ভাসমান মানুষ, ফুটন্ত ফানুস ও ডুবন্ত মানবতা
(নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয় কলাম)
কয়েক হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা কয়েক দিন ধরে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলবর্তী সাগরে ভাসছে। বোধগম্য কারণেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো অসহায় এই বনি আদমদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। যারা এই চরম মানবিক বিপর্যয়ের মূল হোতা তারা এখনো সবার দৃষ্টিসীমার বাইরে। আমাদের মিডিয়াগুলোয় তা অতি সামান্যই প্রচার পাচ্ছে। কার অপরাধে বা অবহেলায় এই বনি আদমেরা আজ এই মর্মান্তিক অবস্থায় পড়েছে, তা বের করতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন পড়বে না।
আমরা জানি, যারা অপরাধ করে আর যারা তা সহ্য করে তারা উভয়েই সমান অপরাধী। সেই হিসেবে এটি শুধু সরকারের নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক পাপ। আমাদের সেই সম্মিলিত পাপের মাশুল গুনছে মালয় সাগরে ভাসমান মানুষগুলো।
কিছু দিন আগে একটি ফেরি দুর্ঘটনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন; যদিও সেই ফেরি দুর্ঘটনার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রীর দূরতম কোনো দায় ছিল না। সেটা ছিল নেহাত জাহাজের ক্যাপ্টেনের ভুল কিংবা গাফিলতি। অথচ দেখুন, গণতন্ত্রের কী অপার সৌন্দর্য, কী অপূর্ব দায়বোধ ! বিবেকের তাড়নায় প্রধানমন্ত্রী সরে গেছেন।
সাগরে ভাসমান মানুষগুলোর দুর্ভোগের দায় এই সরকারের কাঁধে চাপে। কাঙ্খিক্ষত গণতন্ত্র অর্জিত হলে এই দায়বোধে সরকারকে সহজেই আটকানো যেত। এমন একটা উদ্দেশ্য থেকেই বারবার গণতন্ত্রের কথা বলি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আইনের শাসনের কথা বলে থাকি। বিশেষ গ্রুপ বা দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য এই প্রচেষ্টা নয়। কারন এক দিন হয়তো এদেশে আওয়ামী লীগ থাকবে না, বিএনপি থাকবে না, জামায়াত বা জাতীয় পার্টিও থাকবে না। তখনো এই দেশকে টিকে থাকতে হবে। গণতন্ত্রকে টিকে থাকতে হবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত কথাটি একেবারে মিথ্যা বলেননি। এ দেশের মানুষের ডিএনএ-তে গণতন্ত্র রয়েছে। এই গণতন্ত্রের জন্যই এ দেশের অনেক মানুষ একাত্তরে জীবন উৎসর্গ করেছেন। অনেক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে, বিদেশী ইয়াহিয়ার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে এনেছিলাম, তা দেশী ইয়াহিয়াদের কাছে বিসর্জন দিতে হচ্ছে।
মতলববাজের দল ‘কম গণতন্ত্র ও অধিক উন্নয়নের’ গল্প শোনাচ্ছে। আজ দেশের উন্নয়ন এমন হয়েছে যে, দুনিয়ার সবচেয়ে অবহেলিত ও দুর্ভাগা জাতি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী একই নৌকায় জীবিকার সন্ধানে মালয় সাগরে ভাসছে!
এতে সরকারের ফানুসটিও ফুটে গেছে।
জীবনের ষোলো-সতেরোটি বছর সমুদ্রের ওপর ভেসে ভেসে কাটিয়েছি। অর্ধ শতের ওপর দেশ এবং ততোধিক শহরে-বন্দরে গিয়েছি। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কল্যাণে মানুষের সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য যেমন দেখেছি, তেমনি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অভাবে মানুষের চরম দুর্ভোগ অনেকটা কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি।
সমুদ্রের শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ উপভোগের সাথে সাথে তার মহাভয়ঙ্কর রূপটিও দেখেছি। যদিও আমার সে অবস্থান ছিল অনেকটা ফাইভ স্টার হোটেলের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। তার পরেও সে জীবনের কিছু যন্ত্রণা ছিল। জাহাজটি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছলে মাটি স্পর্শ করার জন্য উতলা হয়ে পড়তাম। সামান্য বিলম্বও সহ্য হতো না।
তাই আজ এই হতভাগা মানুষগুলোর দুর্ভোগ হয়তো বা অন্য অনেকের চেয়ে আমাকে বেশি স্পর্শ করেছে। হৃদয়ঙ্গম করছি ছোট ছোট নৌযানে গাদাগাদি করে সমুদ্রে ভাসমান এই বনি আদমদের অবর্ণনীয় মানসিক ও শারীরিক অবস্থা। প্রতিবেশী ড. মোয়াজ্জেম ভাই তাগাদা দিচ্ছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের বিষয়ে কিছু লিখতে। সেই লেখাটিও অনেকটা এগিয়ে রেখেছিলাম। তবে মনটা এই হতভাগাদের নিয়েই আগে লিখতে চাচ্ছে।
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আমার মতো সেই একই মন ও একই শরীর নিয়ে একই ভূখণ্ডের, একই ভাষা ও একই অনুভূতির শত শত মানুষ আজ অথৈ সমুদ্রে ভাসছে। চোখের সামনে ওরা স্থলভূমি দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সেখানে নামতে পারছে না। পেছনে উন্মত্ত সাগর, সামনে হিংস্র মানুষ; জটিল তাদের রাজনৈতিক, আর্থিক ও প্রশাসনিক সমীকরণ। প্রশ্রয় দিলে বাংলার বাজিকররা আরো মওকা পেয়ে যাবে, অথবা মিয়ানমারের সামরিক জান্তা একটা সমাধান পেয়ে গেছে মনে করে তাদের এথনিক ক্লিনজিং পরিকল্পনা নিয়ে আরো দ্রুতগতিতে অগ্রসর হবে। কাজেই হোস্ট কান্ট্রির মানবিক দুর্বলতা নিজেদের জন্য আরো উৎকট বিপদ টেনে আনবে বলেই তারা এতটা নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ার তাগিদটি সহজেই অনুমেয়। আমাদের দেশটিকে মধ্য আয়ের উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, অথচ বাস্তব অবস্থা এখনো এটাই।
যে দু’টি দেশ থেকে এই অসহায় মানুষগুলোকে প্রলুব্ধ করে এসব বাহনে চড়ানো হয়েছে, সেই দু’টি দেশেই গণতন্ত্র অনুপস্থিত। দু’টি দেশেই আইনের শাসনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ দু’টি দেশই যেন মগের মুল্লুক হয়ে পড়েছে। এই দু’টি দেশের শাসক গোষ্ঠীর ঘেন্না-পিত্তি-লজ্জা-শরম নেই। অসংখ্য মানুষ এভাবে সমুদ্রে ভাসলেও এই শাসকদের মনে কোনো পাপবোধ বা দায়বোধ হয়তো জাগবে না।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিজের দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করার মতলবে এই জঘন্য কাজটি করে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে একটি তিমি মাছের বাচ্চা বরফে আটকে পড়লে পৃথিবীর মানুষ উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। একজন মানুষ হিসেবে তখন খুব গর্ব হয়েছিল, আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে খুবই প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম।
অথচ আজ হাজার হাজার মানুষ ও শিশু সমুদ্রে ভেসে এবং নিজেদের প্রস্রাব খেয়ে বেঁচে থাকলেও সেই মানবতার তেমন কোনো নাড়াচাড়া দেখছি না।
এসব হতভাগাদের দুর্ভোগের জন্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি সরাসরি দায়ী। মূলত দায় সরকারের। দেশটিতে গণতন্ত্রের পরিবর্তে দুর্বৃত্ততন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে। এদের ক্ষমতার দাপট এতই বেড়ে গেছে যে, তার উত্তাপে এয়ারপোর্টেও এমপির পিস্তল থেকে অটোমেটিক গুলি বের হয়ে পড়ে। ভাগ্যিস, আগেরবারের মতো অভাগা ড্রাইভার বা অন্য কেউ এতে নিহত হয়নি।
বস্তুতপক্ষে রাজনীতিতে ও প্রশাসনে আজ স্বেচ্ছাচারিতার আধিপত্য চলছে। এলাকায় এলাকায় একধরনের জমিদারিত্ব বা লর্ডশিপ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যে জায়গা থেকে এসব মানুষ মাছ ধরা ট্রলারে চড়েছে, সেখানেও এই ধরনের এক লর্ডের রাজত্ব চলছে।
মানবতার চরম দুশমন এসব মানব পাচারকারীর সাথে ক্ষমতাবানদের বিভিন্ন স্তরে সখ্য সৃষ্টি হয়ে গেছে।
বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য যে পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সাজানো হয়েছে তাদেরকে দিয়ে বিরোধী দলকে ঠাণ্ডা করা সম্ভব হলেও মানবপাচার প্রতিরোধের মতো কাজ সম্ভব হবে না। যাদেরকে তৈরি করা হয়েছে মানুষকে টেররাইজ করে শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য, তাদের দিয়ে কখনোই সুশাসন কায়েম করা সম্ভব নয়।
যেসব দেশে স্বাভাবিক উপায়ে শ্রমিক যেত, তা সরকারের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। কাজেই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের দিকে চোখ পড়েছে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের। ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি দেয়া নৌযানেও হতভাগা অনেক বাংলাদেশী রয়েছে।
সরকার এখন মেয়ে শ্রমিক বা সৌদি আরবে গৃহশ্রমিক পাঠানোর দিকে ঝুঁকেছে। অথচ গৃহশ্রমিকদের কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে মালুম হচ্ছে। সেটা গণ্য করে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনের মতো দেশ তাদের মেয়ে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। এটাকেই আমাদের সরকার দারুণ মওকা মনে করেছে এবং তা নিয়ে বগল বাজাচ্ছে। পোড়খাওয়া সৌদি গৃহবধূরাও সুন্দরী ও অল্পবয়স্কা কাজের মেয়ে নিতে তাদের অনীহা প্রকাশ করেছে। এসব হ্যাজার্ড বা রিস্ক এনালাইসিস করে সরকার বান্ধব নারী নেত্রীরা এসব গৃহশ্রমিকের প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন দেয়ার সুপারিশ করেছেন। পরামর্শের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে যে, এসব উদার নারী নেত্রী এবং ‘অনুদার’ রক্ষণশীলদের সন্দেহের জায়গায় কোনো অমিল নেই। ভাবখানা এমন যে, এই মোবাইল ফোন সম্ভাব্য প্রফেশনাল হ্যাজার্ড বা বালামুসিবত থেকে উদ্ধার করবে।
নেত্রীদের এই রেসকিউ প্ল্যান দেখে একটি গল্প না বলে থাকতে পারলাম না।
পয়লা বৈশাখে নারীর বস্ত্রহরণ করাকে কয়েকজন ছেলের দুষ্টুমি বলে অভিহিত করেছেন আমাদের পুলিশের আইজিপি। তেমনি এক দুষ্টু ছেলে প্রতিবেশীর রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। সেই রান্না ঘরে ডাল রান্না করছিল বাসার তরুণী মেয়েটি। মেয়েটি দুষ্টু ছেলেটিকে চলে যেতে অনুরোধ করে। নাছোড়বান্দা দুষ্টু ছেলেটি যেতে অস্বীকার করে। মেয়েটি ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করে। ছেলেটি বলে, আমার নাম ডাইল। দুষ্টু ছেলেটি তখন দুষ্টুমি শুরু করে। মেয়েটি তার মাকে ডেকে জানায়- মা, মা গো, দেখো ডাইলে যেন কেমন দুষ্টুমি করছে? শোয়ার ঘর থেকে মা চেঁচিয়ে নির্দেশ দেন, নাড়া দে পোড়ামুখী। আরো জোরে তাড়াতাড়ি নাড়া দে।
কাজেই অন্যদেশের কোনো ডাইল এমন দুষ্টুমি করলে গৃহশ্রমিকটি মোবাইলে কয়েক হাজার মাইল দূরে তার মায়ের কাছে এমন করেই হয়তো বা পরামর্শ চাইবেন। এ প্রান্ত থেকে পরামর্শটিও সম্ভবত এই গল্পের মতোই হবে।
প্রিয় পাঠক, নেহাত বিনোদনের জন্য এই গল্পটি বলিনি। সম্ভাব্য বিপদ জেনেও যে কৌশলে এসব বনি আদমকে ছোট ছোট নৌযানে সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে, একই কায়দায় ও একই অজ্ঞতায় ঝুঁকির দিকে এসব অসহায় ও নিরীহ মেয়েদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
এসব মেয়ের চাকরির অন্যতম প্রধান জায়গা ছিল গার্মেন্ট সেক্টর। সরকারের একগুঁয়েমি এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতার দরুন গার্মেন্ট সেক্টর বিপন্ন হতে চলেছে। ব্যাপার হলো- যে দেশটির উৎসাহ ও সহযোগিতায় আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হচ্ছে, আমাদের হারানো গার্মেন্ট ব্যবসাটিও সেই দেশেই ধীরে ধীরে শিফট করছে। গার্মেন্ট ব্যবসা হারানোর মূল কারণ দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি।
এসব দেখেও না দেখার ভান করা মারাত্মক পাপ। আমাদের এই সম্মিলিত পাপ যেমন এখন মালয় সাগরে ভাসছে, সেই একই পাপ মরুর মরীচিকায় ভাসতে থাকবে।
জানি না এই অভোগা জাতির কপালে আর কী কী রয়েছে?