আসল বিএনপির সন্ধানে
বিএনপি থেকে সরে এসে অনেকেই নিজেকে মূলধারার বিএনপি হিসেবে দাবি করছেন। তারা সুযোগ পেলেই নিজেকে তুলে ধরেন জিয়াউর রহমানের শতভাগ খাঁটি ভক্ত হিসেবে। এই দাবিদারদের মধ্যে সাবেক বিএনপিদলীয় মন্ত্রী ও পরিচিত মুখ যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখ। বিএনপির প্রতি এ দেশের মিডিয়ার দরদ এতই বেশি যে এই ধরনের অজ্ঞাত অখ্যাত কাণ্ডজ্ঞানহীনকেও যথেষ্ট কাভারেজ দিয়ে তুলে ধরেছে। আসল বিএনপির ধ্বজাধারী কেউ কেউ প্রায়ই বিবৃতি দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকেও আসল বিএনপি থেকে বহিষ্কার করে দিচ্ছেন। এই লোকদের কথার ফ্রিকোয়েন্সির সাথে হানিফ ও হাছান মাহমুদদের ফ্রিকোয়েন্সি অনেকটা মিলে যায়।
মিডিয়ার সেই অংশটিই আবার নতুন উৎসাহে আসল বিএনপির সন্ধানে বের হয়েছে। যার কণ্ঠেই আসল বিএনপির জন্য দরদ দেখা যায়, সেখানেই দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। সর্বশেষ অনুসন্ধানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক ছোট ভাইয়ের সন্ধান মিলেছে। অকৃতদার থেকেই বার্ধক্যে উপনীত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জিয়াউর রহমানের ছোট ভাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ছড়ানো হচ্ছে, বিএনপি তার আদর্শে নেই। যদিও তার সেই কথার সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই।
বিয়েশাদি না করলে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে অনেকেই বেদনাদায়ক একাকিত্বে ভোগেন। কারণে-অকারণে তখন আশপাশের অনেকের ওপর ক্ষোভ বা অভিমান বাড়তে থাকে। শহীদ জিয়ার ছোট ভাইটিও সম্ভবত জীবনের সেই বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। তা ছাড়া জিয়া পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি ও অবস্থান কারো অজানা নয়। এমতাবস্থায় জিয়া পরিবার কর্তৃক তার খোঁজখবর না নেয়ার হতাশাকে এই বিএনপি দরদিরা কাজে লাগাতে চাচ্ছেন।
‘বিএনপি তার আগের আদর্শে নেই’ এই কথাটির অনেকগুলো অর্থ হতে পারে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার যে সততা, দেশপ্রেম ও সাহস ছিল তার অনুসারীদের মধ্যে তার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না। এই কথাটি অনেকেই বলতে পারেন এবং একজন সত্যানুসন্ধানী মানুষ হিসেবে তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করা আসলেই কঠিন।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বর্তমানে এই কথাটি ছড়ানো হচ্ছে তার অন্য একটি মাজেজা আছে। বিএনপি তার আদর্শ থেকে সরে গিয়ে জামায়াতের আদর্শ ধারণ করে ফেলেছে- এটিই হলো মূল কথা। এই কথাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা ছড়ানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি থেকে বিভিন্ন কারণে খসে পড়া তারকাদের তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে কে বিএনপির সুহৃদ আর কে ঘাতক তা বোঝা সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব আদর্শ বা কৌশল থাকে। আদর্শকে যদি ভিশন (vision) বলে ধরা যায়, তবে মিশন (mission) হলো এই কৌশল। এই ভিশন বা আদর্শের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না তবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এই মিশন বা কৌশলের পরিবর্তন হতে পারে। কৌশলের পরিবর্তন মানেই আদর্শের বিচ্যুতি নয়।
এই কৌশলের কারণেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর সাথে পলিটিক্যাল ম্যারেজ বা কৌশলগত ঐক্য স্থাপন করেছে। একই কারণে বিএনপিও জামায়াতে ইসলামীর সাথে রাজনৈতিক জোট করেছে। কিন্তু জামায়াতকে নিয়ে রাজনৈতিক এই কৌশলটি আওয়ামী লীগ যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যে বা স্বস্তিতে প্রয়োগ করতে পেরেছে, বিএনপি ততটুকু স্বস্তিতে করতে পারেনি। একই অর্ধসত্য বারবার বলতে বলতে আওয়ামী লীগ তাদের দাবিকে যতটুকু প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, বিএনপি পেছনের পুরো সত্যকে ততটুকু প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তারা স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে ২০০১ সালে নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছে। অথচ একই কিসিমের কর্ম আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালেই সেরে ফেলেছে। তখন কিশোরগঞ্জের মাওলানা নুরুল ইসলাম ও এ কে ফায়জুল হকের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ হয়েছে অনেকটা কৃষ্ণের মতো, যা এই কৃষ্ণের বেলায় লীলা খেলা, সেটাই অন্যের বেলায় পাপ।
বেগম খালেদা জিয়াকে দোষারোপ করা হয় বিএনপির আদি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই স্বয়ং শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী ও মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। জিয়াকে বলা হয় ট্যালেন্ট হান্টার। তিনি দেশটিতে মেরিটোক্র্যাসি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য আমাদের সবচেয়ে তুখোড় পার্লামেন্টেরিয়ানকে তিনি প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবার সেই শাহ আজিজকে নিয়েই বঙ্গবন্ধু স্বয়ং পাকিস্তান সফর করেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। অন্য দিকে এ দেশ এ যাবৎ যে কয়জন ডাই হার্ড সৎ মন্ত্রী পেয়েছে, তার মধ্যে বেগম জিয়ার নিয়োগকৃত, জামায়াতের এই দু’জনকেও গণ্য করা হয়। অপ্রিয় সত্য হজম করা আমাদের পক্ষে আসলেই কঠিন।
খুলনা অঞ্চলের বর্তমান সরকারদলীয় জনৈক এমপির ডাক্তার পুত্রবধূ অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তুলকালাম কাণ্ড শুরু হলে প্রধানমন্ত্রী তার পলিসিমতো পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে মেয়ের বাবাকে সাক্ষাৎকার দেন। অসহায় বাবাকে সান্ত্বনা দিতে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, এমন ভয়ানক পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিলেন কেন? অর্থাৎ যে পরিবার থেকে তিনি দেশের আইন প্রণেতা বানিয়েছেন, সেই পরিবারে বিয়ে দেয়াকে নিজেই নিরাপদ জ্ঞান করেন না। এটাই এই জাতির দুর্ভাগ্য। মনে হয়, যাদের পুত্রকে মেয়ে জামাই বানানো যাবে তাদের গাড়িতে পতাকা দেয়া যাবে না, আবার যাদের গাড়িতে রাষ্ট্রের পতাকা দেয়া যাবে, তাদের ঘরে মেয়ে বিয়ে দেয়া যাবে না।
আমাদের মূল সমস্যা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক কমান্ড সেন্টারটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই। মিডিয়ার কথক বা লেখক, সর্বোচ্চ কয়েক ডজন মানুষের মুখের কথা বা কলমের লেখা সারা দেশবাসীর কথা হিসেবে গণ্য হয়ে পড়ে। তারা এক দিকে বাতাস প্রবাহিত করা শুরু করে দিলে উল্টো দিক থেকে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। যারা দেশের কথা বলেন, মানুষের কথা বলেন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়ালপনার মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়। আজকে দেশে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সম্পর্কে এ দেশের মানুষের অভিব্যক্তি কয়েক ডজন কথক বা লেখক থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের এই জোটটি নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও মিডিয়ার একটা অংশের রয়েছে। মিডিয়ার সেই অংশটিই মূলত এই ‘আসল’ বিএনপির সন্ধানে নেমে পড়েছে।
আদর্শ বিবেচনায় এ দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে বলা হয় মধ্যবাম আর বিএনপি হলো মধ্যডানপন্থী দল। বামপন্থী ছোটখাটো দলগুলো যেমন আদর্শিক নৈকট্যে আওয়ামী লীগকে নিজেদের ঘরানার মনে করে, তেমনি একই ধরনের নৈকট্যের অনুভূতি দেশের ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপিকে নিয়ে। তবে এই সীমানাপ্রাচীর পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র নয়। এখন অনেক ধর্মভিত্তিক দল যেমন আওয়ামী বলয়ে আশ্রয় নিয়েছে তেমনি মওলানা ভাসানীর সমর্থিত কিছু বামপন্থী দল ও ব্যক্তি বিএনপি বলয়ে প্রবেশ করেছেন।
কাজেই বিএনপি তার আদর্শে নেই এই কথাটি বলার পেছনে যতটুকু অ্যাকাডেমিক গবেষণা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে নিজ নিজ ফায়দা হাসিলকরণের মতলব কিংবা নেহাত সময়ের হাওয়া লক্ষ করে কথা বলা।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিখ্যাত ১৯ দফার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘোষণা করেছিলেন। আসল বিএনপিকে খুঁজতে হলে সেই ১৯ দফা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করা জরুরি। আজকের আলোচনার প্রয়োজনে এই ১৯ দফার ২ ও ১৬ নম্বর দফা দু’টির ওপর চোখ বুলানো যেতে পারে।
দফা নম্বর ২-এ উল্লেখ আছে,
শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
দফা নম্বর ১৬-তে উল্লেখ আছে,
সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।
ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর এই দেশটিতে ধর্ম সম্পর্কে বিএনপির সামান্য আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে আজ জামায়াতের প্রভাব বলে প্রচার করা হচ্ছে এবং বিএনপি জামায়াতের খপ্পরে পড়ে গেছে বলে হইহই রব তোলা হচ্ছে। অথচ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্তৃক ঘোষিত ওপরের দু’টি দফায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলনের ঘোষণা এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদারের ঘোষণা রয়েছে। যতটুকু ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে বিএনপি শুরু হয়েছে ততটুকু ধারণ করতে গেলেও জামায়াতীকরণের দোষ চাপানো হচ্ছে।
ধর্ম সম্পর্কে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সোজাসাপ্টা। সেখানে কোনো বকধার্মিকতা বা ভণিতা ছিল না। তাই কর্মমুখর জিয়ার অনেক ছবি থাকলেও ‘ধার্মিক’ জিয়ার কোনো ছবি দেখা যায় না। তার ছেঁড়া গেঞ্জির ছবি দেখা গেছে; কিন্তু জাদুঘরে জিয়ার ব্যবহৃত জায়নামাজ দেখা যায়নি।
তিনি কোনো মসজিদে গিয়ে কখনো বলেননি, গত রাতে স্বপ্ন দেখে (যে স্বপ্ন আবার ইন্টেলিজেন্স টিম দুই সপ্তাহ আগেই জেনেছে) আজ এখানে চলে এসেছেন। কিংবা তিনি কখনো বলেননি যে, মদিনার সনদ অনুযায়ী দেশ চালাচ্ছেন কিংবা দৈনিক ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন! তার পরেও ছয় ওয়াক্ত নামাজ পড়ার দাবিদারেরা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থাটি যতটুকু অর্জন করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশি অর্জন করেছেন তিনি। জিয়ার প্রতি মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির কারণ- তিনি যতটুকু করেছেন তার চেয়ে বেশি কখনোই বলেননি। সত্যিই, He has made politics difficult for the politicians. কেউ জিয়ার খাঁটি ভক্ত দাবি করলে তার কথা ও কাজ দেখে জনগণ সহজেই তা মেপে ফেলেন।
ধর্মীয় ভাবনায় ও আচরণে কবি নজরুল এবং জিয়ার মধ্যে একটা বিশেষ মিল রয়েছে। উভয়ে ধর্মকে ভেতরে যতটুকু ধারণ করেছেন, বাইরে ততটুকু প্রদর্শন করেননি। কিন্তু যখন প্রয়োজন পড়েছে তখন সমালোচকদের দাঁতভাঙা ও কঠিন জবাব দিয়েছেন। কবি নজরুল রক্তকে খুন বলায় রবীন্দ্রনাথ একবার বেশ আপত্তি জানিয়েছিলেন। তার জবাবে নজরুল লিখেছিলেন, বিশ্ব কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢঙ রয়েছে। বাংলা কাব্যলক্ষ্মীকে দু-একটি ইরানি ‘জেওর’ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাকে আরো খুবসুরতই দেখায়।
জিয়াও অনেকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বিশ্ব রাজনীতির খ্রিষ্টান ঢঙ, বৌদ্ধ ঢঙ, হিন্দু ঢঙের মতো একটা মুসলমানি ঢঙ রয়েছে। এই ঢঙটি তথাকথিত মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদকে যত সহজে কাবু করা যায় মাহাথির বা জিয়ার মতো নেতাদের এই ঢঙটিকে তত সহজে কাবু করা যায় না। মুসলিম বিশ্ব তথা সারা বিশ্বকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য মুসলিম বিশ্বে ডেমোক্র্যাসি ও মেরিটোক্র্যাসি চর্চা ভিন্ন অন্য কোনো গতি নেই।
মূলত এই ঢঙটিকে জব্দ করার জন্যই ‘এক-এগারো’র সৃষ্টি করা হয়েছে। এক-এগারোর পরপর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন যে, এক-এগারো জাতিকে বিশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে জাতির মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের বিবেচনায় মাত্র বিশ বছর নয়- কমপক্ষে চল্লিশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা সত্তরের দশকে যেখানে ছিলাম আজ আবার সেই জায়গাতেই ফিরে গিয়েছি। ‘এক নেতার এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এর জায়গায় ‘হাসিনা-এরশাদ জুটির বাংলাদেশ’ স্লোগান জায়গা করে নিয়েছে। এখন থেকে ইলেকশন হবে; কিন্তু কখনই হয়তো আর সরকার পরিবর্তন হবে না। নির্বাচন কমিশন সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে ঘোষণা দেবেন। পত্রপত্রিকাগুলো ইলেকশনের পরের দিন সেই নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করবে; কিন্তু এরপর আর কোনো দিন টুঁ-শব্দটি করবে না। বিরোধী দল আন্দোলন করতে চাইলে বশংবদ মিডিয়া ও নিজস্ব বাহিনীর যৌথ প্রযোজনায় টেকনিক প্রয়োগ করে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়া হবে।
চল্লিশ বছর আগে যে ভুলটি করা হয়েছিল তা রিপিট করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পরপর অনেক স্বপ্ন দেখা হয়েছে এবং সেই সব স্বপ্নের বয়ান গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে অনবরত শোনানো হয়েছে। এমনকি ডিজিটাল জমানার থ্রিজি, ফোর জির স্বপ্নও নাকি নেতা সেই সত্তর দশকেই দেখেছিলেন। এত কিছু স্বপ্নে দেখলেও জাতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, একটা বিরোধী দলের স্বপ্ন দেখেননি। এই ছোট্ট অথচ অতীব প্রয়োজনীয় স্বপ্নটি সে দিন দেখলে জাতির ইতিহাস আজ হয়তো অন্যভাবে লিখতে হতো।
যেভাবেই হোক, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে আজ এ দেশে দু’টি জোট বা দল দাঁড়িয়ে গেছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দল দু’টির শেকড় সমাজের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এই পরিস্থিতি এ দেশের শত্রুদের মনঃপূত হয়নি। শত্রু ভালো করেই জানে, সত্যিকারের গণতন্ত্র সিঙ্গেল ইউনিটের এই দেশটিকে অনেকদূর এগিয়ে নেবে। কাজেই বিরোধী দলটিকে শারীরিকভাবে ধ্বংস এবং একই সাথে সরকারি দলটিকে নৈতিকভাবে ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে।
২০০৭ থেকেই এই আত্মবিধ্বংসী কাজটি শুরু হয়েছে। জাতির জন্য ভয়ানক এই কথাগুলো তুলে ধরতে গিয়ে পুরোপুরি বিএনপি-জামায়াত সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছি। অথচ এ দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের সময়টিকে (১৯৯১ থেকে ২০০৬) এক বাক্যেই প্রশংসা করে এসেছি। এক-এগারোর সময় সর্বনাশা মাইনাস টুর বিরুদ্ধেও কলম ধরেছি।
কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য দরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ এ দেশের বাম দলগুলোর ক্রমভাঙন দেখে পরিবারতন্ত্রের আবশ্যিকতা না মেনে উপায় নেই। মজার ব্যাপার হলো- নিজের গদিনশিন শাহজাদাদের সাথে নিয়েই অনেক মুজাহিদ তখন পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদে নেমে পড়েছিলেন। তিন উদ্দীনের মধ্যে এক উদ্দীনের ভাইও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
একেক জাতির গণতান্ত্রিক বিকাশের রাস্তা একেক রকম হতে পারে। কাজেই কিছুটা রাজতন্ত্রের আদলে গড়ে ওঠা পরস্পরের মুখোমুখি এই দু’টি দল নিয়েই আমাদের শিশু গণতন্ত্রকে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতে হবে। গণতন্ত্র পরিস্ফুটিত হলে পরিবারতন্ত্রের গুরুত্ব আপনা আপনি কমে আসবে। কোনো বিশেষ দলকে নয়, এই দেশটিকে ভালোবাসি বলেই দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের স্বার্থেই এই কথাটি উচ্চারণ করেছিলাম। আশা ছিল, দু’টি দলই আরো বিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসবে।
কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। যে চক্রটি তখন মাইনাস টু সংঘটিত করতে চেয়েছিল আজকের শাসকচক্র বুঝে বা না বুঝে তাদের রোডম্যাপ মতোই অগ্রসর হচ্ছে। একটি দল দিয়ে অন্য আরেকটি দলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। একটি দলের শারীরিক মৃত্যু অন্যটির নৈতিক মৃত্যু টেনে আনবে এই বাস্তব সত্য উপলব্ধির মতো মেধা বা প্রজ্ঞা তাদের নেই।
সেই একই চক্র আজ আসল বিএনপির সন্ধানে বের হয়েছে।