একটি মৃত্যু, দু’টি দণ্ড এবং প্রতিবেশীর মুড়িঘণ্ট
মিনার রশীদ
ডিসেম্বর মাসে একটি মৃত্যু ও দু’টি মৃত্যুদণ্ড পুরো গোলকটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুটি ঘটেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। আর দণ্ড দু’টির একটি বাংলাদেশে। অপরটি উত্তর কোরিয়ায়। কাকতালীয়ভাবে দু’টি মৃত্যুদণ্ডই আবার প্রায় একই সময় এবং একই দিনে সংঘটিত হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লাকে ‘কসাই অব মিরপুর’ হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। জনৈক মোমেনা বেগমের একক সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে এই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একই (?) মোমেনা বেগমের মুখ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে সংঘটিত একই ঘটনার তিন রকম বর্ণনা সংরক্ষিত রয়েছে তিনটি জায়গায়। একমাত্র এই সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে পাঁচ বিচারপতিও ঐকমত্য পোষণ করতে পারেননি। সব বিবেচনায় এই ‘বেনিফিট অব ডাউট’টি অভিযুক্তের পক্ষে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু কে শোনে কার কথা? আর কে-ই বা বলবে কার কথা ?
গণ-আদালতের স্পিরিট নিয়ে যারা সরকারে বসছেন তারাই গণজাগরণ মঞ্চ খুলে বসেছেন। এই তারাই আবার বিচারপতির চেয়ারে, তারাই প্রসিকিউশন টিমে। জনগণের মনের কথা যারা তুলে ধরবেন আবার একটু ভিন্ন রূপে আবার তারাও একই। ফলে ‘ইনারা আর তিনারা’ মিলে পুরো দেশটিকেই আজব এক চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছেন। এ ধরনের চিড়িয়াখানা কোরীয় উপদ্বীপে আরেকটি রয়েছে যার কথা একটু পরে আলোচনায় আসবে।
জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বাংলা নামের কোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য এ ব্যাপারে কথা বলা নিরাপদ নয়। ওরা কথা বললেই তাদের পেছন দিয়ে আমরাও একটু বলার সাহস পাই। আওয়ামী লীগের মুখপোড়া ও ঘরছাড়া এমপি গোলাম মাওলা রনিসহ অনেকেই এ বিষয় নিয়ে যতটুকু সম্ভব নিরাপদ জায়গা থেকে বলেছেন। তার পরও গালিগালাজের সীমা ছিল না। রনিদের সরকার কাদের মোল্লার শেষ ইচ্ছেটি না রাখলেও রনি নিজে তা রেখেছেন। বিবেকের তাড়না থেকে কাদের মোল্লার শেষ ইচ্ছে হিসেবে তার সেই চিরকুটটি প্রকাশ করে দিয়েছেন। কাদের মোল্লার সেই দু’টি লাইন অনেককেই ধাক্কা দিয়েছে এবং সামনে এ ধাক্কাটি আরো বেশি অনুভূত হবে। কাদের মোল্লার বায়োডাটা ও কসাই কাদেরের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে মনে হয় ‘সামথিং রং সামহোয়ার’।
ইতিহাস আর ভূগোল ভিন্ন হলেও ঘৃণার মানচিত্রটি সব জায়গায় প্রায় একই রকম থেকে যায়। নেলসন ম্যান্ডেলাকেও ইউরোপের কনজারভেটিভ দলগুলো গত শতাব্দীর নব্বই দশক পর্যন্ত বুচার বা কসাই হিসেবে জেনে এসেছে। ছিয়ানব্বই বছর বয়সে মৃত্যুর পরও যে ম্যান্ডেলার জন্য সারা পৃথিবী মাতম করেছে, সেই ম্যান্ডেলার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে খোদ ব্রিটেনের একটি কনজারভেটিভ ছাত্র সংগঠন পোস্টার পর্যন্ত ছাপিয়েছিল। শার্টের কলারে ও টাইয়ে ম্যান্ডেলার মৃত্যুদণ্ডের দাবিসংবলিত ব্যাজ পরে থাকত তরুণ ছাত্রনেতারা। সেই সময় এই ছাত্র সংগঠনের অন্যতম নেতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও যুক্তরাজ্যে হাউজ অব কমন্সের বর্তমান স্পিকার জন বারকাউ। আজ সেই নেলসন ম্যান্ডেলাকে ডেভিড ক্যামেরন তার জীবনের অনুপ্রেরণা বলে জানিয়েছেন।
অন্য দিকে এত দিন যাকে আদরের ও শ্রদ্ধার ফুপা বলে জেনেছেন তাকেই কুকুরের চেয়ে অধম মনে করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন কিম জং উন। মৃত্যুদণ্ডের চার দিন আগেও এই ফুপা মশায় ছিলেন দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। দাদার আদরের জামাই সেই ফুপাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর পরও নিজের ফুপুকে এখনো আগের পদেই বহাল রেখেছেন। ভয়ঙ্কর সার্কাসের দেশ উত্তর কোরিয়া। তাদের এসব গল্প শুনলে রক্ত শীতল হয়ে পড়ে। নিজের সাবেক মেয়ে বন্ধুকেও (সম্ভবত প্রভা কেইস) এই লৌহ বালক কিছু দিন আগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
উত্তর কোরিয়ার নাম শুনে আমরা ভয় পাই; কিন্তু সেই উত্তর কোরিয়া হাওয়া থেকে আমরা খুব বেশি দূরে নই। হানিফ-টুকু-বিচারপতি খায়রুল-নাসিরুদ্দীন ইউসুফ-মুনতাসীর-শাহরিয়ার কবীর-ডা: ইমরান-মিডিয়া-চাপাতিলীগ সবাই মিলে এ দেশকে উত্তর কোরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। এরা সবাই মিলে আজব চেতনার এক ফ্যাক্টরি বসিয়েছে। কাউকে অপছন্দ বা সন্দেহ হলে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই চেতনা মেশিনের চক্ষুশূল যে কেউ এখানে যুদ্ধাপরাধী বা জঙ্গি হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারেন। যে কেউ জামায়াত-শিবির হিসেবে চাপাতিলীগ অথবা গোপালি পুলিশের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়তে পারে। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে বিনা বিচারে মাসের পর মাস আটক করে রাখা হয়েছে। দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হামলা করা হয়েছে। শফিক রেহমানের বাসায় বারবার আক্রমণ করছে। মাত্র কয়েকটি মুখ বন্ধ করতে পারলেই দেশটি উত্তর কোরিয়ার মতো চিড়িয়াদের দেশ হতে সময় লাগবে না।
মাত্র গুটি কয় লাশ পড়া দেখে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বিবেকের তাড়নায় গদি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন প্রতিদিন পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ফেলছে আট-দশটি করে লাশ। তার পরও আমাদের মধ্যে কোনো বিকার দেখা যাচ্ছে না। শেখ হাসিনা আর বশংবদ মিডিয়ার হৃৎপিণ্ড কাঁপে শুধু আগুনে পোড়া মানুষ দেখলে।
এ ধরনের কিছু তুলনা টেনে আক্ষেপ করেছেন কলামিস্ট ও সমাজ চিন্তক এফ আর চৌধুরী। বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমির সাবেক কমান্ড্যান্ট ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় উঁচু পদে চাকরি করে লন্ডনে অবসর জীবনযাপন করছেন। দেশের পতাকা ও সম্মানকে অনেক জায়গায় বয়ে নিয়েছেন। অবসর জীবনে এসেও পুরো অবসর নিতে পারছেন না। নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন দৈনিক নিউ এইজ ও বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায়। পরিবারের সবাই লন্ডনে, তবুও দেশের চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছেন। ফোন ও ই-মেইলে তার ভাবনাগুলো শেয়ার করেন। তার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাই।
Decency, Courtesy, Humility and Humanity নামক একটি কলামে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইয়াহিয়া খান তাকে অর্ডার করেছিলেন, Shoot, kill, terrorise and destroy the so called spirit of Joy Bangla, restore the full authority of the central government of Pakistan কিন্তু সাহেবজাদা ইয়াকুব উত্তর দিয়েছিলেন, আমি আমার সেনাদের নিজের দেশের জনগণের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিতে পারব না। ফলে তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে টিক্কা খানকে বসানো হয়।
সেই দিন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বিবেকের তাড়নায় যে কাজটি করতে পারেননি আজ বিজিবি-র্যাব-পুলিশের মধ্যে টিক্কা খানের প্রেতাত্মারা কোনোরূপ বিবেকের দংশন ব্যতিরেকে সেই কাজই করছে। জনগণের এই সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রামকে জ্ঞানপাপী মিডিয়া তুলে ধরছে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব হিসেবে। মনে হচ্ছে জামায়াত-শিবির মানুষ নয়, এরা কুকুর-বেড়াল। ১৯৭২-৭৫ এ জাসদকে একইভাবে কুকুর-বেড়াল গণ্য করেছিল শাসকেরা। তখন ৩০ হাজার তরুণকে হত্যা করেছিল রক্ষীবাহিনী। সেই জাসদের নেতা এখন এই ভয়ঙ্কর জল্লাদি কাণ্ডের সহযোগী সেজেছে। আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে ভিন্ন মতাবলম্বী সব মিডিয়াকে নিঃশেষ করেছে। দেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করা র্যাবকে এই সরকার রক্ষীবাহিনী বানিয়ে ফেলেছে। এ সরকারের হাতে জাতির সব অর্জন ধ্বংস হয়েছে।
আমাদের আবেগ, ক্ষোভ ও হতাশাকে যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে পরখ করার প্রজ্ঞা বা সামর্থ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে জাতির মোটা মাথা দিয়ে প্রতিবেশী মজা করে মুড়িঘণ্ট রান্না চলেছে। যে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রটোকল ভুলে এক বান্ধবীকে দিয়ে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন, সেই মমতা ব্যানার্জি তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়া হবে না। ওদের তর্জনী ওঠে দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা রক্ষা করতে। আর আমাদের তর্জনী ওঠে জাতির সর্র্বনাশ করতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংবিধান থেকে এক চুল না নড়তে একই ভঙ্গিতে তর্জনী উঁচিয়ে দেখিয়েছিলেন এই মমতার বান্ধবী আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
তিস্তার পানি কিংবা ছিটমহল দিতে না চাইলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে অত্যন্ত আগ্রহভরে এরা এগিয়ে এসেছে। আমাদের একতরফা নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সমঝদার এ প্রতিবেশী। আমাদের দেশের জামায়াতের জন্য তাদের ঘুম আসে না। অথচ দ্বিতীয়বারের মতো তাদের দেশে বিজেপির এককভাবে ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হয়ে গেছে। চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা এমন প্যারালাইজড হয়ে পড়েছি যে বলতে পারি না, ‘দিস ইজ মাই কান্ট্রি, জামায়াত অর নট।’ এটি আমার দেশ। জামায়াত আসবে না কে আসবে এটা আমি দেখব। সেখানে তোমার কী আসে-যায়? বাঘের বাচ্চা, বাঘের বাচ্চা বলে পিঠ চাপড়িয়ে নেওল আর ইঁদুরের বাচ্চা দিয়ে আমরা দেশটি ভরে ফেলেছি।
প্রথম মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতিবেশীর আঙিনায় সরে গেছে আমাদের পাটের কলগুলো। এখন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের পর গার্মেন্ট কারখানাগুলো যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধের পর যাবে আরো কিছু। অর্থাৎ আমাদের এখানে যত মুক্তিযুদ্ধ হবে আমাদের মোটা মাথা দিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে তত মজার মুড়িঘণ্ট রান্না চলবে।
ছোটবেলায় দেখতাম আশ্বিন-কার্তিক মাস এলে রাস্তার কুকুর ও কুকুরনীরা পাগল হয়ে যেত। আমরাও কাপড় দিয়ে এমন কষে গিট্টু দিতাম যাতে এরা আর জীবনেও ছুটতে না পারে। এখন মনে হচ্ছে বিভিন্ন চেতনায় যখন আমরা চেতন হারিয়ে ফেলি, তখন আমাদের প্রতিবেশীও এমন করে কষে গিট্টু লাগায়। বেকায়দায় পড়া প্রাণীদ্বয় ঘণ্টা কয়েক পর এই গিট্টু থেকে বের হতে পারলেও স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পরও আমরা বের হতে পারছি না। বরং আরো নিত্যনতুন গিট্টুতে জড়িয়ে যাচ্ছি।
নিজের দেশকে যতই গিট্টু দিয়ে বাঁধি না কেন অপরকে গিট্টু ছাড়া দেখে প্রশংসা করি। নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতির প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা দেখাতে ওবামা আর ডেভিড ক্যামেরনের দেশকেও ছাড়িয়ে গেছি। আমরা তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছি। যে প্রেসিডেন্ট ঘন ঘন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যান না, তাকেও দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়েছি। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে এ কাজ করা মোটেই উচিত হয়নি। কারণ নেলসন ম্যান্ডেলা যে কাজ করে আজকের নেলসন ম্যান্ডেলা হয়েছেন, তা পুরোপুরি ‘নব্য রাজাকার’দের কাজ। কারণ তিনি এমন ‘ভয়ঙ্কর রাজাকারদের’ ক্ষমা করেছেন যারা তার নিজের সম্প্রদায়ের ওপর শত শত মাসব্যাপী নির্মম রাজাকারি করেছে। দিনের পর দিন হত্যা করেছে, গুম করেছে, নির্বাসনে পাঠিয়েছে, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছে। নি¤œপর্যায়ের একজন পুলিশ অফিসারও ছয় মাসের জন্য যে কাউকে জেলে পাঠিয়ে দিতে পারত। নেলসন ম্যান্ডেলা সেসব নিপীড়িতের একজন, যাকে দীর্ঘ ২৭ বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। এমন ভয়ঙ্কর রাজাকার বা শত্রুদের ক্ষমা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য বর্ণবাদের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আহত ও বিভক্ত এমন একটি জাতিকে অতীতের সব তিক্ততা ভুলিয়ে সামনে নিয়ে যাওয়া। এই নেলসন ম্যান্ডেলা তার জনগণকে বুঝিয়েছেন এক ঘৃণা অন্য ঘৃণার জন্ম দেয়। অতীতের এক প্রতিশোধ ভবিষ্যতের জন্য আরো এক প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করে। মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এটি হয়ে পড়ে একটা বেদনাদায়ক চক্র। এ চক্রে কোনো দেশ বা জাতি একবার ঢুকে পড়লে তা থেকে বের হতে পারে না। নেলসন ম্যান্ডেলা তার জাতিকে এই সর্বনাশা চক্র থেকেই বের করে এনেছেন।
এ কথা যদি নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলতেন, তবে তাকে নির্ঘাত জামায়াতের মহিলা আমিরের অনুকরণে জামায়াতের দক্ষিণ আফ্রিকার আমির হিসেবে ঘোষণা দিতেন আমাদের মতিয়া আপা কিংবা হাসানুল হক ইনু।
সাউথ আফ্রিকার জনগণের জন্য সত্যিই আফসোস হচ্ছে। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো এক ‘নব্য রাজাকার’-এর জন্ম হয়েছিল। হতভাগা ওই দেশে আমাদের মতো বুদ্ধিজীবী ও চেতনাধারীদের জন্ম হয়নি। তাই যুগ যুগ ধরে অপমান-বঞ্চনার কাহিনী নিয়ে ওখানে কেউ কোনো উপন্যাস, নাটক, সিনেমাও বানাচ্ছে না। ‘কাঁদো সাউথ আফ্রিকান কাঁদো’ বলে কেউ বিলাপ করছে না। মানব ট্র্যাজেডির এত সব উপাদান ওদের ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় গ্রুপ থিয়েটার, আর্ট ফিল্ম ওয়ালাদের কোনো দেখা মিলছে না। ফলে যুগ যুগ ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অনেক বঞ্চনার ইতিহাস মাটিচাপা পড়ে গেছে।
জাপানের লোকজনও সেই একই আবেগ ও চেতনা সঙ্কটে পড়েছে। যে আমেরিকা তাদের দেশে আণবিক বোমা মেরেছে, কিছু দিনের মধ্যেই বেহায়ার মতো সেই আমেরিকার সাথেই বন্ধুত্ব করে তথাকথিত উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে! এ ধরনের আবেগ ও বোধহীন জাতির জন্য সত্যিই করুণা লাগে। হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবসে কিছুক্ষণ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলেও মুখ দিয়ে কোনো কথা এরা উচ্চারণ করে না। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে লাখ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিলেও সেখানকার টিভি চ্যানেলগুলো এখন পর্যন্ত একজন শহীদের সন্তান বা নাতি-নাতনীরও সাক্ষাৎকার নিতে পারেনি। বুকের ভেতর বেদনাকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারলে শত বছর পরও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলা সম্ভব। এরা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো শত শত বিজ্ঞানী সৃষ্টি করতে পেরেছে; কিন্তু আমাদের মতো এমন আবেগসম্পন্ন একজন তারানা হালিমও সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রতিদিন সবার আগে সূর্য উঠলেও এত দিনেও সেখানে একজন জাহানারা ইমাম, ডক্টর জাফর ইকবাল, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবীর বা গণজাগরণ মঞ্চের ডা: ইমরানের উদয় হয়নি। মনের মধ্যে এত বেদনা জমলেও এখনো কেউ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেয়নি।
স্ত্রীর সাবেক স্বামীটি যক্ষ্মায় ভুগছে, ডায়াবেটিস, প্রেসারও রয়েছে। বর্তমান স্বামীর সন্দেহ এই সাবেক স্বামী তার স্ত্রীর ইজ্জতহানি ঘটাতে পারে। সকাল-বিকেল সেই স্বামীকে উদ্দেশ করে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। অন্য দিকে পাশের বাড়ির টগবগে নাগর বেডরুমে ইতোমধ্যেই ঢুকে পড়েছে। বেখেয়াল স্বামী আধা মরা ও দশ গ্যারামের ওপারে থাকা সাবেক স্বামীর দিকেই এখনো সেই তীর-ধনুক-বল্লম তাক করে রেখেছে। এই তীর-ধনুক-বল্লমের অনেক পার্টস (টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা, নাটক, সিনেমা) তৈরি করে দিচ্ছে বেডরুমে অবস্থানরত সেই একই নাগর।
এই স্বামীর মতোই হয়ে পড়েছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমাদের চেতনার বাস্তব রূপটি। এ নাগরের তৈরি করে দেয়া তীর-ধনুক-বল্লমরূপী এসব মিডিয়ার দিকে একটু নজর দেয়া উচিত। তা না হলে যে গুলিটি আমার বুক ঝাঁঝরা করবে তা আমিই তৈরি করে দিচ্ছি।
[email protected]
Source: The Daily Naya Diganta