কারা জিম্মি করেছে পরিবহন খাত

রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৯

কারা জিম্মি করেছে পরিবহন খাত

সাঈদুর রহমান রিমনকারা জিম্মি করেছে পরিবহন খাত

বাস্তবায়নের আগেই দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল নতুন সড়ক পরিবহন আইনের শিথিলতা নিয়ে আবারও আলোচনায় পরিবহন খাত। সারা দেশে অঘোষিত গণপরিবহন ধর্মঘটে যাত্রী জিম্মি করার মাধ্যমে আইন অমান্যের সংস্কৃতি বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন পরিবহন খাতের নেতারা। খেঁাঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ও বিরোধী দলের পঞ্চপা-বের কাছে এখন জিম্মি দেশের সড়ক পরিবহন খাত। তাদের যাত্রীস্বার্থবিরোধী সংঘবদ্ধ তৎপরতার কারণে পরিবহন খাতের কোনো আইনই কার্যকর করা যাচ্ছে না। এমনকি কোনো নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করছেন না তারা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে ভূমিকা রাখার কারণে তাদের হুমকি ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনও। সড়ক পরিবহন খাতের এই পঞ্চপা ব হলেন- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান। তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী। মসিউর রহমান রাঙ্গা। সারা দেশের বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কিত। শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্মসম্পাদক এবং পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতা। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী। শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের নামে শীর্ষ এই পাঁচ নেতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে পরিবহন খাত। তাদের সহযোগী হিসেবে সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা সড়ক অকার্যকরে ভূমিকা রাখছেন। সূত্র জানান, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দেশের সড়ক পরিবহন খাতে তৎপর মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মূলত চাঁদাবাজির কারণেই সংগঠিত। যানবাহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় ছাড়া মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের আর কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা চোখে পড়ে না। এ অবৈধ চাঁদার স্বার্থের সংঘাতে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থানে সমিতিতে সমিতিতে কিংবা ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধ, পরিবহন ধর্মঘট, রুট দখল-পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটছে। এক জেলার বাস যেতে পারে না অন্য জেলার ওপর দিয়ে। সড়ক, মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে বেহাল অবস্থা বাস-ট্রাক মালিকদের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মালিক সমিতি কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নগুলো তেমন কোনো ভূমিকাই রাখে না। তারা মূলত পরিবহন খাতের অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং চাঁদাবাজির বিস্তারে ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি নতুন সড়ক পরিবহন আইনের বিরোধিতা করে তারা জেলায় জেলায় শ্রমিকদের মাঠে নামিয়েছেন। শ্রমিক আন্দোলনে গতকালও ঠাকুরগাঁওসহ কয়েকটি জেলায় বাস চলেনি। টানা সাত দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল নওগাঁয় বাস চালু হয়েছে। জানা গেছে, সারা দেশে বাস ও ট্রাক পরিবহন খাতে মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন মিলিয়ে ৫ শতাধিক সক্রিয় সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনভুক্ত সংগঠনের সংখ্যা ২০৩। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি ৭০ ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সদস্য সংখ্যা রুট কমিটি ও মালিক সমিতি মিলিয়ে ১৪৪। বাকি সংগঠনগুলো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান সমিতি এসব আঞ্চলিক ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করে। সূত্র জানান, এসব ইউনিট কমিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিকে এককালীন মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। যাত্রী জিম্মি করে গত সপ্তাহের পরিবহন ধর্মঘটের ব্যাপারে মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশন দায় না নিলেও তাদেরই প্রত্যক্ষ ইন্ধনে সারা দেশে বাস বন্ধ ছিল বলে জানা গেছে। শ্রমিক ইউনিয়নের নামে এসব মালিক ও শ্রমিক নেতার পূর্ণ সমর্থন ছিল। সংশোধনের নামে নতুন সড়ক পরিবহন আইন রুখে দেওয়ার চেষ্টায় কোনো কোনো জেলায় সপ্তাহ ধরে পরিবহন ধর্মঘট চলেছে। পরিবহন খাতের পঞ্চপা বের মধ্যে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তিনি একদিকে শ্রমিকনেতা, অন্যদিকে পারিবারিকভাবে পরিবহন কোম্পানির মালিক। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতা শ্রমিক ফেডারেশনের হয়ে পরিবহনে চাঁদা নির্ধারণ করে দেন। আবার তিনিই সরকারের সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যার মূল কাজ এ খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স আর দুর্ঘটনার পর জব্দ করা গাড়ি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার দাবি নিয়েও তিনিই আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বেই মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় পরিবহন খাতে। ফেডারেশন নেতা শিমুল বিশ্বাস, ওসমান আলীদের নিয়ে তিনি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুই দিন ধরে বর্ধিত সভা করেছেন। এতে সিদ্ধান্ত হয়, নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করা না হলে শ্রমিকরা গাড়ি চালাবেন না। সেই দাবি নিয়ে গতকাল রাতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় বৈঠক করেছেন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা প্রকৃত পরিবহন ব্যবসায়ী নন। তিনি প্রধানত রাজনীতিক। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। মালিক সমিতির এই শীর্ষ নেতার ‘সঞ্চিতা’ পরিবহন নামে চারটি মাত্র বাস রয়েছে। এগুলো রংপুরের অভ্যন্তরীণ রুটে চলে। পরিবহন খাতের বহুল আলোচিত নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কয়েক বছর ধরে সড়ক পরিবহনের সামগ্রিক তৎপরতার নিয়ামক বলে বিভিন্ন সূত্র জানান। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলেই সমান তৎপর তিনি। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে পরিবহন সেক্টরের কর্তৃত্ব চলে যায় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের হাতে। এ সময় মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বাধীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। পরে মির্জা আব্বাসের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হলে খন্দকার এনায়েতের বাস ময়মনসিংহে নিয়ে আটকে রাখেন মির্জা আব্বাসের লোকজন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তৎকালীন এমপি ও সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আলহাজ মকবুল হোসেনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হন খন্দকার এনায়েত। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে খন্দকার এনায়েত পরিবহন নেতৃত্বের বাইরে থাকলেও ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকেই তিনি নগরীর টার্মিনালগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। কমরেড খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নেতা ওসমান আলীর পরিচিতি মূলত শ্রমিকনেতা। রাজনৈতিক পরিচয় তিনি আড়ালে রাখতে চান। তিনি দায়িত্ব পালন করছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মূল নেতৃত্ব সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।