এখন ১৯৯৬ বা ২০০৬ নয়, এখন ১৯৭০
by Shafiqur Rahman
অক্টোবরের শেষ যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক আলাপ, উপদেশ, বিশ্লেষন ততই বিভিন্নমাত্রায় জমে উঠছে। সৌভাগ্যবশত বছরের প্রথম অর্ধের তুলনায় এখনকার কয়েক মাসে রাজনৈতিক উত্তাপ রাস্তায় সংঘাতের চেয়ে কথার সংঘাতেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ থাকছে। কিন্তু সবার আশংকা যে অচিরেই এই অভাবিত বাগ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে আবার রাস্তার সংঘাতই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাড়াবে। সামনের দিনগুলিতে কি ঘটতে পারে তা অনুমান করার জন্যে বিশ্লেষকরা বার বার সাম্প্রতিক ইতিহাসে একই রকম নির্বাচন-পূর্ব অচলাবস্থাগুলির শরনাপন্ন হচ্ছেন। এটি স্বাভাবিক, কারন বর্তমান বুঝতে হলে ইতিহাসের প্রতি পিছে ফিরে দেখা আবশ্যকীয়।
বর্তমানকে, ২০১৩ এর শেষ অর্ধকে, ইতিহাসের সাথে তুলনা করতে যেয়ে যে বছরগুলির কথা বিশ্লেষকরা বার বার বলছেন, সেসবের মধ্যে ১৯৯৬ আর ২০০৬ কথাই সবচেয়ে বেশী আসছে। ২০১৩ সালের এই সংঘাতমুখর অচলাবস্থার সাথে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ এর অচলাবস্থার অনেক মিল আছে। কিন্তু একটি বিশেষ দিক দিয়ে ২০১৩ সাল ১৯৯৬ এবং ২০০৬ এর থেকে একদম আলাদা হয়ে আছে। অনেকের চোখে ধৃষ্টতাপূর্ন মনে হলেও এখন এটি দাবী করার পক্ষে যৌক্তিকতা রয়েছে যে ২০১৩ সালের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ এর সাধারন নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতির একটি বড়ো সাদৃশ্য আছে।
প্রথমে আসা যাক ২০১৩ এর সাথে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ এর তুলনা প্রসংগে। এটা স্থিরচিন্তার রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে পরিষ্কার যে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ এই দুই সময়টিতেই তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি, আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করে পূন:নির্বাচিত হওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলো। ১৯৯৬ সালের অচলাবস্থার সময়ে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলির তত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ দাবীর বিপরীতে বিএনপি সরকার এখনকার মতোই বার বার সংবিধানের দোহাই তুলতো এবং বলতো যে এককভাবে সংবিধান সংশোধন করার মতো যথেষ্ট সদস্য তাদের নেই। সেই সময়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ প্রায়ই বিরোধীদলকে বয়কট বর্জন করে সংসদে এসে তাদের প্রস্তাবনা দেয়ার জন্যে আহ্বান করতো। কিন্তু সেসময়েও সরকার দল সুষ্পষ্টভাবে এটা ঘোষনা করেনি যে তারা তত্বাবধায়কের দাবী মেনে নিচ্ছে। এখনকার মতোই সরকারী নেতারা একেরজন একেক সময়ে পরষ্পরবিরোধী বিভিন্ন রকম কথা বার্তা বলতো। তাদের এই আচরনে সাধারন জনগনের কাছে এটাই প্রতিভাত হতো যে বিএনপি সরকার একটি পূর্ন নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দিতে আগ্রহী নয়। আবার ২০০৬ সালে তখনকার বিএনপি সরকার তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনকে যথাসম্ভব বিতর্কিত করে পুনরায় নির্বাচনকে একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের দিকে নেয়ার চেষ্টা করেছিলো। বিরোধীদলের তীব্র আপত্তির মুখে সেই বিতর্কিত চেষ্টা বন্ধ না করার ফলাফল হিসেবেই সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ১/১১ এর পরিবর্তন এসেছিলো এবং সেই সময়ে দেশের অধিকাংশ জনগন সম্ভবত সেই হস্তক্ষেপকে স্বাগতই জানিয়েছিলো। এই সবকিছুতেই দেখা যাচ্ছে যে ২০১৩ এর সাথে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ এর পরিস্থিতির অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তাহলে কি কারনে আজকের এই অচলাবস্থাকে ১৯৯৬ এবং ২০০৬ থেকে আলাদা করে ১৯৭০ এর সাথে তুলনা করা যায়?
দুটি বিশেষ জিনিষই এইবছরটিকে ১৯৯৬ ও ২০০৬ এর থেকে পৃথক করেছে। সেগুলি হলো জনমত জরীপ এবং স্থানীয় নির্বাচন। এই ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ এর রাজনীতি ধারাবাহিক বেশ কয়েকটি জনমত জরীপের মাধ্যমে গনতন্ত্রের একটি নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এর আগেও এদেশে জনমত জরীপ হয়েছে, তবে তা খুবই অপ্রতুল সংখ্যায় এবং দীর্ঘ সময় গ্যাপ দিয়ে। এখানে এখন জনমত জরীপের সার্থকতা নিয়ে কথা বাড়ানোর কোন প্রয়োজন দেখি না। এদেশে যারা প্রফেশনাল জরীপগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের অধিকাংশই হয় পরিসংখ্যান ও র্যান্ডম স্যাম্পলিং নিয়ে খুবই স্বল্পজ্ঞানের অধিকারী কিংবা জরীপগুলি তাদের বিশ্বাস ও সমর্থনকে তীব্রভাবে আঘাত করায় বিক্ষুদ্ধ। বিশ্বের প্রতিটি উন্নত গনতন্ত্রে এখন নিয়মিত জনমত জরীপ রাজনৈতিক জীবনের অঙ্গাঙ্গী অংশ। এই কদিন আগেই যে আমেরিকায় রিপাবলিকান পার্টি কংগ্রেসে সরকার বন্ধ ও ডেবট সিলিং নবায়ন আটকে রাখার অচলাবস্থায় করুন পরাজয় বরন করলো তার একমাত্র কারন, রিপাবলিকান সদস্যরা প্রতিদিনের জনমত জরীপে তাদের অবস্থানের কারনে জনসমর্থনে বিপুল ধ্বস চোখের সামনে দেখতে পারছিলো।
এই বছরে বেশ কয়েকটি জনমত জরীপ প্রকাশ পেয়েছে এবং এই সবগুলি জরীপ থেকে একটিই প্রধান বার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী প্রধান প্রতিপক্ষ দলটির পক্ষে বিপুল জনসমর্থন যোগ হয়েছে। একটি বা দুটি জরীপকে অ্যানোমেলি বলে অভিহিত করা গ্রহন করা যেতে পারে কিন্তু ধারাবাহিক অনেকগুলি জরীপকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই বিশেষ করে যখন সবগুলি জরীপ থেকেই একটিই প্রবনতা স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে। এই জরীপগুলি স্পষ্ট করে যে এই সময়ে সুষ্ঠ নির্বাচন হলে প্রধান বিরোধী দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে। এইসব জনমত জরীপে যাদের আস্থা নেই তাদের জন্যে স্বয়ং আওয়ামী লীগ সরকারই সংবিধান সম্মতভাবে, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দুটি বড়ো বড়ো জরীপ পরিচালনা করেছে এই বছরে জুন ও জুলাই মাসে। চার সিটি কর্পোরেশন ও গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফলগুলিও বেসরকারী জনমত জরীপগুলির ফলাফলকে প্রতিফলিত করেছে। ২০১৩ সালের এই সময়ে জনমতের পাল্লা কোন দিকে এই ব্যাপারে দ্বিধা করার কোনো যুক্তিসম্মত কারন নেই। এই জনসমর্থন কেবল বিরোধী দলের দিকে ঝুকে নয়, এটি গত দুইদশকের নির্বাচনী গনতন্ত্রের ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্বভাবে বিএনপির পক্ষে। গাজীপুরের নির্বাচনের অভাবিত ফলাফল জনসমর্থনের এই সাইসমিক শিফটকেই সবার সামনে তুলে ধরেছে। সরকার দল আর বিরোধী দলতো বটেই, দেশের প্রতিটি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের কাছে এই পরিবর্তনটি স্পষ্ট।
জনমতের এই সুস্পষ্ট আভাষই ২০১৩কে পৃথক করেছে ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে। ১৯৯৬ সালে সরকারী দল তত্বাবধায়ক এর অধীনে নির্বাচন নিয়ে শংকিত হলেও জনমত আসলেই কোনদিকে এসম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলো না। আর সাধারন জনগনের তো এসম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিলো না। ১৯৯৬ সালের তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে, বিএনপি পরাজিত হলেও তার ভোটের শতকরা অংশ ৩% বেড়ে ৩৪% হয়েছিলো এবং ১১৬ টি সিট পেয়ে দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আবির্ভুত হয়েছিলো। ২০০৬ সালের অস্থিরতার পরে দুই বছর তত্বাবধায়কের অধীনে কোনো রকম জনমত জরীপ হয় নি। ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে কোন দল কত অংশ ভোট পেতে পারে এটি ছিলো পুরোপুরি অনুমান নির্ভর। অনেকেই মত প্রকাশ করেছিলেন যে বিএনপি ভালো করতেও পারে। কিন্তু পরে নির্বাচনে দেখা যায় বিএনপি’র চরম ভোট বিপর্যয়। ১৯৯৬ আর ২০০৬ এর মতো এই সময়ে ভোটের হিসাব নিয়ে কোনো রকম ধোয়াশা নেই। এখন এটা সবাই জানে যে সুষ্ঠু নির্বাচনে ফলাফল কি হতে পারে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জনমতের এই পরিবর্তনটি সম্পর্কে জানে অন্য সবার চেয়ে বেশী। তাদের এই জ্ঞানটির আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে এখনকার সকল রাজনৈতিক পদক্ষেপ। যেভাবে হোক, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিরোধী দলকে কোনভাবে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট এর অধীনে ক্ষমতা ন্যস্ত করে কমপক্ষে আরো একবছর নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া, চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে জরুরী অবস্থায় সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া, এরকম সবধরনের কথাই শোনা যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মেইনস্ট্রীম সংবাদ মাধ্যমগুলিতে। সরকার যে এই সময়ে জনমতের রায় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ঠেকাতে বদ্ধপরিকর, এটি সকল রাজনীতি অবজার্ভারদের কাছে স্পষ্ট।
এই বিশেষ পরিস্থিতির কারনেই ২০১৩ সালের এই সময়টিকে তুলনীয় করেছে তৎকালীন পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে। সেই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ৭৫% ভোট পেয়ে পুরো পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ১৬০ টি সিট পেয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দাবীদার হয়। কিন্তু সামরিক সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগনের ম্যান্ডেটকে বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্যে অজস্র টালবাহানা করে এবং অবশেষে নেমে আসে ২৫শে মার্চের কালরাত। একটি জাতির স্বাধীনতার আকাংখা, ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্ভাবনা ও একটি নতুন স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়, এই সব ইতিহাসের মহাকাব্যিক ডাইমেনশনের সাথে বর্তমান সময় কোনভাবেই তুলনা করা যায় না কিন্তু এই সময়ে গনতন্ত্রে জনমতের স্পষ্ট রায়কে হাইজ্যাক করার চেষ্টাকে অবশ্যই তুলনা করা যায়।সেই ১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ের সরকারের মতো এখনকার সরকারও জনমতের রায়কে যেকোনভাবে ঠেকিয়ে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার ফল ১৯৭১ এর মতো ভয়ংকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে এই চেষ্টা অব্যহত থাকলে কোন সুখকর পরিনতিও চিন্তা করা দুষ্কর।
আজকের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেশের জনগনের কাছে আরো স্পষ্ট করেছে একটি বিশেষ গোত্রের বুদ্ধিজীবি ও সংষ্কৃতিকর্মীদের মতদার্শিক অবস্থানকে। ‘স্বাধীনতা’র পক্ষের বুদ্ধিজীবি বলে পরিচিত এই গো্ত্রটি এই সময়ে জনগনের গনতান্ত্রিক রায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পুরোপুরি নীরব অথচ তাদের বিরোধী পক্ষ যখন ক্ষমতায় চিলো তখন তত্বাবধায়ক সরকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে তাদের বাক ও কর্মস্পৃহা ছিলো প্রচুর। ‘স্বাধীনতা’র পক্ষের শক্তি হিসেবে তারা দাবীদার হলেও তাদের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা, গনতন্ত্র, অনুপস্থিত। এটা এখন স্পষ্ট যে তাদের কাছে গনতন্ত্র অর্থ কেবলমাত্র নিজ সমর্থিত দলের ক্ষমতায় আরোহনের সুযোগ। জনমতের রায় তাদের মতের বিরুদ্ধে হলে সেটিকে অগ্রাহ্য করার সকল রকম মানসিক প্রস্তুতিই তাদের রয়েছে।
বাংলাদেশের গনতন্ত্রে অনেক বড়ো বড়ো দূর্বলতা রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা হলো গনতান্ত্রিক শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হইনি। বরং গত দুই দশকে একের পর এক সরকার আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গনতান্ত্রিক ভিত্তি দিনে দিনে দূর্বল করে ফেলেছে। এজন্যে, গনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের অনাস্থা দিনে দিনে বেড়েছে। এতোকিছুর পরও আমাদের জনগন একটি সান্তনা পেতো যে পাচ-ছয় বছর পরে কম করে হলেও একটি নুন্যতম গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গনতান্ত্রিক জবাবদিহিতাকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এই গনতন্ত্রের এই মূলভিত্তিকে দূর্বল ও নস্যাৎ করার চেষ্টার সাথে যারাই সমর্থন দিচ্ছে সরবে কিংবা নীরবে, তারা চিরদিনের জন্যে নিজেদেরকে গনতান্ত্রিক বলার অধিকার হারিয়েছে।
Source: Priyo.com