লাখের বাতি ও নিম্নমধ্য আয়ের ক্যারেশমাতি
আগেকার দিনে কেউ লাখপতি হলে তা সবাইকে জানানোর জন্য নাকি ঘরের চালে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে রাখতেন। তখন লোকজন বলাবলি করত, ওই যে, দেখ্ দেখ্, লাখের বাতি জ্বলছে। গল্পগুলো কতটুকু সত্যি, তা নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে। কারণ, তখন ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার না থাকলেও দস্যু বা ডাকাত নিশ্চয়ই ছিল।
তবে লাখের বাতি জ্বালানোর সেই একই ধরনের রেওয়াজ গ্লোবাল ভিলেজে উদিত হয়েছে। বিশ্বমোড়লেরা গ্লোবাল ভিলেজে এই ধারাটি চালু রেখেছেন। দেশে পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের কথা যখন ছড়িয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতি নামক ঝুড়িটির তলা যখন বিলকুল ছেদা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সুসংবাদ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অ্যানালগ বাকশালের ‘বটমলেস’ বাস্কেটটি ডিজিটাল বাকশালের হাতে পড়ে এখন হয়েছে বটমটর্ন বাস্কেট বা তলাছেদা ঝুড়ি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর ছয় বছর পরে সেই খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এখানে দেয়া হিসাবটি সাদামাটা। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নিজেদের হিসাবের খাতা ক্লিন দেখাতে ৩৬ হাজার ৯৭০ কোটি ৫৪ লাখ রাইট-অফ বা অবলোপন করেছে। অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আর খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। এর মধ্যে কেবল ২০১১ সাল পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সুতরাং এই অর্থ যোগ করলে খেলাপি ঋণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ছয় বছরের শাসনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা।
কাজেই নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হওয়ায় সরকারের কৃতিত্ব নেই। বরং সরকারের কৃতিত্ব বা ক্যারেশমাতি হলো এই ছিদ্র বা ছেদাটি বানানো, যে ছেদা দিয়ে দেশের ব্যাংক থেকেই ৫০ হাজার কোটি টাকা ড্রেইন হয়ে গেছে। শেয়ারবাজার থেকে ড্রেইন হয়েছে লাখ কোটি টাকা। এই ছেদা দিয়ে যথেষ্ট ড্রেইন বা নির্গত হওয়ার পরেও প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের কারণে এবং বিশেষভাবে লাখ লাখ প্রবাসীর কল্যাণে এখনো কিছু জমা থেকে যায়। এটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পেছনে কাজ করেছে।
এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকও রয়েছে। এ দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ এখনো একমুঠ খালি মুড়ি ও এক ঢোক পানি খেয়ে ইফতার করে থাকেন। এদের জীর্ণ কুটিরে গিয়ে সুসংবাদটি জানিয়ে আসতে হবে, ‘জনাব আপনারা এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশের নাগরিক। এক মুঠ মুড়ি আর পানি দিয়ে ইফতার খেয়ে বলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এবার এই সুসংবাদটি শুনে বলুন, মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।’
তেত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে সর্বস্বান্ত। আমার এক বন্ধু নিজের সব উপার্জন খুইয়ে এই অসময়ে আবার জাহাজে সেইল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই বন্ধুর সামনে তো জাহাজে চাকুরির সুযোগটি রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের তা-ও নেই। যে লোকটি তার পেনশনের সমুদয় টাকা ভার্সিটিপাস বেকার ছেলের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তার পরিবারটি এখন অথৈ সাগরে ভাসছে। এদের জীবনযন্ত্রণার কথা তারা কার কাছে গিয়ে বলবেন? আন্দামান সাগরে যারা ভেসেছেন, তারা তবুও মিডিয়ার সামনে দৃশ্যমান হতে পেরেছেন। এই অভাগারা তাও হতে পারেননি। রাস্তায় নেমে যে একটা গগনবিদারী চিৎকার দেবেন, সে সুযোগটিও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।
এদের দুর্ভোগ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন মশকারা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তাদের যেখানে পাওয়া যাবে গ্রেফতার করে নাকি দেশে আনা হবে। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাখা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পুঁজিবাজার একটি সমস্যা ছিল। সমস্যা সমাধানে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। অনেকে দেশেই নাই। দেশ ছেড়ে ভেগে গেছে। তাদের যেখানে পাওয়া যাবে, গ্রেফতার করে দেশে আনা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী মন্দ বলেননি। এ জাতির স্মৃতিশক্তি গোল্ডফিশের মতো। কয়েক বছর আগে ‘রাবিশ’ অর্থমন্ত্রী যে ‘স্টুপিড’ কথাগুলো বলে ফেলেছিলেন এত দিনে আশা করা যায়, তা এ দেশের মানুষ বিলকুল ভুলে গেছে। তখন শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ন্যাড়া একবার বেলতলায় গেলেও শেয়ারবাজারটি এরকম করে দু’বার আওয়ামী লীগের তলায় এসে পড়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা বা উত্তেজনা থামাতে নিজেদের লোক দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটি যথারীতি তাদের প্রতিবেদনও দাখিল করেছিল। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট দেখে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। শেয়ারবাজার লুণ্ঠনকারীদের নাম নিতেও তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, এই কথাটি মুখ ফসকে বলেও ফেলেছিলেন। দেশের জনগণ যা বোঝার তা বুঝে ফেলেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলছেন, শেয়ারবাজার লুণ্ঠনকারীরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, তখন অর্থমন্ত্রী জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বরে দিলেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের প্রভাবে কোনো অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ সেদিন অর্থমন্ত্রী যাদের নাম মুখে নিতে ভয় পাচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথামত আজ তারা সব দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে! জনগণের স্মৃতিটা আরেকটু ঘোলা হলে কিছুদিন পরে হয়তো বলা হবে, ‘শেয়ারবাজার ধ্বংসের পেছনে ছিল আসলে হাওয়া ভবনের হাত!’
নতুন কোনো বিনিয়োগ না থাকায় লাখ লাখ মানুষ বেকার অথবা অর্ধ বেকার হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া দুর্বৃত্ততন্ত্র কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য কিংবা গোপনে যে খুদকুঁড়া ছিটানো হচ্ছে, তা পুরো অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ছেড়েছে। জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষের কাছে এর মাঝেই বিশ্বব্যাংক এই হ্যাজাক বাতিটি উঁচিয়ে ধরেছে। এই বাতির নিচে এখন চাপা পড়ে যাবে সব অর্থনৈতিক সূচক ও রূঢ় বাস্তবতা।
২০০৪ সালে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দেখে বিশ্বের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। এগুলো আজকের মতো হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে নয়, এটা করা হয়েছিল অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দেখে। অথচ সেই ইমার্জিং টাইগারকে বিল্লি বানিয়ে এক যুগ পর নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করায় মতলববাজ একটা গ্রুপ যারপরনাই নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। কথিত সর্বাধিক প্রচারিত একটি পত্রিকা ‘নিম্ন’ শব্দটি বাদ দিয়ে শিরোনাম করেছে মধ্য আয়ের দেশ। অথচ কলামটির ভেতরে ঠিকই লিখেছে, নিম্নমধ্য আয়ের দেশ।
এসব খেতাব ও উপাধি বিলানোয় বিশ্বমোড়লদের মেজাজ-মর্জি বা মতলবও বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হয়। আপনার ঘরের চালে লাখের বাতি জ্বললেই হবে না। গ্রামের মোড়লের কাছ থেকেও স্বীকৃতি আনতে হবে। মোড়লের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে অথবা কোনো বিশেষ বোঝাপড়া থাকলে লাখপতি হওয়ার আগেও লাখের বাতি জ্বালিয়ে দিতে পারেন। এ এক আজব বাতি। কখন জ্বলবে আর কখন নিভবে বোঝা বড় দায়। এই মোড়লেরা কখনোই এ দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করে দেবেন না। টকদইয়ের গল্পের মতো এই অবৈধ সরকারকে মাঝে মাঝে একটু আধটু ধমক দেবেন মাত্র। কাজেই এসব মোড়লের ওপর ভরসা কমিয়ে দেশের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
একক জাতিসত্তার চমৎকার উদাহরণ, এই রাষ্ট্রটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে শত্রুরা প্রমাদ গোনে। এদের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে যে, এর পেছনে কাজ করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এই সিস্টেমটি দেশটিকে গণতন্ত্রের পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিছুটা ভুলত্রুটি থাকলেও ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চালু থাকা গণতন্ত্রই এই দেশটিকে ইমার্জিং টাইগার বানিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে এই জাতির উন্নয়নকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এই হিসাবটি শত্রুদের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল।
কাজেই যেভাবে হোক, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটিকে বিতর্কিত করতে হবে। পুরো মিশনটি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার অধীনে সম্পন্ন করা হয়েছে। বাঁশের আগায় শয়তান দিয়ে এক চিমটি গুড় লাগিয়ে দেয়ার মতো করে কাজটি শুরু করা হয়েছিল। মিষ্টির গন্ধ পেয়ে সেই লাঠির আগায় একটি মাছি এসে বসে। সেই মাছি দেখে টিকটিকি আসে। সেই টিকটিকিকে তাড়াতে বিড়াল আসে। আর বিড়ালকে তাড়াতে আসে কুকুর। বিড়াল আর কুকুরের ঝগড়া থেকে মালিকদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। শেষ হয় মালিকদের নিজ নিজ গ্রামবাসীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিনষ্ট করার জন্য এভাবেই ছকটি সাজানো হয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের সময় লাঠির আগায় মিষ্টি লাগিয়ে দেয়ার কাজটি তখন এক মন্ত্রীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে ফেলে একটা ইস্যু তৈরি করা হলো। যাকে এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে তার পরবর্তী আমলনামা দেখে পুরো ছকটি বোঝা সহজ।
পরস্পরের মুখোমুখি দুটি জোটের ‘কাইজ্যা’ থামাতে ‘এক-এগারো’তে জরুরি সরকার নামে একদল ‘ফেরেশতা’ এনে হাজির করা হলো। দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলের উদ্দেশ্যে তারা এসে জেহাদ ঘোষণা করলেন। তাদের গ্রাউন্ড প্রস্তুতির জন্য দেশের সামগ্রিক দুর্নীতির জন্য অত্যন্ত চতুরভাবে একটি ভবনকে দায়ী করে ফেলা হয়েছে। এর জন্য অনেক তিলকে শুধু তাল নয়, একেবারে বিলাতি তাল বানানো হয়েছে। কোনোরূপ তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে। এসব অভিযোগের অনেকগুলোরই কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব কারসাজি বোঝা সম্ভব হয়নি। জাতির মেধা বা বিবেক বলে যারা চিহ্নিত বা সম্মানিত হয়েছিলেন, তারাও বিভিন্ন চেতনার ঘোরে অচেতন হয়ে পড়েন। তিন চার বছর পর বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মতো লোক উপলব্ধি করেছিলেন, দেশ বাজিকরদের হাতে পড়ে গেছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি এবিএম মূসা তখন সরকারের লোক দেখামাত্রই ‘তুই চোর’ বলতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর সাত বছরের মাথায় এসে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, ঢাবির ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উপলব্ধিতে এসেছে যে, দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম সেরা এই বুদ্ধিজীবীকে অনেক ধন্যবাদ যে, কিছুটা বিলম্বে হলেও বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেছেন এবং বেশ সাহস করে কথাটি উচ্চারণ করেছেন। তবে অনেক বড় ব্যক্তি রয়েছেন যারা এখনো টের পাচ্ছেন না, দেশ ও জাতি কী ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়ে গেছে। অথচ যার বিদ্যাবুদ্ধি ও শিক্ষা নিয়ে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করা হয়, সেই বেগম খালেদা জিয়া এদের সবার আগেই সব কিছু টের পেয়ে বলেছিলেন- ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও।’
জানি না, এটি উপলব্ধি করতে বাকিদের আর কত দিন লাগবে?