Moulana Bhasani and today’s Bangladesh

Ershad Mojumder

মওলানা ভাসানী ও আজকের বাংলাদেশ

Edi_Moulana-Vashani_2

উনিশশ’ উনসত্তর সালে সরকারি আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম পাকিস্তান সফরে। আমার সঙ্গে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের আরও কয়েকজন সাংবাদিক। সম্ভবত মুলতানের একজন সাংবাদিক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিবের মধ্যে ফারাক কী? তখন আমার বয়স ঊনত্রিশ। পুরো ছাত্র জীবনে আমি ছিলাম মওলানা সাহেবের একজন ভক্ত। মওলানা সাহেবের কাছেই আমি প্রথম হজরত আবু জর গিফারীর (রা.) নাম শুনতে পাই। মওলানা সাহেব হজরত গিফারীর একজন অনুসারী ছিলেন। কথা উঠলেই মওলানা সাহেব হজরত গিফারীর (রা.) নাম বলতেন। রাজধানীতে আবু জর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মওলানা সাহেবের পরামর্শ ও সমর্থনে। প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান আজরফ সাহেব ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। মওলানা সাহেব ইসলামের বিপ্লবী চেতনার অনুসারী ছিলেন।
মুলতানের ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, মওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল-কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে পাকিস্তানের ধনী বাইশ পরিবার। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, তাহলে মওলানা সাহেব কমিউনিস্ট পার্টি করেন না কেন? আমার উত্তর ছিল—মওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তিনি খোদা, খোদার কালাম আল কোরআন ও বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত আল্লাহ পাকের রাসুল হজরত মোহাম্মদকে (সা.) বিশ্বাস করেন। ১৯৬৪ সালে গণচীন থেকে ফিরে এসে মওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তার দল ন্যাপের কমিউনিস্ট সদস্যরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। গণচীন থেকে মওলানা সাহেব সরাসরি চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নেমেছিলেন। তখন আমি তার একটি বড় সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম, যা সংবাদে ছাপা হয়েছিল। আমি ’৬২ থেকে ’৬৪ সালের শেষ নাগাদ সংবাদে চাকরি করেছি। ওই সময়েই বাম রাজনীতির ধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সংবাদ বা রাশিয়া মওলানা সাহেবের চীন সফরকে ভালো চোখে দেখেনি। ফলে বাম রাজনৈতিক দলগুলো চীনপন্থী ও রুশপন্থী হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-রাশিয়া সমর্থন করেছে। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওপর ভারত-রাশিয়ার প্রভাব সীমাহীনভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে রুশপন্থী দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবিদের দাপট বা প্রভাব বঙ্গবন্ধুকে সরকার পরিচালনায় বিব্রত করে তোলে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন বি টিম হিসেবে না থেকে সাইন বোর্ড তুলে চলে আসুন। এক সময় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমরা বঙ্গবন্ধু টাইটেল প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। মতিয়া চৌধুরী, মেনন, ইনু, নাহিদ সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হাসিনার পতাকার ছায়ায় একত্রিত হয়েছেন।
ভারতের অনুরোধ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু চুয়াত্তর সালে পাকিস্তানের লাহোর গিয়েছিলেন ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।’ বাঙালি হওয়ার জন্য তিনি কখনোই ইসলাম ত্যাগে রাজি হননি। ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেখলেন, সরকারের কোনো স্বাধীনতা নেই, সব ব্যাপারেই ভারত নাক গলায়। লাহোর যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে খুবই বিচলিত দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে লাহোর নেয়ার জন্য আলজিরিয়ার বিশেষ বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছে। ওআইসির দুই জন নেতা ইয়াসির আরাফাত ও বেন বেল্লা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর আমলেই বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করেছে। কিন্তু তার কন্যা হলে হয়তো যেতেন না। যেমন শেখ হাসিনা মুসলিম দেশগুলোর জোট ডি৮ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কাদের খুশি করার জন্য না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা দেশের মানুষ ভালো করেই জানে। ’৬২ সালে মওলানা সাহেব চীন গিয়েছিলেন সরকারের অনুরোধে। জেনারেল আইউব মওলানা সাহেবের কাছে ওয়াদা করেছিলেন চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে সব রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। ওই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানের সব বামপন্থী নেতা মুক্তিলাভ করেন। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা পলাতক ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে জারি করা হুলিয়া তুলে নেয়া হলো। ’৫৮ থেকে ’৬২ সাল নাগাদ মওলানা সাহেব ধানমন্ডির একটি বাড়িতে নজরবন্দি ছিলেন। মওলানা সাহেবের উদ্যোগেই চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বাংলাদেশ হওয়ার পরও অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুর আমলে সম্পর্কটা একটু শীতল ছিল ভারত ও রাশিয়ার চাপের কারণে। জিয়ার আমল থেকে এ সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে। ’৭১ সালে গণচীন পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থন করেছিল এবং বিবৃতি দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীনের বক্তব্য ছিল, যতদিন বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশি সৈন্য থাকবে ততদিন বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ নয়।
’৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য বঙ্গবন্ধু মওলানা সাহেবের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মওলানা সাহেব ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানালেন। তার সাপ্তাহিক পত্রিকা হক কথার মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেন। মওলানা সাহেব ছিলেন শেখ সাহেবের পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব। ’৭৪ সালে শেখ সাহেব যখন সন্তোষে, তখন প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক রশীদ তালুকদার একটি ঐতিহাসিক ছবি তুলেছিলেন, যা ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ছবি। ছবিটি ছিল একটি আবেগঘন মুহূর্তের। শেখ সাহেব মওলানা সাহেবের বুকের ভেতর মাথা লুকিয়ে রেখেছিলেন। মওলানা সাহেব মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। ঠিক ওই সময়ে খবর আসে শেখ সাহেবের পিতা অসুস্থ। মওলানা সাহেব বললেন, তুমি এখনই হেলিকপ্টারে করে তোমার বাবাকে দেখতে যাও। অন্য সব প্রোগ্রাম বাতিল করো। শেখ সাহেব তখনি গোপালগঞ্জ রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতায় শেখ সাহেব সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাগরেদ থাকলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর মওলানা সাহেবের নেতৃত্বেই রাজনীতি শুরু করেন। ’৪৯ সালে মওলানা সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ সাহেব নতুন দলের যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। আসলে শেখ সাহেবই ছিলেন প্রধান সংগঠক। ’৫৪ সালের নির্বাচনের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল প্রধান দল। তার সঙ্গে শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টিসহ আরও বহু ইসলামিক ছোটখাটো দল ছিল। শেখ সাহেব সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করতেন এটা ঠিক। কিন্তু টার্গেট ছিল ক্ষমতায় যাওয়া এবং তার মাধ্যমেই জনগণের খেদমত করা। মওলানা সাহেব ছিলেন তার উল্টো। তার কাছে লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল শুধুই জনগণের খেদমত করা এবং জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলা। আসামে থাকতেও তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। স্যার সাদুল্লাহ ছিলেন তারই দলের প্রধানমন্ত্রী। আগেই বলেছি, মওলানা ছিলেন হজরত আবু জর গিফারীর (রা.) একজন অনুসারী। নিজ জীবনে গিফারী সাহেবের আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন সারা জীবন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের ইসলাম বাস্তবায়িত হলে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন পৃথিবীতে কোথাও সত্যিকারের ইসলাম নেই। ইসলাম এখন আচার সর্বস্ব ধর্মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও এখানে ইসলাম কায়েম করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে সরকার এবং এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর ইচ্ছা হলো নামাজ-রোজা করো। অর্থ থাকলে হজ পালন করো আর জাকাত দাও। রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলো না। খুব বেশি যদি চাও তাহলে সুফি-দরবেশ হয়ে যাও। রাজনীতি আর সরকার নিয়ে মাথা ঘামিও না। এটা রাজনীতিবিদদের কাজ। যাদের কোনো ধর্ম থাকবে না বা আদর্শ থাকবে না। মওলানা ভাসানী ও শেখ সাহেবের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন ধর্মকে মসজিদ-মাদরাসা আর বাড়ির ড্রয়িং রুম ও বৈঠকখানায় আটকিয়ে রাখতে চায়। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা এখন বামপন্থীদের চাপে পড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে তিনি ইসলামী দল ও গ্রুপগুলোকে সন্ত্রাসী হিসেবে গালাগাল করে চলেছেন। ইসলামকে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করে ইসলাম ও মুসলমানদের দমনের কাজে নেমেছে। শেখ হাসিনার সরকার পশ্চিমাদের এ নীতি সমর্থন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। যদিও শেখ হাসিনা কথায় কথায় বলেন, তিনি নিয়মিত ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ও কোরআন তেলাওয়াত করেন। ভোটের আগে হিজাব পরে ভোটারদের কাছে যান। তিনিই স্লোগান তুলেছেন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এর মানে হচ্ছে, এদেশে মুসলমানরা মেজরিটি বলে রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ কোনো মর্যাদা পাবে না। বাংলাদেশকে ভারত কীভাবে এবং কোন চোখে দেখে তা জানতে হলে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ বইটি পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকার ইন্দিরা গান্ধীর চাপে পড়ে যে সাত দফা গোপন চুক্তি করেছিল তাও পাঠকদের জানা দরকার। ভারত দীর্ঘদিন থেকে ওই সাত দফা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সময় যতই লাগুক ভারতের লক্ষ্য ওই সাত দফা বাস্তবায়ন করা। এ জন্য ভারত সিকিমের লেনদুপ দর্জির মতো শেখ হাসিনাকে একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে। শেখ হাসিনা জানেন তার পিতাকে কারা হত্যা করেছে। তাই তিনি সব সময় ভয়ে থাকেন। একই শক্তি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। নিজেকে ভারতের মহা বিশ্বস্ত বন্ধু প্রমাণ করার জন্য বিগত ৬/৭ মাসে কয়েকশ’ মানুষ হত্যা করে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়েছেন।
মওলানা সাহেবকে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, গবেষক কেউই মূল্যায়ন করতে পারেননি। দেশের ইসলামপন্থীরা তাকে কমিউনিস্ট মনে করতেন। তাই তাকে তারা ইসলামের বাইরে মনে করতেন। বিদেশিরা বলতেন, ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বা ‘মাও অব ইস্ট ইনডিজগাইজ অব এ প্রিস্ট’। অন্যদিকে তিনি হক্কুল এবাদ নামে সংগঠনও করেছেন। তিনি বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে বলে এসেছেন, আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তি, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন। তিনি মাও সে তুংকে বলেছিলেন, আপনাদের সমাজতন্ত্রে খোদাকে জায়গা করে দিন আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।
ষাটের দশকে মওলানা সাহেব সারা বিশ্বের ইসলামী নেতাদের আহ্বান করেছিলেন কমিউনিস্ট বিরোধী অন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেতা আমেরিকাকে সমর্থন না করার জন্য। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকা কখনোই ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। আমেরিকা এবং পশ্চিমা নেতারা ইহুদিদের বন্ধু। এমনকি ভারতও ইহুদিদের পরম বন্ধু। সে সময় ইসলামী নেতারা মওলানা সাহেবকে কমিউনিস্ট বলে গালাগাল করেছেন। মওলানা সাহেবকে আমি অতি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। এক সময় আমি তার একান্ত সচিব হতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, শুনেছি তোমার বাবা অসুস্থ। তুমি বাপের বড় ছেলে। এ সময়ে তুমি তোমার মা-বাবার খেদমত করো। তখন আমি মহানবীর (সা.) জীবনী তেমন ভালো করে পড়িনি। এখন জানি। এক সাহাবি জেহাদে যাওয়ার জন্য নবীজীর কাছে আবেদন জানালে তিনি প্রশ্ন করলেন, ঘরে তোমার আর কে কে আছেন। উত্তরে সাহাবি বলেছিলেন বৃদ্ধ মা-বাবা। নবীজী (সা.) বললেন যাও, ঘরে গিয়ে মা-বাবার খেদমত করো। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মওলানা সাহেব সম্পর্কে তেমন জ্ঞান ছিল না বা এখনও নেই। এমনকি আমাদের আলেম সমাজ ও পশ্চিমা জগতেরও তেমন সঠিক ধারণা বা তথ্য জানা ছিল না তার সম্পর্কে। ফলে সবাই তাকে বামপন্থী বা কমিউনিষ্ট বলে আখ্যায়িত করত। মওলানা সাহেব আসলেই মনেপ্রাণে একজন রেডিক্যাল ইসলামিস্ট ছিলেন। কার্ল মার্কস এবং এমএন রায় ইসলামকে রেডিক্যাল ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের চর্চা বা অনুশীলনে যে ইসলাম বিরাজ করছে তা আসলে শোষণমুখী ইসলাম। যারা মনে করেন তারা ইসলামের জন্য কাজ করছেন তারাও চলমান বিশ্বের মুসলমান আর ইসলামের ভেতর ফারাক করতে পারেন না। লাখ লাখ মসজিদ আছে, প্রতিদিন লাখ লাখ মুসলমান সেজদা দিচ্ছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ক’জন ইসলামিস্ট আছেন। বর্তমান বিশ্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্রও নেই। কোনো ইসলামী সমাজ নেই। মওলানা ভাসানী একটি শোষণমুক্ত ইসলামী সমাজ চেয়েছিলেন। তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মুসলমানদের দেশগুলো এখন ডিক্টেটর বা বাদশাহরা শাসন করছেন। যা একেবারেই রাসুলের (সা.) ইসলাম নয়।
নিরহঙ্কার নির্লোভ এই মানুষটি সারাটা জীবন সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিলেন। মজলুম জননেতা বললে সবার চোখে মওলানা সাহেবের চেহারা ভেসে ওঠে। যখন তার দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় তখনও তিনি কাগমারীতে কুঁড়েঘরে থাকতেন। খুবই নামি-দামি বা সরকারি উচ্চ পর্যায়ের মেহমান গেলে বসানোর জন্য মাত্র একখানা চেয়ার ছিল। ঢাকায় এলে ভক্তদের বাসায় থাকতেন। এক সময় ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের বাসায় বা চা-বাগানের মালিক সাইদুল হাসান সাহেবের বাসায়ও থাকতেন। ’৭১ সালে পাক বাহিনী হাসান সাহেবকে হত্যা করে। ঢাকায় মওলানা সাহেবের কোনো বাড়ি ছিল না। বড় বড় কোম্পানি ও ভক্তরা চেষ্টা করেও ঢাকায় বাড়ি করার ব্যাপারে মওলানা সাহেবকে রাজি করাতে পারেননি। পাঠক সমাজ হয়তো ভুলে গেছেন, জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতাও হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। তার ভক্তরাই চাদা দিয়ে কাগজটি বের করেছেন। এখন কিন্তু এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাহেব। মাওলানা সাহেব কখনও ক্ষমতায় ছিলেন না। তবুও তিনি এ দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সন্তোষের বিশ্ববিদ্যালয় তার একটি বড় প্রমাণ। এমনকি আসামের একটি জায়গার নাম হচ্ছে ভাসানীর চর। ওই এলাকাটা মওলানা সাহেবই আবাদ করেছিলেন। সন্তোষের তত্কালীন জমিদার ইংরেজদের সহযোগিতায় মওলানা সাহেবকে ব্রিটিশ শাসিত পূর্ববাংলা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এর পরই মওলানা সাহেব আসাম চলে যান। সেখানেই রাজনীতি শুরু করেন। এক সময় আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। খোদ জিন্নাহ সাহেব মওলানা সাহেবের সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এই প্রথম শ্রেণীর মুসলিম লীগ নেতা পূর্ব পাকিস্তানে এসে দলে কোনো স্থান পেলেন না। বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মওলানা সাহেবকে ‘হিন্দুস্তান কি লেলায়া হুয়া কুত্তা’ বলে গালাগাল দিয়েছেন। এক সময় লিয়াকত আলী সাহেব ‘শের কুচাল দেঙ্গা’ বলেও ধমক দিয়েছেন। মাওলানা সাহেবের ইউরোপ সফর নিয়ে সময়-সুযোগমতো অন্য কোনো সময় লেখার আশা রাখি। সে এক বড় ইতিহাস। এর আগে অনেকবার লিখেছি, মুসলিম লীগের নেতাদের গণবিরোধী ভূমিকার কারণেই মওলানা সাহেব নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে বাধ্য হন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল তখন তিনি আর দলে থাকতে পারলেন না। সরকারের বিদেশনীতির প্রশ্নে দ্বিমত হওয়ার কারণে তিনি দল ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। সে সময়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব থিওরি দিলেন ‘জিরো প্লাস জিরো’। মানে পাকিস্তান একা জিরো। তাই আমেরিকার সঙ্গে থাকতে হবে। মওলানা সাহেব সব সময়ই আমেরিকার সঙ্গে জোট বাঁধার বিরুদ্ধে ছিলেন। সেই সময়েই পাকিস্তান সেন্টো-সিয়াটোর সামরিক জোটে যোগদান করে। আওয়ামী লীগ ছেড়ে মওলানা সাহেব ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেছিলেন।
ভারত ও রাশিয়ার পরামর্শে শেখ সাহেব যখন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালুর জন্য বাকশাল গঠন করেছিলেন, মাওলানা তাকে সমর্থন করেননি। তখন আমাদের সাংবাদিক নেতা ও বন্ধুরা দলে দলে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আগস্ট মাসের শুরুতে আমি সন্তোষে মওলানা সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম জানতে কী করব। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কয়েকদিন অপেক্ষা করো। দেখো কী হয়। তখন বুঝতে পারিনি মাওলানা সাহেব কী ইঙ্গিত করেছিলেন। বাকশাল গঠনের পর শেখ সাহেব নাকি মনসুর আলী সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন মওলানা সাহেবের কাছে দোয়ার জন্য। শুনেছি, মওলানা সাহেব নাকি বলেছিলেন, দেখো মনসুর, দোয়া তো করবোই, মুজিবর আমার প্রাণের মানুষ। মনসুর, তুমি কি হাড়গিলা পাখি চেনো? হুজুর পাখির নাম শুনেছি। তোমাদের জন্য হাড়গিলা পাখি হলো মণি সিং। শকুন খাইয়া যা থাকে সেই হাড়গোড় খায় হাড়গিলা পাখি। মুজিবরকে হাড়গিলা পাখি ধরেছে। আর ছাড়বে না। শুনেছি ১৪ আগস্ট রাতে নাকি মাওলানা সাহেব ঘুমাতে পারেননি। পুত্রবত্ শেখ সাহেবের চিন্তায় তিনি অস্থির ছিলেন। ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকা নাকি ১৪ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিল। কিন্তু কেউ শেখ সাহেবকে তা জানায়নি। তিনি তখন একেবারেই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যা রহস্য তদন্তের জন্য আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকার কোনো কমিশন গঠন করেনি। এমনকি শেখ হাসিনাও সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেননি। তিনি তখন দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। দিল্লি সরকার তাকে দেশে ফিরতে নিরুত্সাহী করত। জিয়া সাহেব অনেক দেন-দরবার করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ করেছেন।
বাংলাদেশ এখন খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে নিপতিত। ভারত চায় এদেশে কখনোই যেন জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে। তাই ভারত এবার মরণ কামড় দিয়ে বাংলাদেশকে ধরেছে। যে কোনোভাবেই হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। ২০২১ সাল নাগাদ শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে ভারতের লক্ষ্য অর্জিত হবে। ভারতের ’৭১ সালের গোপন চুক্তিও বাস্তবায়িত হবে। ক’দিন আগে এ ব্যাপারে রাহুল গান্ধী একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

লেখক : কবি ও ঐতিহ্য গবেষক

Source: Amardesh Online