহ্যিক ক্ষতির উদ্দেশ্যমূলক প্রেরণা থাকে। রাগান্বিত অবস্থায় জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা বা ছুড়ে মারা বা শারীরিকভাবে ভয় দেখানো বা কাউকে আক্রমণ করা এ জাতীয় রাগের বহিঃপ্রকাশ।
দীর্ঘস্থায়ী রাগ
দীর্ঘস্থায়ী রাগ হলো অন্য লোক বা ব্যবস্থার প্রতি চলমান অসন্তোষ। দীর্ঘস্থায়ী ক্রোধের বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘমেয়াদি বিরক্তি ও চিরস্থায়ী জ্বালা। এ ধরনের রাগের দীর্ঘসূত্রতা একজনের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উপর গভীরভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
উদ্বায়ী বা আকস্মিক রাগ
এটি এমন একটি আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া যা মুহূর্তেই জ্বলে উঠে পরক্ষণেই নির্বাপিত হয় ছাইভষ্ম হয়ে। উদ্বায়ী রাগ হলো একটি বিস্ফোরক ধরনের রাগ যাকে কখনো কখনো ‘হঠাৎ রাগ’ বলা হয়। এটি ঘটতে পারে যখন কেউ মৌখিক বা শারীরিকভাবে বিস্ফোরিত হয় এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। এটি প্রায়ই চিৎকার, চেঁচামেচি, জিনিস ছুড়ে ফেলা এবং শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত করে ফেলে।
নিষ্ক্রিয়-আক্রমণাত্মক রাগ
প্যাসিভ-আক্রমণাত্মক রাগ হলো আক্রমণাত্মক রাগের বিপরীত কারণ এতে ক্ষোভ ভেতরে লুকিয়ে রেখে পরে সুবিধামতো সময়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। রাগের নিষ্ক্রিয়-আক্রমণাত্মক আচরণ মৌখিকভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে, যেমন- বিদ্রুপ, হাসিঠাট্টা ও উপহাস করা।
প্রতিশোধমূলক রাগ
প্রতিশোধমূলক ক্রোধকে সাধারণত বাহ্যিক ঘটনা বা ব্যক্তি দ্বারা মুখোমুখি হওয়া বা আক্রমণ করার একটি সহজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে, এটিকে রাগের মারাত্মক ও বিপর্যয়কর বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করা হয়।
স্ব-অপমানজনক রাগ
স্ব-অপমানজনক রাগ স্ব-লজ্জার অনুভূতির উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। যারা নিজদের আশাহীন, অযোগ্য, অপমানিত বা লজ্জিত বোধ করেন তারাই নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন, আত্ম-ক্ষতি, পদার্থের অপব্যবহার ও আত্মহননের বিকৃত চেষ্টার মাধ্যমে তাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
বৈধ ও অবৈধ রাগ : ইসলাম একেবারে রাগহীন জীবনকে উৎসাহিত না করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষোভ প্রকাশের কথাও বলেছে। হতে হবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এবং অবশ্যই তা দ্বীনের উদ্দেশ্যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে, নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশে নয়। আমাদের রাসূল বলেন, ‘ঈমান পূর্ণ করার চারটি আমল, যা কিছু মানুষকে দেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য, যা কিছু নেব আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। যাকে ভালোবাসব আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসব। যার প্রতি রাগ করব তাও আল্লাহকে খুশি করার জন্য।’ (তিরমিজি) যে রাগ ইসলামের সীমা লঙ্ঘন করে এবং ব্যক্তির মানসিক-শারীরিক, সমাজ ও পরিবারের ক্ষতি করে তা অবৈধ রাগ। এর কারণে প্রধানত পাঁচ ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়- শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়।
ক্রোধ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটায় : যেকোনো কাজ করার আগে আমরা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেককে কাজে লাগাই। সে অনুসারে মস্তিষ্ক শরীরের দু’টি কন্ট্রোলিং সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। তার একটি হলো নার্ভাস সিস্টেম, অপরটি হলো এন্ডোক্রাইন সিস্টেম। আমরা যখন অত্যধিক মাত্রায় রাগান্বিত হই, তখন আমাদের ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব উত্তেজিত হয়। বিচার-বুদ্ধি এরিয়া একদিকে যেমন ভলান্টারি নার্ভাস সিস্টেম অনুগত হাত-পা-শরীরের মাংসপেশিকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত উত্তেজিত করে আক্রমণাত্মক কাজ করাতে উদ্যত হয়, অন্যদিকে বডি হরমোনাল সিস্টেমের হরমোনকে রক্তে প্রবাহিত করে বিভিন্ন জায়গায় মেসেজ পাঠিয়ে তার কাজ করতে নির্দেশ দেয়। মানুষের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবে যে বিচার-বুদ্ধি এরিয়া থাকে তা মানুষের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে এবং ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করে মস্তিষ্কের এমিগডালাসহ অন্যান্য অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ব্রেইনের বিচার-বুদ্ধি এরিয়া আবার মানুষের বিবেকের কথামতো পরিচালিত হয়। যেমন- আমি যদি বিবেকহীনভাবে ক্রোধান্বিত হয়ে কাউকে হত্যা করতে উদ্যত হই, তখনই কেবল ব্রেইন আমার কথামতো হত্যা করার শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো করে।
নার্ভাস সিস্টেমের উপর রাগের প্রভাব
আমাদের শরীরের কাজের রেগুলেটরি সিস্টেম হলো দু’টি যারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। একটি হলো নার্ভাস সিস্টেম যা কাজ করে নার্ভ ফাইবারের মাধ্যমে বাহিত হয়ে ইলেকট্রিক সিগন্যাল প্রয়োগ করে, অন্যটি হলো হরমোনাল সিস্টেম যা কাজ করে রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কেমিক্যাল মেসেঞ্জারের মাধ্যমে। আমাদের শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সমস্ত কার্যকলাপ মূলত দু’ভাবে চালিত হয়। একটি হলো বাহ্যিকভাবে দেখা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ যা ভলান্টারি নার্ভাস সিস্টেম যা আমাদের ইচ্ছামতো পরিচালিত হয়, যেমন- কথা বলা, হাঁটা, চলাফেরা করা ইত্যাদি।
অপরটি হলো ইনভলান্টারি নার্ভাস সিস্টেম যার পরিচালনা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের ওপর। এই সিস্টেমটি শরীরে ভেতরে ভিসারাল লেভেলে অনবরত সক্রিয় থাকে। অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম অর্থাৎ যে সিস্টেমের ওপর মানুষের সরাসরি কন্ট্রোল নেই, সে নার্ভাস সিস্টেম আবার দু’ভাবে কাজ করে। একটি হলো- প্যারাসিম্প্যাথেটিক এবং অপরটি হলো সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম। এই দু’টি সিস্টেম পরস্পরের বিপরীতমুখী কাজ করে। একটি সিস্টেম সক্রিয় থাকলে অন্যটি অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যে সমস্ত কাজে আরাম আয়েশ ও ঘুম-বিশ্রাম হয়, শরীর শান্ত থাকে, প্রস্রাব-পায়খানা করতে হয়, হজম করে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়, মানুষের পরস্পরের ভালোবাসায় সম্পৃক্ত করে সেই সমস্ত কাজের সাথে জড়িত হলো প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম। আর তার ঠিক উল্টো কাজ যেমন নিজকে রক্ষা ও আক্রমণাত্মক করার জন্য প্রস্তুত করা হলো সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ। আবার মানুষ এমনই প্রাণী যার সাথে আবেগ জড়িত। এই আবেগও আবার দু’রকম। পজিটিভ আবেগ ও নেগেটিভ আবেগ।
বিবেক বুদ্ধির ওপর রাগের প্রভাব
পশু-পাখি তাদের বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য যতটুকু বুদ্ধি-জ্ঞান দরকার ততটুকুই আছে। এক প্রাণী আরেক প্রাণীর খাবার। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা খাবারের প্রয়োজন মিটে গেলে চলে যায়। কোনোরকম প্রতিহিংসার আশ্রয় নেয় না। আর একজন মানুষ রাগান্বিত হলে অন্য মানুষকে শুধু হত্যাই করে না; বরং কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেয়। এর কারণ হলো নিয়ন্ত্রণহীন রাগান্বিত অবস্থায় বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান সবই সাময়িকভাবে হলেও লোপ পায়। মস্তিষ্ক সমস্ত নার্ভাস ও হরমোনাল সিস্টেম পরিচালনা করলেও এই মস্তিষ্ককে আবার পরিচালিত করে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান। সুতরাং বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান- এই তিনের যথাযথ প্রয়োগই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করতে পারে। রাগ সুস্থ চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা ও একাগ্রতা দুর্বল হয়ে পড়ে। চিন্তাশক্তি একপেশে, অতিরঞ্জিত ও অযৌক্তিক অনমনীয় করে ফেলে। অনুমানকে সত্য হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ যুক্তিহীন হয়ে যেতে পারে। রাগ আকাশে মেঘের মতো সত্য-সূর্যকে ঢেকে রাখে, আগুনে ঘি ঢেলে দেয়, বারুদের বিস্ফোরণ ঘটায়।
কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের ওপর রাগের প্রভাব
মানুষের গড় হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে ৮০ বিট, কিন্তু মানুষ যখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়, তখন পালস ১৮০ বিট প্রতি মিনিট আকারে ত্বরান্বিত হতে পারে। একইভাবে, রাগ রক্তচাপ ১২০/৮০ থেকে ২২০/১৩০ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। রাগান্বিত হলে হার্ট রেট, রক্তচাপ, রক্তনালীর উপর চাপ, রক্তের গ্লুকোজ ও ফ্যাটি এসিড লেভেল ইত্যাদি বেড়ে যায়। কোনো মানুষের রাগ যখন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয় তখন রক্তনালীতে বারবার প্রদাহ হয়ে যায়। প্রদাহপ্রাপ্ত এই রক্তনালীর ভেতরের ওয়ালে দিনে দিনে রিপেয়ার কাজকর্মের কারণে নানা জিনিস জমা হয়ে রক্তনালী চিকন হয়ে যায়। গবেষণা অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপে থাকলে মস্তিষ্কেও প্রদাহ সৃষ্টি হয়। যে কারণে ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও বুকে ব্যথার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়ে। হঠাৎ রাগ চলাকালীন সময়ে এড্রেনাল গ্লান্ড থেকে নির্গত এড্রেনালিন হৃৎপিণ্ডকে দ্রুত স্পন্দিত করে এবং ধমনী ও শিরাগুলোকে সঙ্কুচিত করে, যার ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। রাগের ঘটনা শেষ হয়ে গেলে রক্তচাপ সাধারণত স্বাভাবিক হয়ে যায়। কখনো কখনো ঘন ঘন কিংবা অত্যধিক রাগের সময়ে এনজাইনা পেক্টরিস (বুকে ব্যথা) হয়, কারণ সাময়িক সময়ের জন্য রক্তনালীগুলো সঙ্কুচিত হয় (সরু হয়ে যায়), হৃৎপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস পায়। গবেষকরা দেখেছেন, রাগান্বিত হওয়ার পরপরই দুই ঘণ্টার মধ্যে একজন ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় পাঁচগুণ (৪.৭৫ গুণ) বেড়ে যায় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি তিনগুণ বেশি (৩.৬২ গুণ) বেড়ে যায়।
ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের ওপর রাগের প্রভাব
রাগের কারণে হাত-পা-মুখ-চোখ এবং শরীরের মাংসপেশির কার্যকারিতা বাড়াতে গিয়ে রক্তের প্রবাহ ও মেটাবলিজমও বেড়ে যায়। একই সাথে রক্তের প্রবাহ অন্যান্য ভাইটাল অর্গান যেমন- ব্রেইন, খাদ্যনালী ইত্যাদি প্রয়োজনীয় অর্গানগুলোতে কমে যায়। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, রাগান্বিত মানুষের মুখ শুকিয়ে যায়। খাদ্যনালীতে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে মেটাবলিজম ও হজমে ব্যাঘাত ঘটে। রাগ পাকস্থলীর গাত্রে এসিড সিক্রেশন বাড়িয়ে দেয়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নেগেটিভ আবেগ তথা রাগ, ভয় ও উদ্বিগ্নতার কারণে প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগ (আইবিডি), ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস), গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি), এবং পেপটিক আলসারসহ সব ধরনের পরিপাক সম্পর্কিত উপসর্গ বেড়ে যায়।
লেখক : স্বস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধকার ও কলামিস্ট