বিমসটেকের খচখচানি রোহিঙ্গা

প্রথম আলো

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:১০
আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯,

দিন যত এগোচ্ছে, সংশয় ততই দানা বাঁধছে। এতটাই যে একেবারে সরাসরি আশঙ্কাটা প্রকাশও পেল। কেউ কেউ স্পষ্টই বললেন, নিকট ভবিষ্যতে জটিল এই সমস্যার সমাধান না হলে ‘বিমসটেক’-এর দশাও ‘সার্ক’-এর মতো হয়ে উঠতে পারে। সমস্যাটা রোহিঙ্গাদের নিয়ে, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্ককে ক্রমেই তলানিতে ঠেলে দিচ্ছে।

কলকাতায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো বিমসটেকের ভালো-মন্দ, অগ্রগতি বা গতি-মন্থরতা, সম্ভাবনা, সাফল্য ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত দুদিনের এক আন্তর্জাতিক আলোচনা সভা ‘কলকাতা কলোকিয়াম’। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) উদ্যোগে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় বিমসটেকের সাত সদস্য দেশের চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন এই গোষ্ঠীর সেক্রেটারি জেনারেল শহীদুল ইসলাম। বাংলাদেশের এই সাবেক কূটনীতিক এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই বিভিন্ন বক্তা বললেন, এমনিতে নানান কারণে বিমসটেক গতি মন্থরতায় ভুগছে। সেই সব বাধা কাটিয়ে ওঠা গেলেও রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেভাবে বিষিয়ে তুলেছে, তাতে সাত দেশের এই গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎও সার্কের মতো হয়ে যেতে পারে। অথচ ইদানীং বিমসটেকে কিছুটা গতি সঞ্চারের অন্যতম প্রধান কারণও কিন্তু ওই সার্ক।

সার্কের পথচলা শুরু ১৯৮৫ সাল থেকে। তুলনায় বিমসটেক নবীন। ১৯৯৭ সালে এই গোষ্ঠীর জন্ম। সত্তর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রথম যখন সার্কের ভাবনা প্রকাশ করেন, ভারত তখন ছিল যথেষ্ট সন্দিহান। সেই সময় ভারত মনে করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের ছোট দেশগুলো এক জোট হতে চাইছে। পাশাপাশি এ কথাও ভারত মনে করেছিল, সার্ক হলো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক ষড়যন্ত্র। ভারতের সেই ধারণা কাটতে খানিকটা সময় লেগেছিল। ফলে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় সার্কের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। সেই থেকে ১৮ বার সদস্যদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সম্মেলন যেমন হয়েছে, তেমনই রাজনৈতিক কারণে শীর্ষ সম্মেলন বাতিল অথবা স্থগিত হয়েছে ১১ বার। শেষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে, কাঠমান্ডুতে। দুই বছর পর ২০১৬ সালে ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদে। কিন্তু ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলার দরুন সেই থেকে সার্ক জীবন্মৃত।

সার্কের অকার্যকর হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্রমাবনতি। অথচ বিমসটেকে গতি সঞ্চারে সেটাই বড় কারণ। ২০১৬ সালে ভারতের গোয়ায় ‘ব্রিকস’–এর আসরে বিমসটেক নেতাদের ‘রিট্রিট’-এর আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভারত সেই তাগিদটা অন্য সদস্যদেশের কাছে তুলে ধরে। তত দিন পর্যন্ত এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বদানের বিষয়টি প্রায় অবহেলিতই ছিল। একদিকে নেতৃত্বহীনতা, অন্যদিকে অর্থসংকট বিমসটেককে সেভাবে প্রাসঙ্গিক হতে দেয়নি। ২০০৪ সালে এই সাত দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক হলেও আজও তা রূপায়ণ করা যায়নি। গত ২২ বছরে শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে মাত্র চারবার। বাংলাদেশে সচিবালয় চালু হয়েছে। কিন্তু আর যা যা করলে বিমসটেক অন্য আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সমতুল্য ও অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে, সেসব অধরাই থেকে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে বিমসটেকের ইতিকর্তব্য কী হতে পারে বা হওয়া উচিত, তা খোলামেলা আলোচিত হয় কলকাতা কলোকিয়ামে। এবং সেখানেই উঠে আসে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ, স্থায়ী ও অর্থবহ প্রত্যাবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পর্কের উন্নতিও সম্ভব নয়। দিনের আলোর মতো এই বিষয়টি এত দিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সম্মেলনে এই পরিসংখ্যানও পেশ হলো যে গত বছর একজনও বাংলাদেশি মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন জানাননি। বাংলাদেশ থেকে যোগ দেওয়া প্রতিনিধিরা তো বটেই, তৃতীয় দেশের বিশেষজ্ঞদেরও কেউ কেউ এই আশঙ্কা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে চীন ও ভারতের ভূমিকাও। সেক্রেটারি জেনারেল শহীদুল ইসলাম জানান, সদস্যদেশগুলো চাইলে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বিমসটেক বিষয়টির সমাধানে উদ্যোগী হতে পারে। কিন্তু তা নিতান্তই কথার কথা। কেননা, সদস্যদেশ মিয়ানমার কিছুতেই তা হতে দেবে না। মিয়ানমার থেকে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা স্পষ্টতই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সরাসরি জানিয়েছেন, বহুপক্ষীয় সংগঠনে দ্বিপক্ষীয় বিষয় আলোচনা করা যায় না।

এই আবহে সমষ্টিগতভাবে বিমসটেক তা হলে কী কী করতে পারে? সম্ভাবনার সেই ফিরিস্তি বেশ লম্বা। কিন্তু বড় প্রয়োজন হিসেবে যে বিষয়টি এই সম্মেলনে উঠে এল, তা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা। সেক্রেটারি জেনারেল শহীদুল ইসলাম নিজেই জানালেন, সাত সদস্যদেশের উচিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ঘিরে এই গোষ্ঠীর সদস্যদেশগুলোর উপস্থিতি। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ছাড়া বাকি দুই দেশ নেপাল ও ভুটান। এই উপসাগর এখন বছরে সাত-আটটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দিচ্ছে। শুধু ঘূর্ণিঝড়ই নয়, ঝাপটা মারছে সুনামি ও ভূমিকম্পও। চরাচর ভাসিয়ে বিপর্যয় ডেকে আনছে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই। হওয়ারই কথা। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, সুনামি বা ভূমিকম্প ভৌগোলিক সীমারেখার তোয়াক্কা করে না! শহীদুল ইসলাম তাই স্পষ্ট করেই বলেন, এই ধরনের বিপর্যয়ের মোকাবিলায় সব সদস্যদেশের এক জোট হওয়া দরকার। গড়ে তোলা দরকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার একটা সর্বদেশীয় কাঠামো।

সম্মেলনের শুরুতেই যে সুর সেক্রেটারি জেনারেল বেঁধে দেন, তারই রেশ ধরে চলে আসে সুন্দরবন রক্ষার প্রসঙ্গ। ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা সামলে সুন্দরবন বারবার কলকাতা ও ঢাকাকে রক্ষা করছে। বিস্তীর্ণ এই এলাকার বাদাবন বিলোপ পেলে বাংলাদেশ ও ভারতের লাখ-কোটি মানুষও শেষ হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা তথ্য দেখিয়ে বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে ঘূর্ণিঝড়ে ইদানীং প্রাণহানির ঘটনা হয়তো কমছে। কিন্তু ঝড়ের গতিবেগ ও জলোচ্ছ্বাসে শস্য, জমি ও প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়ে চলেছে, তা অপূরণীয়।

সম্মেলনে বড় হয়ে ওঠে ভিসা প্রসঙ্গও। অবিশ্বাস, সন্দেহ ও আশঙ্কা ভিসাসংক্রান্ত কড়াকড়ির প্রধান কারণ। সেই বাতাবরণে তা হলে যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্য-উন্নয়নে কোন উপকারটা বয়ে আনবে? ভিসা নীতি শিথিল না হলে, পর্যটনকে গুরুত্ব দেওয়া না হলে অবিশ্বাস ও সন্দেহের আবহে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়তে পারে না। মানুষকে ছাড়া-ছাড়া বেঁচে থাকতে হবে। সংহতি থাকবে মরীচিকার মতো।

সম্ভাবনার প্রাচুর্যের পাশাপাশি বিমসটেকের অস্বস্তিকর খচখচানি হয়ে জেগে রইল রোহিঙ্গা সমস্যা। সুড়ঙ্গ শেষে আলোর ফুটকি এখনো দৃশ্যমান নয়।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি