Sheikh Mohammad Fazle Akbar
Immune therapy for hepatitis B
বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর সাফল্য
হেপাটাইটিস–বি চিকিৎসায় নতুন ওষুধ
প্রিন্ট সংস্করণ
| আপডেট: ০২:০১, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৭ |হেপাটাইটিস-বি চিকিৎসায় নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করেছেন জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। কার্যকারিতা প্রমাণিত হওয়ার পর এই ওষুধ এখন কিউবাতে ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে আইনি জটিলতায় বাংলাদেশে ওষুধটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
জাপানের তোশিবা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল সায়েন্সেস বিভাগের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ‘নাসভ্যাক’ নামের এই ওষুধ উদ্ভাবন করেছেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু মানুষের ওপরও ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (পরীক্ষামূলক ব্যবহার) হয়েছে। দেশে এ কাজে প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষায় দেখা গেছে ‘নাসভ্যাক’ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
মামুন আল মাহতাব বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের সফলতার পর ২০১২ সালে একই হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। এই পর্যায়ে দীর্ঘদিন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫১ জন রোগীকে নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এই রোগের চিকিৎসায় বাজারে প্রচলিত অন্য ওষুধের সঙ্গে এর কার্যকারিতা তুলনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, নতুন ওষুধ বেশি কার্যকর। এই ওষুধ বেশি দিন ধরে কাজে দেয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিএসএমএমইউয়ের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের ৫ শতাংশের বেশি মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আছে। এদের মধ্যে ২০ শতাংশের শরীরে এই ভাইরাস সক্রিয় থাকে। এই ভাইরাসের কারণে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার হয়।
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল কিউবা সরকারের কিউবান ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিরীক্ষার পর ওষুধটিকে সদন (গুড ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস) দিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে কিউবা সরকার ওষুধটি ব্যবস্থাপত্রে লেখার অনুমোদন দিয়েছে। ওষুধটি এখন সে দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
‘নাসভ্যাক’ উদ্ভাবনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র বাছার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন একটি বিষয়ের ব্যাপারে লেগে থাকার ফলে এই উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। এই ওষুধ ইতিমধ্যে কিউবাতে ব্যবহার শুরু হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ ওষুধ তৈরির সঙ্গে জড়িত।
সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও নতুন এই ওষুধকে যুগান্তকারী বলে বর্ণনা করেছেন। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সালাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধ্যাপক ফজলে আকবর সার্ফেস (কোষের বাইরের) ও কোর (কোষের ভেতরের) অ্যান্টিজেন (রাসায়নিক পদার্থ যার উপস্থিতিতে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়) একত্র করে ওষুধটি উদ্ভাবন করেছেন। এই উদ্ভাবন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের জন্য বড় ঘটনা। ওষুধ উদ্ভাবনে তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের নাম সচরাচর শোনা যায় না।’
সরকার প্রস্তাবিত ‘বঙ্গমাতা ন্যাশনাল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার’-এর রূপরেখা তৈরির কাজে প্রধান পরামর্শক হিসেবে শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। গত ২৬ জানুয়ারি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি জাপানে, ১৯৮৭ সালে। উদ্ভাবিত ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় জাপান ও কিউবাতে ইঁদুরের ওপর। আমার কনসেপ্ট বা ধারণা এ রকম ছিল যে, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে হবে, যেন ভাইরাস নির্মূল হয়, আর নির্মূল না হলেও যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ক্ষেত্রে নাসভ্যাক সফল প্রমাণিত হয়েছে।’
এই ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে করার দরকার হলো কেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ফজলে আকবর বলেন, ‘হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত অথচ কোনো ওষুধ ব্যবহার করেনি এমন মানুষ জাপানে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ ট্রায়ালের জন্য এমন রোগী দরকার ছিল। তখনই বাংলাদেশে মামুন আল মাহতাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং রোগী পেয়ে যাই।’
শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ও মামুন আল মাহতাব জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে নতুন এই ওষুধ নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, চীন, তাইওয়ান, হংকং, ফিলিপাইন, ভারত ও থাইল্যান্ডে মাল্টি-সেন্টার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। একটি ফরাসি ওষুধ কোম্পানি ইউরোপের বাজারের জন্য এই ওষুধের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য গবেষকেরা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়েছিলেন। বিএসএমএমইউয়ের ইথিক্যাল কমিটির নীতিগত অনুমোদনও তাঁদের আছে। এ ছাড়া ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য কিউবা থেকে ওষুধ আমদানির অনাপত্তি সনদ দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, কিউবা থেকে ওষুধ এনে ২০১০ সালে ঢাকার সোহবানবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১৮ জন রোগীর ওপর প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়। এই ট্রায়ালের প্রথম পর্যায়ে ওষুধ নিরাপদ ও কার্যকর কি না, তা দেখা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা হয় এই ওষুধ কীভাবে মানুষের শরীরে কাজ করে। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ হিসেবে হেপাটোলজি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
ওষুধের স্বত্ব এখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কিউবার কিউবান সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির। তারাই এখন এই ওষুধ তৈরি করছে। ফজলে আকবর বলেন, ‘নতুন ওষুধ নিয়ে দুবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে সভা করেছেন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যমান আইনে এই ওষুধ বাংলাদেশে ব্যবহারের সুযোগ নেই।’
এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সালাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএফডিএ বা যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ বা যুক্তরাজ্যের বিএনএফের নিবন্ধন পাওয়া ওষুধই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া যেসব ওষুধ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া—এই সাতটি দেশের যেকোনো একটিতে ব্যবহারের অনুমতি পায়, সেসব ওষুধকেও বাংলাদেশে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। নতুন ওষুধটির এই ধরনের অনুমোদন নেই।