আগামী ৭ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি ‘একতরফা’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এইভাবে একতরফা নির্বাচন হলে বাংলাদেশ গভীর সংকটে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে এইভাবে ভোটের অধিকার বঞ্চিত করে ধীরে ধীরে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জন আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে এই নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আগামী ৭ই জানুয়ারির এই নির্বাচনে যে ফলাফল আসবে তা এখনই নির্ধারিত হয়ে আছে। অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা কোনোটিই এই নির্বাচনে নেই।
শনিবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘ভোট ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন বক্তারা। লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-সাংবাদিকদের ব্যানারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উন্মুক্ত এই নাগরিক সংলাপে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, নারী নেত্রী শিরিন হক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক সাঈদ খান, অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন লেখক বাকী বিল্লাহ।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে তা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়নি। একটি পরোক্ষ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনগুলো দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে একটি ‘একতরফা’ এবং ২০১৮ সালে আরেকটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন হয়। যার ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। সরকার এখন যা করছে, যেভাবে বর্তমানে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তা সংবিধানের পরিপন্থি। সে হিসেবে এই কমিশনও বেআইনি। আইনসম্মত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সবার এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সবাই কথা বললে এই ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এই সরকারের কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। অতীতের কোনো সরকারের আমলে এইভাবে বিরোধী দলের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়নি। এরশাদ সরকারের আমলে নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে এই আমলে বেশি মানুষ জীবন দিয়েছে।
আবু সাঈদ খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বললে হবে না। চেতনা ধারণ করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক আচরণ করা। এখন সেটি অনুপস্থিত দেখতে পাচ্ছি।
২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটিতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এরপরে ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই টানা ক্ষমতায় আছে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, এই আওয়ামী লীগ সরকার এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতোই আরেকটি ফলাফল নিয়ে আসবে। তাই এই নির্বাচন দেশে এবং বহির্বিশ্বে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচন বলতে যা বুঝায়- অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার কোনোটাই এই নির্বাচনে রয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। আরেকটি একতরফা নির্বাচন দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলবে। পাকিস্তান আমলে যে ২২ পরিবারের কথা বলা হয়েছিল, এখন তেমনই আরেকটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে।
শিরিন হক বলেন, ২০১৮ সালে নির্বাচনে একটি দলের প্রতীকে (ধানর শীষে) ভোট দেয়ার জন্য এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। সেই ঘটনার এখন পর্যন্ত বিচার পাওয়া যায়নি। দেশের রাজনীতি নিয়ে নানা রকম পরিস্থিতি আমাদের দেখতে হয়। কিন্তু একজন নারীর প্রতি যে ধরনের সহিংসতা ঘটে তা সামনে আসে না। ২০১৮ নির্বাচনের পরে সুবর্ণচরের ঘটনার বিচার না করে আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের কোনো নৈতিক কিংবা কোনো ধরনের সাপোর্ট থাকার কথা নয়।
এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন প্রগতি লেখক সংঘের সহ-সভাপতি শামসুজ্জামান হীরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আল রাজী, সংগঠক সীমা দত্ত, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার লিপি ও শিল্পী এএইচ চঞ্চল।