হায়রে বাঙাল প্রশংসার কাঙাল
===================
১.
আনন্দ বা উচ্ছাস প্রকাশের স্যাম্পল বা নমুনা দেখে যেমন একজন ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা কিংবা সাংস্কৃতিক মান মাপা যায় , তেমনি একটি জাতির ক্ষেত্রেও একই ক্যালকুলেশন করা সম্ভব । জাতীয় কিছু অর্জন নিয়ে আফ্রিকার কোনো কোনো দেশ উচ্ছাস প্রকাশে যতটুকু সংযম দেখায় , আমরা কেন যেন সেটুকুও দেখাতে পারি না ।
এক লোকের মেধাবী ছেলেটি এসএসসিতে চমৎকার ফলাফল করেছে । কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপডায় আরো ভালো করছে ।বাবা স্বপ্ন দেখছে , এক বছর পর ছেলেটি মেডিকেলে ভর্তি হবে । ছয় বছর পর ডাক্তার হয়ে বের হবে । এটি নিশ্চিত।
এখন এই পিতামাতা যদি এখনই ছেলের ডাক্তার হওয়া সেলিব্রেট করা শুরু করেন , তবে এই ধরনের বাবা-মাকে পাগল ছাড়া কিছুই বলবেন না ।
অথচ সেই কিছিমের পাগলামি রাষ্ট্র হিসাবে আমরা শুরু করেছি ।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পাবে ২০২৪ সালে । এই অর্জন কারো একার নয় । দীর্ঘ সময়ের অনেকের প্রচেষ্টার ফসল । সরকারের চেয়ে সাধারণ মানুষের কন্ট্রিবিউশনই বেশি । মাঝে মাঝে মনে হয় সরকার না থাকলেই বোধহয় আরো তাড়াতাড়ি এই জায়গায় পৌছে যেতাম ।
২০২৪ সালের সম্ভাব্য স্বীকৃতি মহা ডাকঢোল পিটিয়ে ২০১৮ সালেই সেলিব্রেট করা শুরু করে দিয়েছি । একজনের মাথা কিংবা একটি বা দুটি মাথা এক সঙ্গে খারাপ হতে পারে-কিন্তু এক সঙ্গে এতগুলি মাথা খারাপ হয় কী করে ? ??
লুটেরা শ্রেণীর সম্পদ বাড়লেও আমাদের প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় বেড়ে যেতে পারে । অর্থাৎ অধিকাংশ জনগণের পকেট খালি হয়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে সম্পদ জমা হলেও আমরা এই স্বীকৃতিটি পেতে পারি । কেউ কেউ মূল বিষয়টি না বুঝেই এখানে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত লাফাচ্ছে ।
তাছাডা জনসংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম দেখালেও মাথাপিছু আয় বেশী দেখায় । জিপিএ ফাইভ বেশি দেখিয়ে শিক্ষার মান বেডেছে বলে পুলক অনুভবের মত এখানেও সরকারের ভেতর একই পুলক কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেলে কম শোধে ঋণ সহ অন্যান্য বিশেষ সুবিধা কাটা পড়বে । সেই ভাবনাটিও এই উন্মাদদের মাথায় কাজ করেছে কিনা জানি না ।
২.
জাহাজের এক কাপ্তান , প্রবাসে থাকেন । পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছেন । গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন । ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো ওয়ারল্ড হেরিটেজ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ায়
রাস্তায় আনন্দ মিছিল বের হয়েছে । ইউনেস্কো এযাবৎ অনেক বিষয়কে এরকম ওয়ার্লড হেরিটেইজ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে , ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেককে দিবে । কিন্তু এটাকে এই কিছিমে উদযাপন সম্ভবত পথিবীর কোনো দেশেও দেখা যায় নি । ভবিষ্যতেও কোনো দেশ বা জাতি এই কিছিমে উদযাপন করবে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে ।
সেদিন রাস্তায় বের হয়েছে বিশাল শোভাযাত্রা । ছেলে নাচছে , বুড়ো নাচছে , মেয়ে নাচছে , মাইয়া নাচছে । সাথে ইউনিফর্ম পরা পুলিশও নাচছে । মাইকে বাজছে ৭ই মার্চের ভাষণ । সাথে ড্রাম ঢোল বিউগল তো আছেই ।রাস্তায় অসুস্থ মানুষটির কী হবে অথবা রাস্তার পাশে হাসপাতালের রোগীদের কথা কে ভাববে?
কাপ্তানের এগারোর বছরের ছেলেটি তার জীবনের পুরো ভাগ সময় একটি উন্নত ও মেচিওরড দেশে কাটিয়েছে ।যে দেশটি একটি জেলে পল্লী থেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা কসমোপলিটান সিটি ও মাথাপিছু আয়ে বিশ্বের সেরাদের একজন হয়েছে । যে মহান ব্যক্তি এই অসম্ভব কাজটি নিজের এক জীবনেই করে গেছেন -সেই জাতির পিতার মৃত্যু দিনেও রাষ্ট্রীয় ছুটি দেয়া হয় নি ।
বিষ্ময় ভরা চোখে বালকটি দাদার দেশের এই দৃশ্য দেখছে । সবাইকে চমকে দিয়ে বালকটি হঠাৎ বলে বসে , Dad , Why is he shouting ? বাচ্চাটির বলার এই ভঙ্গি দেখে গাড়িতে উপস্থিত মা সহ অন্য সবাই হেসে ওঠে । ম্যারাথন হাসি শেষে সবাই এদিক ওদিক তাকায় । ভয়ও পায়। ভাগ্যিস , উল্টাপাল্টা জায়গায় এই কথাটি বলে ফেলে নি ।
ছেলেটির বাবা ভাষণটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পুত্রের সম্মুখে তুলে ধরলেন । ইউনেস্কোর স্বীকৃতির বিষয়টিও বিশ্বস্ততার সাথে তুলে ধরলেন । বর্ণনা শোনে ছেলেটি কনভিন্সড হলেও এদের লাফালাফি ও উচ্চ স্বরে রাজপথে মাইক বাজানোর বিষয়ে কনভিন্সড হয়েছে বলে মনে হলো না । শব্দ দূষণ ও নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে ওদের স্কুলে যে ধারণা দেয়া হয়েছে , তার সাথে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জাতীয় আবেগ নিয়ে ছোট্ট ছেলেটি সত্যিই মুশকিলে পড়ে গেল । নিজের এগারো বছরের ছেলেকে খুব একটা কনভিন্সড করতে না পেরে ( সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের আব্দুর রহমানের মত )
কাপ্তান সাব রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ইনহাস্ত ওয়াতনাম !
এই তো আমার জন্মভূমি ! !
কারণ চল্লিশোর্ধ বাবার সংবিধিবদ্ধ চেতনা এবং এগারো বছরের বাচ্চার বাস্তব জ্ঞান কলিসন কোর্সে এসে পড়েছে।একজন দক্ষ কাপ্তান হিসাবে VLCC এর মত অনেক জাহাজকে নিরাপদ কোর্সে ফিরিয়েছে ।
কিন্তু আজ নিজেকে সত্যিই অসহায় মনে হচ্ছে । একবিংশ শতাব্দী র একজন সচেতন , আধুনিক ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসাবে তার ছেলেকে কোনটি শিক্ষা দেওয়া উচিত ?