বোকা হ্যাকার, কনফিডেন্ট শশী থারুর ও অভিমানী লোটাস কামাল
(দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় কলাম)
বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচে বিতর্কিত আম্পায়ারিং দেখে অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিংসহ ক্রিকেট জগতের আরো অনেকেই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনার প্রবল ঝড় শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট-ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্রভাবে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। আম্পায়ারিং ও আইসিসির বিরুদ্ধে সবাই সরব হয়েছেন।
এই ম্যাচটি নিয়ে ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর একটি মন্তব্য করেছিলেন। তার সেই মন্তব্যটি নিয়ে একটু গবেষণা করলে আমাদের অনেক প্রশ্নের জবাব বেরিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারানোর পর উচ্ছ্বসিত শশী থারুর টুইট করেন, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ; ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ভারতের বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালে ওঠার রাস্তা সহজ করে দিলে তোমরা।’ এই টুইটের পরই শশী থারুর ওয়েবসাইট হ্যাক করে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের হ্যাকার গ্রুপ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স।
এটা বাংলাদেশের প্রতি এই কংগ্রেস নেতার সহজাত অবজ্ঞা নয়, এটা ছিল সব রহস্য জানানোর ছিদ্র (Tell tale hole)।
জানি না এখান থেকে সতর্ক বার্তাটি গ্রহণ করার মতো প্রজ্ঞা আমাদের এখনো অবশিষ্ট আছে কি না।
শশী থারুর কোনো জ্যোতিষী নন। তিনি এক সময়কার ঝানু কূটনীতিবিদ, নির্মম রাজনীতিবিদ। আইপিএল ক্রিকেট বাণিজ্যে তিনি একজন বড় মাপের বণিক। স্ত্রী সুনন্দা পুস্করের রহস্যজনক মৃত্যুর পরও ভারতের আইন তাকে তেমনভাবে পাকড়াও করতে পারেনি। সেই শশী থারুরের কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমাদের দেশের বোকা হ্যাকাররা উপলব্ধি করতে পারেনি।
আমরা দ্বিধান্বিত থাকলেও এই শশী থারুর নিশ্চিত ছিলেন যে আসলেই কী ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমান মাত্রার প্রজ্ঞা ও শুকনো আবেগ নিয়ে এই শশী থারুরদের রাডারের বাইরে আমরা কখনোই যেতে পারব না। নান্দনিক কর্মকাণ্ড অথবা খেলাধুলা এবং রাজনীতির মধ্যকার সুড়ঙ্গটির ম্যাপ শশী থারুরদের কাছে স্পষ্ট থাকলেও আমরা বরাবরই থাকি বেখেয়াল। ফলে শশী থারুরদের ভবিষ্যৎবাণী সব সময় সঠিক হয়। শশী থারুরদের বানানো সিঙ্গাড়া খেতে খেতে অবাক বিস্ময়ে আমরা ভাবতে থাকি, সিঙ্গাড়ার ভেতরে আলুটি ঢুকল কিভাবে?
ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। ভারতের টিম নিঃসন্দেহে টপ ফর্মে থাকলেও বাংলাদেশ টিম একেবারে ফেলনা ছিল না। তারপরেও যে তিনটি রক্ষাকবচ বা ভাবনা এখানে শশী থারুরকে এই কনফিডেন্স বা নিশ্চয়তাটুকু দিয়েছিল তা ছিল নিম্নরূপ:
১. আইসিসি এখন অনেকটা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল হয়ে পড়লেও আম্পায়াররা কখনোই ইংল্যান্ড দলের ওপর এই ধরনের কাজটি করার দুঃসাহস দেখাতে পারত না। টুইটটি করার আগে এই কথাটি শশী থারুরের ভালো করেই জানা ছিল। রাজনৈতিকভাবে মাথা নিচু বা বেখেয়াল একটি জাতি খেলাধুলা বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। বাংলাদেশের বিভ্রান্ত পলিটিশিয়ান, ভয়বাদ বা সুবিধাবাদে আক্রান্ত প্রশাসনিক কর্মচারী বা কর্মকর্তা কিংবা শুধু আনন্দ আহরণে মশগুল ডিজুস প্রজন্মের পক্ষে এই কথাটি উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। গোলামকে নিয়ে মনিব সর্বোচ্চ ফুর্তি করতে পারে, কিন্তু কখনোই নিজের প্রতিপক্ষ বা নিজের জন্য সেই ধরনের হুমকি হতে দেবে না। দরকার পড়লে খেলাধুলার সেই নিষ্পাপ পুতুলটিকেও রাজনীতির অদৃশ্য সুতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
২. ভারতে আইপিএলে খেলতে পারা এ দেশের যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। সেই ধরনের আকাংখা বা একই ধরনের মুলা ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের সামনে নেই। কাজেই ভারতের বিরুদ্ধে মাঠের ভেতরে এবং বাইরে দাঁড়ানোর নৈতিক ও মানসিক বল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের স্বভাবতই কম। মানবমনের এই রসায়নটি ক্রিকেট বাণিজ্যের পাকা বণিক শশী থারুর ভালো করেই জানেন।
৩. ইংল্যান্ডের সরকার আমাদের সরকারের মতো ভারতের বশংবদ নয়। যেকোনো কিছু (দরকার পড়লে ক্রিকেটের জয়) দেয়ার বিনিময়ে ক্ষমতায় থাকার তাগিদ তাদের নেই। কাজেই অনিশ্চয়তার খেলায় নিশ্চিত বিজয়ের জন্য এই তিনটির যেটি দরকার, ঝানু শশী থারুররা সেটিই ব্যবহার করবেন।অর্থাৎ সোজা আঙুলে ঘি উঠলে পরম প্রশান্তিতে খাবেন। না উঠলে ওপরের কৌশলের যে কোনোটিকে ব্যবহার করবেন। এটিই ছিল শশী থারুরের সহজ ও নিশ্চিত হিসাব।
পুরো খেলাটিতে শশী থারুরের এই হিসাব বা ধারণাটিরই প্রতিফলন ঘটেছে। শুধু খেলার বেনিফিট অব ডাউটগুলোই নয়, ভারতকে কত বেশি বেনিফিট দেয়া যায় সেই প্রচেষ্টার কোনোটিই আইসিসি অবশিষ্ট রাখেনি। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক এবং নৈতিক দুর্বলতা আইসিসিকে এই অতিরিক্ত সাহসটি জুগিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পানি বিরতির পর খেলার গতিটি কেন পুরো বদলে গেল সেটিও গবেষণার বিষয়। পানি বিরতির আগ পর্যন্ত যেখানে গড় রান রেট ছিল চারের নিচে, পানি বিরতির পর তা লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে যায়। মাশরাফির অঝোরে কান্নার মূল কারণটিও কোনো দিন বের হবে কি না জানি না।
লেখার শুরুতে যে টেল টেইল হোল বা রহস্য উন্মোচনের ছিদ্রের কথা বলেছি সেই ছিদ্রটি বন্ধ করার জন্য এনালগ ও ডিজিটাল আবেগ এবং ঠুনকো অভিমান ব্যবহার করা হচ্ছে। লোটাস কামালের অভিমান, ক্রিকেট ক্যাপ্টেনকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন সব কিছু কেন যেন সেই ‘টেল টেইল ছিদ্র’ বন্ধ করার প্রচেষ্টা বলেই মনে হচ্ছে।বর্তমান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ও আইসিসির সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল বা ওরফে লোটাস কামাল বড় অভিমান করেছেন। তিনি নিজে যে সংগঠনটির সভাপতি সেই আইসিসিকে অনেক গরম গরম বা কঠিন কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। তা নিয়ে সারা বিশ্বে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই কঠিন কাজগুলো করলেও যে সহজ কাজটি এখনো তিনি করছেন না, তাহলো পদত্যাগ। কারণ এখন সত্যি সত্যি পদত্যাগ করলে ‘গৃহস্থ ও টক দইওয়ালা’র ঘটনা সৃষ্টি হয়ে পড়ে কি না!
তিনি যখন আইসিসির সভাপতি হন তখন সরকার ও সরকারবান্ধব মিডিয়া এমন একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করে যে এটাও বর্তমান সরকারের বিশ্বজয়ের একটা ধারাবাহিকতামাত্র। ক্রিকেটে বাংলাদেশের ‘হেডম’ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকেই তখন বগল বাজিয়েছিলেন। ম্যাচটির পর জাতি তার কাছ থেকে সেই ‘হেডম’টিই দেখতে পেয়েছে। তিনি জানিয়েছেন আম্পায়ারদের এই অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন, পদত্যাগ করবেন!
আইসিসির বিরুদ্ধে তার এই মারাত্মক ‘হেডম’ দেখে আমার আবার সেই যাত্রার নায়িকার ডায়ালগটি মনে পড়ে যায়। যাত্রাপালার সেই নায়িকা মুহুর্মুহু তালির মধ্য দিয়ে ভিলেনের উদ্দেশে উচ্চারণ করেন, ‘ছেড়ে দে শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি তো মন পাবি না।’ একই কায়দায় আ হ ম মোস্তফা কামাল আইসিসিকে অনেকটা দেহটি দিয়েছেন, মনটি ক্রিকেট ভক্তদের জন্য রেখে দিয়েছেন। তার এই আপিলের হুমকি ও পদত্যাগের হুমকি (এখনো পদটি ত্যাগ করেননি) আমাদের অনেক প্রশান্তি দিলেও বাস্তবতার নিরিখে এর কোনো মূল্য নেই।
ক্রিকেট একটি খেলা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তারপরও এখান থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধি বা বোধটুকু যদি এই লোটাস কামালেরা জীবনের অন্য জায়গায় কাজে লাগাতেন, তবে এই অভাগা জাতির আসলেই উপকার হতো। খেলাধুলায় হারলে একটা জাতির জীবন বেশির পক্ষে দুই আনা মিছে হতে পারে। কিন্তু নিজেদের সব ভূ-রাজনৈতিক খেলা বা সুবিধাগুলো অন্যের হাতে তুলে দিয়ে এই গুণধররা জাতির জীবনকে ষোলো আনাই মিছে বানিয়ে ফেলেছেন; রাজনৈতিক, মানসিক, নৈতিক এবং আবেগগতভাবে পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছেন, সে দিকে কোনো খেয়ালই নেই।
জানি না গত বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচটি আমাদের সেই হুঁশটি কিছুটা ফেরাতে পেরেছে কি না।