ক্যাডেট কায়সারের রহস্যজনক মৃত্যুর দায় মেরিন একাডেমির
চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমিতে বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। ভেঙে পড়েছে এর প্রশাসনিক কাঠামো। প্রশিক্ষকরা বেশি আয়ের জন্য ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের চেয়ে পোষ্ট সী ফেয়ারারদের আনুসঙ্গিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষ। আর এসবের দায়ভার বহন করছেন ক্যাডেটরা। যাদের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল মেরিন একাডেমির পুকুরে ডুবে সিনিয়র ক্যাডেট মাসুদ কায়সার শুভর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি নানা টালবাহানার পর প্রায় চার মাস মাসের মাথায় গত ১৮ আগস্ট সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ক্যাডেট মাসুদ কায়সার শুভর মৃত্যুকে রহস্যজনক উল্লেখ করে একাডেমির সার্বিক অনিয়ম-অব্যবস্থার জন্য সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়েছে।
নিহত ক্যাডেটের বাবা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে তাঁর পুত্রের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। গত ১০ জুন নৌ পরিবহনমন্ত্রীর কাছে এই আবেদন করে মাসুদ কায়সারের বাবা মো. মাঈনুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলের মৃত্যুর সময় সম্পর্কে মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষ দু’বার দু’রকম সময়ের উল্লেখ করেছে। একাডেমি কর্তৃপক্ষের বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে মাসুদ কায়সার শুভর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুকুরের পানিতে ডুবে ক্যাডেট মাসুদ কায়সারের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় অধিদপ্তর গত ২৯ এপ্রিল নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা (পিওএমএমডি) মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হলেও দীর্ঘ তিন মাস ২১ দিনের মাথায় গত ১৮ আগস্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পংকজ কুমার পাল ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের সহকারী কেমিস্ট ফাওজিয়া রহমান।তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে মহাপরিচালক কমডোর যোবায়ের আহমদ পিটিবিনিউজ২৪.কমকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রধান কেনো এতো দেরিতে প্রতিবেদন জমা দিলেন, সে জন্য তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে। ক্যাডেট মাসুদ কায়সার শুভর মৃত্যুর ব্যাপারে মহাপরিচালক বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন ও কমিটির সুপারিশমালার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে শিগগির নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষ সাঁতার কাটতে গিয়ে একাডেমির পুকুরে ডুবে ক্যাডেট মাসুদ কায়সারের মৃত্যুর কথা বললেও তদন্তে তাদের এ বক্তব্যের সমর্থনে উপযুক্ত (অকাট্য) প্রমাণ মেলেনি। এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, একাডেমি কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে লাশের সুরতহাল রিপোর্টের অমিল, ছয় ফুট গভীর পানিতে পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার একজন সুস্থ-সবল ক্যাডেটের ডুবে মরা, মৃত্যুর আগে তাঁর বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার তাঁর সঙ্গীদের না শোনা, মৃত্যুর পর তাঁর পেটে পানি জমে না থাকাসহ পারিপার্শ্বিক নানা কারণে বিষয়টি রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষায়িত (অধিকতর) তদন্তের ওপর গুরুত্বারোপ করে কমিটি বলেছে, মাসুদ কায়সারের মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেনো, মেরিন একাডেমির শৃঙ্খলা রক্ষায় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অদক্ষতা, দায়িত্বে অবহেলা ও দূরদর্শীতার অভাবেই এই অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে মেরিন একাডেমির বর্তমান বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ক্যাডেট ভর্তি, একডেমি কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অদক্ষতা, শাস্তির নামে জুনিয়র ক্যাডেটদের ওপর সিনিয়র ক্যাডেটদের নির্যাতন, মাত্রারিক্ত শাস্তির কারণে অসুস্থ ক্যাডেটদের মাসাধিককাল হাসপাতালে থাকার মতো বিস্ময়কর পরিস্থিতি, ডিসিপ্লিনারি অফিসারের স্বল্পতা এবং সব বিষয়ে কমান্ড্যান্ট কর্তৃক এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে দায়ী করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাডেট মাসুদ কায়সার শুভর মৃত্যুর জন্য মেরিন একাডেমির কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সরাসরি দায়ী করা না গেলেও সামগ্রিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির একাডেমির কমান্ড্যান্ট পরোক্ষভাবে দায়ী।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ঘটনার দিন ক্যাডেট ডিসিপ্লিন অফিসার (সিডিও) ছুটিতে ছিলেন। সিডিওর স্থলে কর্মরত কর্মকর্তাও অজ্ঞাত কারণে কর্মস্থলের বাইরে ছিলেন। ধারণক্ষমতার বাইরে নিয়োগকৃত ক্যাডেটদের পরিচালনার করার মতো কোনো কর্মকর্তাই সেদিন একাডেমিতে ছিলেন না। সঙ্গত কারণে ক্যাডেটরা থাকতেন বেপরোয়া।
এছাড়া সিনিয়র ক্যাডেট কর্তৃক জুনিয়রদের নির্যাতনের মাত্রাও ছিল অস্বাভাবিক। এক পর্যায়ে ৩৮ জন জুনিয়র ক্যাডেট একসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার নজিরও রয়েছে দেশের একমাত্র এই পাবলিক মেরিন একাডেমিতে। সিনিয়র মহিলা ক্যাডেট দ্বারা জুনিয়র মহিলা ক্যাডেটের পেটে লাথি মারার ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে এই একাডেমি। লাথির আঘাতে গুরুতর অসুস্থ জুনিয়র মহিলা ক্যাডেট শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন একাডেমি।
জানা গেছে, বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০০ জন ক্যাডেটকে প্রশিক্ষণ দেয়ার উপযোগী এই একাডেমিতে নেওয়া হয়েছে ৫০০ ক্যাডেট। মহিলা ক্যাডেটরা আদৌ জাহাজের জন্য উপযোগী কিনা সেটা যাচাই না করে ৪০ জন মহিলা ক্যাডেটের ভাগ্য কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটাও এখন অজানা।
সূত্র মতে, ক্যাডেট মাসুদ কায়সারের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সামনে মৌখিক এবং লিখিতভাবে দেয়া বক্তব্যে একমাত্র কমান্ড্যান্ট ছাড়া অন্যসব প্রশিক্ষক জানিয়েছেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্যাডেটসংখ্যার কারণে লেখাপড়ার মান নি¤œমুখি এবং চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সম্প্রতি একটি এসেসমেন্ট পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, পাসের হার মাত্র ১০ শতাংশ।
এদিকে, মুক্তভবনে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৫ শতাংশ ক্যাডেটকে রাখা হয়েছে পোষ্ট সী হোস্টেলে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত ওই ভবনে কোনো নিরাপত্তা নেই বলে ক্যাডেটদের অভিযোগ।
গত ২৫ জুন আইএমওর সেক্রেটারি জেনারেলের একাডেমি পরিদর্শনকালীন নৌ সচিব নিজেই ক্যাডেটদের করুণ দৃশ্য দেখতে পান। প্যারেডে নোংরা পোশাক ও ক্ষৌরিবিহীন (শেভ না করা) অবস্থায় বহু ক্যাডেটকে পাওয়া যায়। একাডেমিতে প্রশিক্ষক ও ক্যাডেটদের অনুপাত এতোই বেমানান যে, একটি ক্লাসে ৮০ জন ক্যাডেটের প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষকরা হিমশিম খাচ্ছেন।
Source: PTBNews