ইউএনও আমাকে মুঠোফোনে জানান, আর বালু উত্তোলন হবে না। বালু উত্তোলনকারীদের নামে মামলা হয়েছে। জেনে খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম। অন্তত পারুলিয়ায় তিস্তার বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হলো। স্থানীয় মানুষও অনেক খুশি হন। কিন্তু এর দুই দিন পরই আবার বালু উত্তোলন শুরু। আগে এক মেশিনে বালু উত্তোলন করা হতো, এখন দুই মেশিনে।
আগের মতোই সারা রাত মেশিন চলে। আর সারা দিন বালু সরানো হয়। স্থানীয় মানুষ প্রায়ই বলে থাকেন, এর সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন; যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই। হাতীবান্ধার ইউএনও নাজির হোসেনের কাছে জানতে চাইলাম, বালু উত্তোলন কি বন্ধ হবে না? তিনি বলেন, ‘সিভিল প্রশাসন চেষ্টা করলেও সব পক্ষের সহায়তা না থাকায় বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিধান না থাকায় আমরা নিরুপায়। দিনে বালু তোলা বন্ধ হলেও রাতে বালু তোলা বন্ধ হচ্ছে না।’
বালু উত্তোলনকারী মূল হোতাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সাধারণত, দাপুটে অসৎ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বালু উত্তোলন করে থাকেন। কখনো কখনো থাকে সরকারের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ। এ কারণে বালু উত্তোলনকারীরা থাকেন আড়ালে। তাঁদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারেন না; বরং প্রতিবাদ যাঁরা করেন, তাঁরাই অনিরাপদ হন। জীবন হুমকির মধ্যে পড়লেও তাঁদের সাধারণ ডায়েরি থানা গ্রহণ না কারার নজির আছে।
হাতীবান্ধার পারুলিয়া বাজারের পাশে বালু উত্তোলনের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্ত। উপজেলা প্রশাসন চাইলে মুহূর্তেই জানা সম্ভব কে বালু উত্তোলন করছে। তারা জানে না, এটি হতে পারে না। সেখানে দুটি মামলাও করেছে সরকার। প্রকৃত অপরাধীদের নাম আসামির তালিকায় নেই। বালু উত্তোলন খুবই লাভজনক। এক রাত বালু উত্তোলনের পর সকালে প্রশাসনের ব্যক্তিরা যদি মেশিন আর পাইপ পুড়িয়ে দেয়, তা–ও লাভবান থাকে বালু উত্তোলনকারীরা। ফলে পাইপ-মেশিন সরকার বাজেয়াপ্ত করলেও প্রতিদিন নতুন মেশিনে বালু উত্তোলন করলেও বালুখেকোদের কোনো লোকসান হয় না।
নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করার দায়িত্ব প্রধানত ইউএনওর। এটি আমাদের মতো নদীকর্মীদের কাজ নয়। কিন্তু সারা দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আমাদের ফোন করেন। তখন আমরা ইউএনও কিংবা জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করি। অধিকাংশ সময় বালু উত্তোলন বন্ধ হয়। কখনো কখনো একাধিকবার ফোন করতে হয়। রাজারহাট উপজেলায় আগে চাকিরপশার এবং তিস্তা নদীতে বালু উত্তোলন হতো। বর্তমানে আমার জানামতে, ওই উপজেলার কোথাও অবৈধ বালু উত্তোলন আর হয় না। এ কাজ সম্ভব হয়েছে ইউএনও চেষ্টাতেই।
অবৈজ্ঞানিকভাবে বালু উত্তোলনের ফলাফল সব সময় ভয়াবহ। লালমনিরহাটের শেষ সীমানা সদর উপজেলার গোকুণ্ডা ইউনিয়নে তিস্তা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়েছিল ২০২১ সালে। ওই বছরে ওই এলাকায় ভয়াবহ নদীভাঙন হয়। ফলস্বরূপ কুড়িগ্রামের রাজাহাটে ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নে প্রায় তিন হাজার একর জমি এক বছরেই নদীগর্ভে বিলীন হয়। সঙ্গে দেড় হাজার বাড়িঘর। কে জানে পারুলিয়াবাসীরও এমন দুঃখজনক পরিণতি হয় কি না!
হাতীবান্ধার ইউএনও ব্যর্থ হলেও তাঁর কোনো অসুবিধা নেই। তিনি অন্যত্র বদলি হবেন, পদোন্নতি পাবেন। বালু উত্তোলন বন্ধ না হলেও তাঁকে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। তিস্তায় বালু উত্তোলন রাজারহাট উপজেলা বাদে প্রায় সব কটি উপজেলাতেই আছে।
আমরা নদীটি বাঁচাতে চাই, নদীপারের মানুষকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে চাই। ফলে বালুখেকোদের বুঝিয়ে হোক, আইনি ব্যবস্থা নিয়ে হোক অথবা সামাজিক চাপ তৈরি করে হোক—বালু উত্তোলন বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইউএনওরা নদী রক্ষা করার পরিবর্তে নদী ব্যক্তির নামে লিখে দিতে বেশি আগ্রহী।’ কথাটি সব ইউএনওর ক্ষেত্রে সমান সত্য না হলেও এর সত্যতা আছে বলেই নদীগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না; বরং অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শর্ষের মধ্যেই ভূত থাকলে তা কি তাড়ানো সম্ভব?
- তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক