অসুরদের তালিকা এবং আশুরার চেতনা

Minar Rashid

প্রখ্যাত কলামিস্ট ও টিভি ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমানকে নিয়ে আমার আগের লেখায় একটি তথ্যগত ভুল হয়েছিল। শফিক রেহমান ১৯৬৭ সালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে নন বরং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে চাকরিরত ছিলেন। মাঝখানে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়টিতে তিনি আবার লন্ডনে চলে যান এবং জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীর অধীনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ার লক্ষ্যে কাজ করেন। ঈর্ষান্বিত গাফ্ফার চৌধুরী মূল কাহিনী ঢেকে রেখে বলেন, ‘গোটা একাত্তর সালে তিনি লন্ডনে সপরিবারে নিরাপদ ও সচ্ছল-স্বচ্ছন্দপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন।’

এই তথ্যটি ভুল হওয়ায় পাঠকেরা ইমেইল পাঠিয়ে এবং আমার ফেসবুক পেজে মন্তব্য কলামে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাজেই সেটার সংশোধনীর জন্য নতুন একটা লেখার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছি। পাঠকদের সার্বিক সচেতনতা সত্যিই প্রশংসনীয়। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য শফিক রেহমানের ভক্ত ও পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এবং যারা ইমেইলে বিষয়টি জানিয়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এই ভুলটির জন্য নিজের মনে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, এমন একটা সজাগ ও সতর্ক জনগণের সম্মুখে গাফ্ফার চৌধুরী থেকে শুরু করে শাজাহান খানরা এমন বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা কোন সাহসে বলেন? এ দেশের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ বলেন, গুগলসের আগেই তিনি নাকি একটি সার্চ ইঞ্জিন শুরু করেছিলেন। পুলিশের আইজি এবং আওয়ামী লীগের হানিফের একই রোগ দেখা দিয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটামাত্রই কোনোরূপ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়ে বসেন। এদের যুক্তি ও মানসিক গঠনটি সত্যিই আজব। চারদলীয় জোট সরকারের সময় যতগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য দায়ী করা হয়েছে তখনকার সরকারকে। একই ধরনের ঘটনায় এখন আবার সরকারকে দায়ী না করে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে।

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দুর্গাপূজা উপলক্ষে পূজারিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, ‘মা দুর্গার আগমন ঘটেছিল কিসের জন্য? অসুর বধের জন্য। আপনারাও অসুর বধের জন্য মা দুর্গার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করবেন, আমাদের এমনি শক্তি দাও যেই শক্তি দিয়ে আমরা বিএনপি-জামায়াত অসুরদের শায়েস্তা করতে পারি।’ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার হলো ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই কাজটি যখন তারা নিজেরা করেন, তখন আর কোনো সমস্যা থাকে না। এই একই মন্ত্রী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কেরাত প্রতিযোগিতায় গিয়ে বলেছেন, ‘মহানবী সা: ইসলামকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু কোনো রাজনীতি করেননি।’ সেদিন তিনি আরো বলেছেন, ‘ইসলামে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনো স্থান নেই। কুরআনে এ সম্পর্কে কোনো আয়াত নেই। রাসূল সা: ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি এই কাজটি কখনো করেননি।’
শাজাহান খানরা যখন যেটা দরকার এবং যখন যা মনে আসে তখন তাই অবলীলায় বলে যেতে পারেন। তাদের কোনো সাপোর্টিং ডকুমেন্টের দরকার পড়ে না। রাসূল সা: তাঁর সময়ের কোন রাজনৈতিক দলের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে অপছন্দ করেছিলেন, তা এই খান সাহেব বলতে পারবেন না। কারণ রাসূল সা:-এর সময় কোথাও বর্তমান প্যাটার্নের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল ছিল না। তার এ ধরনের বক্তব্য অব্যাহত থাকলে ত্যক্তবিরক্ত মুসল্লিরা সব ভয়ভীতি কাটিয়ে জুতা নিক্ষেপ শুরু করে দিয়েছিলেন।

রাসূল সা: রাজনীতি না করলে তারা যে ‘মদিনার সনদ’ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন বলে তাদের নেত্রী দাবি করছেন, তা কোথায় পেলেন? মদিনার সনদ অনুযায়ী এই দেশটি শাসন করলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়টি শুধু ‘মা দুর্গা’র হাতে দিয়ে রেখেছেন। এবার মনে হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়টিও অর্পণ করতে চাচ্ছেন।

দেশের অনেক মসজিদে একটি সতর্কবাণী দেখা যায়, মসজিদে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞাটি জারি করেন মূলত মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি ও সভাপতি । এদের বেশির ভাগই আবার এই শাজাহান খানদের ভাবশিষ্য।
মসজিদের ইমাম সাহেবরা রিজিকের মালিক আল্লাহ বলে প্রচার করেন। কিন্তু নিজেদের রিজিক বা মাসিক বেতনের মালিক হিসেবে সঙ্গত কারণেই এসব সেক্রেটারি ও সভাপতিকেই গণ্য করতে হয়। এসব রিজিক বা বেতনের মালিকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে মেপে মেপে কথা বলতে হয়। এমনকি মোনাজাতেও যথাসম্ভব সাবধান থাকতে হয়। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বর্তমান অবিচার ও জুলুমের বিচার চাওয়াতে এই কিসিমের অনেক সভাপতি ও সেক্রেটারি অনেক ইমামের চাকরি খেয়ে ফেলেছেন। অথচ তাদের ধর্মনিরপেক্ষ গুরু শাজাহান খান মা দুর্গার কাছে বিএনপি-জামায়াতের অসুরদের নাশ করার জন্য শক্তি কামনা করেন। এটা নিঃসন্দেহে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ধর্মপ্রাণ কোনো হিন্দু এ কথাটি উচ্চারণ করেননি- তা করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী একজন রাজনীতিবিদ।

আমার এই বক্তব্য কোনোভাবেই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে আহত করার উদ্দেশ্যে নয়। নিজের ধর্মকে ভালোবাসি বলেই একজন নন-মুসলিমের জন্য সেই একই অধিকার মনেপ্রাণে স্বীকার করি। সব ধরনের অবিচার তথা অধর্মের বিরুদ্ধে সব ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঐক্য ও শুভবোধ কামনা করি। প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে কোনো ধর্মই বিশ্বমানবতার বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। কাজেই ধর্মের প্রকৃত প্রসার (knowledge based religion ) মানবজাতির জন্য কখনোই হুমকি হতে পারে না, বরং ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ধর্মকে ভালোবাসলেও নিজে খুব একটা ধার্মিক নই। তবে ধর্মের নামে কপটতা বা শঠতাকে সহ্য করতে পারি না। ধর্মকে যারা ধর্মের জায়গা থেকে টেনে এনে সব তরকারিতে ব্যবহারযোগ্য গোল আলু বানাতে চান, তাদের সাথেও সহমত পোষণ করি না।

আমাদের ধর্মই শিখিয়ে দিয়েছে, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে- আমার ধর্ম আমার কাছে’। এই সহজ সরল ও সোজাসাপ্টা স্লোগানের পরিবর্তে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- স্লোগানটি চালু করা হচ্ছে। মতলব অস্পষ্ট।
মুসলমানের কোরবানিতে একজন হিন্দু আনন্দ উৎসব করতে পারে না। এটা জরুরিও নয়। তেমনি একজন একেশ্বরবাদী মুসলিম কোনো পৌত্তলিক অনুষ্ঠানের স্বাদ আহরণ করতে পারে না। এটাও জরুরি নয়। গো-মাতার পূজারি কোনো হিন্দুকে আখলাকের সাথে বসে গরুর গোশত খাওয়ার দরকার নেই। আখলাক খেলে অন্যরা তাকে না মেরে ফেললেই হয়। এই চরম বাস্তবতাটিকে ঢেকে নয় বরং এটাকে মেনে নিয়েই পরস্পরের আবেগ অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানানোর উপায় বের করতে হবে।

মনের এবং বাইরের প্রকাশ এক না হলে কখনোই পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত হতে পারে না। ধর্মীয় উৎসবগুলোকে সার্বজনীন বানানোর চেয়ে প্রথম কাজ হলো সবাই যেন নিজ নিজ ধর্ম ঠিকভাবে ও নির্বিঘেœ পালন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নেতানেত্রী এই কাজটি করতে গিয়ে কোথাও যেন কিছু গুলিয়ে ফেলছেন। নিজেদের কপট বা অকপট উদারতা দেখাতে গিয়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে মনে হয় এদের কষ্ট হচ্ছে। অপরের স্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে নিজের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া বা স্পর্শকাতরতাটুকু এরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন। একেকটা ধর্ম একেকটা স্বয়ংসম্পন্ন প্যাকেজ। এক ধর্ম থেকে একটু, অন্য ধর্ম থেকে আরেকটু নিয়ে কখনোই কোনো বিশ্বাসের ভিত্তি রচিত হয় না। এতে রচিত হয় হিপোক্রেসি বা শঠতার উপাখ্যান। এরা না হয় হিন্দু, আর না থাকে মুসলমান।
ক্রিকেটার লিটন দাস দুর্গাপূজা উপলক্ষে তার ফেসবুক পেজে দুর্গাদেবীর ছবি পোস্ট করে। এতে একজন পাঠক বিরূপ মন্তব্য করলে তিনি জোরে এর প্রতিবাদ জানান। নিজ ধর্মের সপক্ষে তার এই সুদৃঢ় অবস্থান প্রশংসিত হয়েছে। তার বিশ্বাসের গভীরতা অনেকের শ্রদ্ধার উদ্রেক করেছে। যদিও তিনি এক পাঠকের স্টুপিডিটির জন্য সতেরো কোটি মানুষকেই স্টুপিড হিসেবে আখ্যায়িত করে বসেছেন।

কিছু দিন আগে অন্য ক্রিকেটার মুশফিক নিজ হাতে গরু কোরবানির একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। চ্যানেল আইয়ের অনলাইন সংস্করণসহ কিছু জায়গা থেকে সমালোচনা শুরু হলে তিনি সেই পোস্টটি ডিলিট করে দেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের প্রকাশকে খুব প্রয়োজনীয় মনে করি না। তার এই পোস্টটি দেখে যারা বেশি মাত্রায় আহলাদিত হয়ে পড়েছিলেন, সঙ্গত কারণে পোস্টটি ডিলিট করার পর তারাই বেশি আহত হয়েছেন। অহেতুক পোস্টটি দিয়ে তিনি ধর্মের কোনো উপকার না করলেও পোস্টটি এভাবে সরিয়ে অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে কোরবানির উদ্দেশ্যটুকু তুলে না ধরে মওসুমি পশুপ্রেমিকদের প্রচারণার কাছে নতি স্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশের কোরবানি মওসুমে কিছু পশুপ্রেমিক উদয় হন। মজার ব্যাপার হলো, এরা সবাই মাংসাশী। নিজের ও পরিবারের প্রোটিনের চাহিদা এই প্রাণী হত্যার মাধ্যমেই জোগান দিয়ে থাকেন। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডসের পাশে গেলে এদের এই পশুপ্রেম প্রগতিপ্রেমে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষ বা হোমো সেপিয়ানের মধ্যে কমপক্ষে ছয় বিলিয়ন হলো মাংসাশী। এদের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি প্রাণী (মুরগি, মাছসহ) হত্যা করা হয়। আবার এক বিলিয়ন ভেজিটেরিয়ান যারা শুধু ভেজিটেবল বা গাছ খান, সেই গাছেরও নাকি প্রাণ রয়েছে। ফলে ভেজিটেরিয়ানরাও এই প্রাণী হত্যার পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন না। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গাছপালাও ব্যথা অনুভব করে। কোরবানি মওসুমের এই মওসুমি পশুপ্রেমিকেরা এগুলো নিয়ে কোনো দিন ভাবেন না।
আমাদের বর্তমান যুগের হিরোরা সমসাময়িক পরিসংখ্যান কিংবা নিজের ধর্ম কোনোটারই খোঁজখবর রাখেন না। পুরো প্রজন্মই যেন হালকা বাতাসে ভাসছে। তাই কবি নজরুলের মতো মুশফিক তার কোরবানিটি নিয়ে বলতে পারেননি- ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন। তখনকার হিরো কবি নজরুল কবিগুরুকে খুশি করতে খুন শব্দটির জায়গায় রক্ত বসাননি। কিন্তু আজকের হিরো চাহিবামাত্রই তা করে বসেছে।

কাজী নজরুলের উল্লিখিত এই সত্যাগ্রহ শক্তিটি সম্পর্কে বর্তমান যুগের সুপার হিরো মুশফিকদের কোনো ধারণা নেই। কোরবানির মাধ্যমে মনের পশুত্ব দূর করার রোমান্টিক যে ধারণা ছড়ানো হয়েছে, তা মুশফিকদের শিরটিকে খুব বেশি সোজা করতে পারেনি। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই কোরবানির স্পিরিটটি যুগ যুগ ধরে দরকার পড়বে। কাজেই এটা স্রেফ পশুহত্যা নয়। এই কোরবানি সব যুগের ইব্রাহিমদের স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পড়লে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে উৎসর্গ করতে হবে। মা হাজেরাদের শিক্ষা দেয় নিজের সন্তানকে সেভাবে সাজিয়ে দিতে। যুবক ইসমাইলদের প্রেরণা দেয় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হাসিমুখে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। কাজী নজরুল ইসলামের বর্ণিত সত্যাগ্রহ শক্তিটি অনুপস্থিত থাকায় আজ তা স্রেফ পশুহত্যা ও গোশত খাওয়ার উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্মের মূল স্পিরিট উপেক্ষিত থাকায় তা থেকে কোনো ফায়দা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

একজন ধর্মপ্রাণ পূজারি বিশ্বাস করে না যে ‘মা দুর্গা’ ধরায় এসে মন্ত্রী শাজাহান খানের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে অসুর বধে নামবেন। কারণ ‘মা দুর্গা’র পূজারিদের জমি এ যাবৎ যারা দখল করেছে, সেই তালিকা ‘মা দুর্গা’ ঠিকঠাক মতোই মনে রেখেছেন। পাড়ার যে অসুরদের ভয়ে মুদিদোকানি থেকে স্কুলগামী কিশোরী মেয়েটি সারাক্ষণ দুর্গা দুর্গা জপে, সেই জপমালা থেকেই ‘মা দুর্গা’ অসুরদের তালিকা বানান । যাদের প্রতি মনটা বিষিয়ে থাকলেও দেখামাত্রই দূর থেকে হাত তুলে হাসিমুখে আদাব জানাতে হয়, অসুরদের তালিকাটি তাদের মধ্য থেকেই তৈরি হয় ।

নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের হাতে যে সাতজন গুম হয়েছেন, সেখানে অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ছিলেন ‘মা দুর্গা’র পূজারি। এই অসুর কখনো ঘুষখোর কর্মকর্তা, কখনো থানার ওসি, কখনো এসআই, কখনো র‌্যাবের সিইও। আগের অ্যানালগ অসুরদের সাথে এবার যোগ হয়েছে ডিজিটাল অসুর। এই অসুরেরা দেশের কয়েকটি ব্যাংক একদম সাবাড় করে ফেলেছে। চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে এই অসুরদের প্রশ্রয়দাতা বলেন, এটা হলো পি-নাট। শেয়ারবাজারে যে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো হয়েছে, এর মধ্যে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লাখ ‘মা দুর্গা’র পূজারি। এই অসুরদের চেহারা দেখেই পদ্মা সেতু থেকে ‘মা লক্ষ্মী’ বা বিশ্বব্যাংক ও জাইকারা সরে গেছে। কুইক রেন্টালকে এই অসুররা জাতির গলার ফাঁস বানিয়েছে। ২০০৯ থেকে মা দুর্গার রাডারে তো এই অসুররাই ধরা পড়ার কথা। মা দুর্গার এই রাডারে শাজাহান খানদের এই টেম্পারিং কোনো কাজে আসবে না।
এ দেশের সবচেয়ে বড় অসুর গণতন্ত্রের হত্যাকারী শক্তিটি।

এ দেশের প্রধান দু’টি ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্মীয় বোধ থেকেই এই অসুরদের চিনে নিতে সক্ষম হয়েছে। উপরিউক্ত অসুরদের তালিকা এবং আশুরার চেতনা নিয়েই এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক মানস গড়ে উঠেছে। কাজেই যে নামেই আসুক না কেন, এখানে কোনো স্বৈরাচারই দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারবে না।
জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকা কোনো স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ হয়েছে ফোরাতের তীরে কারবালার ময়দানে। ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। এটা দেখেই বলা হয়, প্রতিটা কারবালার পরেই ইসলামের পুনর্জন্ম হয়েছে। যেখানেই ইয়াজিদের উদয় হয়েছে, সেখানেই ইমাম হোসাইনের চেতনা জাগ্রত হয়েছে। ইতিহাস জানিয়েছে, এই স্বৈরাচারেরা যুগে যুগে এসেছে, সামনেও আসবে। এমনি এক জগদ্দল স্বৈরাচারের কবলে পড়েছে প্রিয় জন্মভূমি। দেশের ইটপাথরও বলছে, তুই স্বৈরাচার। এমনকি দুধকলা দিয়ে পুষে রাখা এরশাদও বলেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমার চেয়েও বড় স্বৈরাচার।
বেগম খালেদা জিয়া এই আশুরার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বর্তমান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যুগের এই ইয়াজিদ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু ২০১৩ সালের ৫ মে এ দেশে ছোটখাটো অনেক কারবালা সৃষ্টি করেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে সেই লাশের ওপর নেচেছে।

ইয়াজিদদের পূর্ববর্তী দল (জরুরি সরকার) বিডিআরকে দিয়ে মুদির ব্যবসা করিয়েছে। সেখান থেকে সৃষ্ট ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের নামে এ দেশের কলিজার টুকরো মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ দেশের মানুষের মনে এ ধরনের অনেক দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোতে হতাশ হয়ে আমার অনেক পাঠক জানতে চান, আমাদের কী হবে? তাদের প্রতি সেই একটাই সান্ত্বনা, কারবালার স্বাদ যখন পেয়েছেন, বিজয়ের স্বাদ অবশ্যি অবশ্যি পাবেন।