স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১: বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কতটা এসেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা?

স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১: বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কতটা এসেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা?

  • ২৬ মার্চ ২০১৯
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionসাংবাদিকেরা অনেক বাধার মুখে পড়লেও বিভিন্নভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেছেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখন তুমুল অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ঢাকার রাজপথ। সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে উঠে আরও উত্তেজনাপূর্ণ।

এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় এলেন সে সময়ের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ১৬ই মার্চ থেকে শুরু হলো মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক।

আলোচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি না হলেও ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হলো সামরিক অভিযান-বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ও রাজারবাগে পুলিশ লাইনে।

এর মধ্যেই ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আটক হন শেখ মুজিবুর রহমান।

কিন্তু আটকের আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি।

১০ই এপ্রিল মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “…. বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান..”।

২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আটকের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি তারবার্তা পাঠান।

১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ডে শেখ মুজিবের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫শে মার্চে মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি। যা তৎকালীন ইপিআর- এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭শে মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “বাংলাদেশের একটাই মানুষের ঘোষণার অধিকার ছিলো, আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা নিয়ে যে বিতর্ক আসতে পারে সেটাই তো কেউ কখনো চিন্তা করেনি।”

বাংলাদেশের নামকরণ করা হয়েছে যেভাবে

৭ই মার্চের ভাষণ: যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন শেখ মুজিব

মানুষের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল বিপ্লবের, প্রতিরোধের’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো মুক্তিযুদ্ধ কেন বড় ফ্যাক্টর?

ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক কেন ব্যর্থ হয়েছিলো?

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান
Image captionবাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস (আ.ফ.ম সাঈদ)’ বইতে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই সংকলন অনুযায়ী বিবিসির খবরে তখন বলা হয়েছে, “…..কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।…”

ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছিলো: “….ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন…”।

দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিলো: “বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।”

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন: ২৭শে মার্চ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্টশিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।

দি গার্ডিয়ান: গার্ডিয়ানের ২৭শে মার্চ সংখ্যায় এক খবরে বলা হয়, “…২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দি ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।”

এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।

আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭শে মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, “বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।”

শেখ মুজিবুর রহমান
Image caption৭ই মার্চের এই ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়েছিলো। পাশেই বলা হয়েছে ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিব আটক’।

বার্তা সংস্থা এপির একটি খবরে বলা হয়, “ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।”

আয়ারল্যান্ডের দি আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিলো – পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিলো শেখ মুজিবের ছবি।

দিল্লি থেকে রয়টার্সের খবরে ১০ হাজার মানুষের নিহত হবার ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে, এমন কথা বলা হয়।

ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”