গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে নির্মম পুলিশি নৃশংসতার শিকার সেই যুবকের কথা মনে আছে? নিরস্ত্র সেই যুবককে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে খুবই কাছ থেকে পুলিশ গুলি করে। দেশ-বিদেশের ভার্চুয়াল জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই নির্মমতার ভিডিও। তবে সে বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে—সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না কেউ। অবশেষে তার হদিস মিলেছে। গুলিবিদ্ধ সেই যুবককে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, চট্টগ্রাম থেকে চিকিত্সা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরা ওই যুবককে বুধবার রাতে পুলিশ কক্সবাজার মডেল থানায় নিয়ে আসে। তবে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, আলোচিত সেই যুবকের নাম নবাব মিয়া। তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ডিকপাড়া গ্রামের সিরাজুল হকের ছেলে। ৩০ বছর বয়সী নবাব মিয়া পেশায় একজন কৃষক এবং এক মেয়ের জনক। তবে জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপি-জামায়াত ভাবাপন্ন।
দীর্ঘ প্রায় এক মাস ধরে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ‘গোপনে’ চিকিত্সা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে মাত্র ৫ দিন আগে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জুমার নামাজের পর ‘আল্লামা সাঈদী মুক্তি পরিষদ’ কক্সবাজার শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও সাধারণ মুসল্লিদের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৪ জন মারা যান। আহত হন আরও অন্তত দু’শতাধিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।
ওইদিনের সংঘর্ষের সময় পুলিশের কিছু সদস্য নবাব মিয়াকে রাস্তা থেকে ধরে বেধড়ক পেটায়। পুলিশের মারধর সহ্য করতে না পেরে তিনি পাশের একটি কক্ষে ঢুকে পড়লে পুলিশের ৩ সদস্য তাকে বেধড়ক পেটায়। এক পর্যায়ে ওই যুবক মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পুলিশের এক সদস্য তার গায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে।
ওইদিনের সংঘর্ষের পর জামায়াতে ইসলামী দাবি করে আসছিল, তাদের কিছু নেতাকর্মীকে পুলিশ গুম করেছে। ক’দিন পর ওই যুবককে পুলিশের গুলি করার সেই আলোচিত ভিডিওচিত্রটি ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগ সাইটে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওচিত্রটি ইন্টারনেটে এত বেশি শেয়ার করা হয়েছে যে, তা দেশে-বিদেশে আলোচনায় চলে আসে। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতেও বিষয়টি আলোচনা হয়। এছাড়াও আপলোড করা ভিডিওচিত্রটি মানুষের মোবাইলে মোবাইলেও ছড়িয়ে পড়ে।
তবে ভিডিওচিত্রটি দেশে-বিদেশে আলোচনায় উঠে এলেও পুলিশ কিংবা জামায়াতে ইসলামী কোনো পক্ষই ওই যুবকের পরিচয়, কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে—তা নিশ্চিত করতে পারছিল না।
পুলিশের দাবি, তারা শুরুতে বিষয়টি নিয়ে নির্লিপ্ত থাকলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেন। আলোচিত সেই যুবককে ঘটনার দীর্ঘ ৩৩ দিন পর ‘জীবিত উদ্ধার’ করা হয়েছে।
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, শহরের হাশেমিয়া মাদরাসা সংলগ্ন প্রধান সড়কে পুলিশের একটি দল দুই যুবককে ধরে মারধর করতে করতে নিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে লাল-নীল চেক শার্ট পরিহিত ২৮-৩০ বছর বয়সী এক যুবক পুলিশের হাত থেকে ছুটে পাশের একটি কক্ষে ঢুকে পড়ে। পুলিশের ৩ সদস্য ওই কক্ষে ঢুকে নিরস্ত্র যুবকটিকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। সে সময় ওই যুবক নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে থাকে এবং বাঁচার আকুতি করেই চলে। কিন্তু নির্মম পুলিশের দলটি যুবকের কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে পেটাতেই থাকে। এক পর্যায়ে যুবকটি মাটিতে পড়ে গেলে এক পুলিশ সদস্য নিজের হাতে থাকা শটগানটি যুবকটির শরীরে ঠেকিয়ে গুলি করে।
ভিডিওচিত্রটির তথ্যানুসারে গুলিবর্ষণকারী ওই পুলিশ সদস্য চরম নির্দয়তা, চরম নৃশংসতা ও অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমনভাবেই উল্টো হাঁটা শুরু করে। পরে ওই পুলিশ সদস্য রাস্তায় বেরিয়ে এসে অন্য পুলিশ সদস্যদের কাছে কাহিনী বর্ণনা করতে থাকে। রাস্তার ওই পুলিশের দলটিতে অন্যদের সঙ্গে কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশের অপারেশন অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহেদ উদ্দিনকেও দেখা যায়।
এই ভিডিওচিত্রটি অজ্ঞাতনামা সূত্র থেকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগসাইটে আপলোড করার পর দ্রুত তা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুততম সময়ে এই ভিডিও ফুটেজটি ফেসবুকেই কয়েক হাজারবার শেয়ার হয়েছে।
কক্সবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, বুধবার সন্ধ্যায় ওই যুবককে ‘জীবিত’ অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। নবাব মিয়া নামের ওই যুবককে পুলিশ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় নিয়ে আসে। ওই সময় সঙ্গে তার মা জহুরা খাতুনসহ বেশ ক’জন নিকটাত্মীয়ও ছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ এবং ইউপি সদস্য ও সদর উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন তাজমহল।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাংবাদিকদের আরও জানান, ফেসবুকে ভিডিওচিত্রটি ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে পুলিশ। পুলিশও ঘটনাটি তদন্ত শুরু করে। ঘটনার দীর্ঘ ৩৩ দিন পর ওই যুবককে পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার সময় নবাব মিয়ার কি অপরাধ ছিল, পুলিশ নবাব মিয়াকে নাগালে পেয়েও আটক না করে কেন মারধর করেছে, মারধরের সময় কি এমন পরিস্থিতি হলো যে ওই যুবককে খুব কাছ থেকে গুলি করা হলো, আর কে বা কারা পুলিশের এই ঘটনা খুব কাছ থেকে ভিডিওচিত্র ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে পুলিশের ইমেজ ক্ষুণ্ন করল, পুলিশের কোন সদস্য নবাব মিয়াকে গুলি করেছে, ভিডিওচিত্র ধারণ করেছে কে, কি উদ্দেশ্যে ভিডিওচিত্রটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে—এমন বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করেছে পুলিশ। গোয়েন্দা সংস্থাও এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।’
নবাব মিয়াকে কাছে পাওয়ার পর এসব অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলবে বলে মনে করছেন তিনি। এদিকে বুধবার রাতে কক্সবাজার মডেল থানায় আলোচিত সেই নবাব মিয়া সাংবাদিকদের জানান, তিনি একজন সাধারণ কৃষক। ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ায় খালার বাসায় বেড়াতে আসেন।
তিনি জানান, পরদিন শুক্রবার তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন রুমালিয়ারছড়া পিটিআই সংলগ্ন জামে মসজিদে। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পড়ে যান দু’দিক থেকে আসা দুটি মিছিলের মাঝখানে। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে তিনি দৌড় দেন।
নবাব মিয়া জানান, ওই সময় তিনি দৌড়ে পিটি স্কুল বাজারের কাছে একটি স্থানে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণ পর ক’জন পুলিশ গিয়ে তাকে গালিগালাজ করতে করতে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে। সে সময় তিনি চিত্কার করে তাদের কাছে ঘটনায় জড়িত নন বলে বাঁচার আকুতি জানান। কিন্তু হঠাত্ করেই এক পুলিশ সদস্য তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। তারপর আর কিছুই মনে নেই নবাব মিয়ার। পরে কে বা কারা তাকে উদ্ধার করে ফুয়াদ আল খতিব হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জরুরি চিকিত্সার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের ন্যাশনাল হাসপাতালে।
নবাব মিয়া বলেন, ‘২৮ দিন চিকিত্সার পর কিছুটা সুস্থ হলে ৪-৫ দিন আগে গ্রামের বাড়ি ফিরে আসি। তবে ভয় ও আতঙ্কে ঘর থেকে বের হইনি।’
তিনি বলেন, পুলিশ তাকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করেছে। তার আশঙ্কা, পুলিশ তাকে আবার পেলে মেরে ফেলতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে নবাব মিয়া বলেন, ‘আমাকে যখন মারধর ও গুলি করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছাড়া আশপাশে অন্য কেউ ছিল না।’
পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী যুবলীগের সদর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন তাজমহল সাংবাদিকদের জানান, নবাব মিয়ার পরিবার রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত। তবে নবাব মিয়া জামায়াতের সঙ্গে জড়িত কিনা তিনি নিশ্চিত নন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, নবাব মিয়ার অবস্থা মারা যাওয়ার মতো গুরুতর ছিল না। একটি মহল পরিকল্পিতভাবে সে মারা গেছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। তাকে জীবিত উদ্ধারের মধ্য দিয়ে সে গুজবের অবসান হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি জানান, নবাব মিয়াকে আটক করা হয়নি। তার মা-বাবার হেফাজতে দেয়া হয়েছে। পুলিশ তার ওপর নজর রাখবে।
Source: Amar Desh