মানবিক সংকটে বাংলাদেশ |
Written by ফিরোজ মাহবুব কামাল |
বাংলাদেশের মূল সংকটটি স্রেফ রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক নয়। ব্যর্থতা নিছক গণতন্ত্রেরও নয়। বরং মূল সংকটটি মানবিক। সমস্যা এখানে বিবেকহীনতার। কঠিন রোগ যেমন নানাবিধ সিম্পটম নিয়ে উপস্থিতি জানিয়ে দেয়,বাঙালীর বিবেকহীনতাও তেমনি বহুবিধ ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্বময় প্রচার পাচ্ছে। দেশটির হাজার হাজার বিবেকহীন সন্ত্রাসী যেমন আনাচে কানাচে মানুষ খুন,টেন্ডার দখল,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলদখল,রাস্তার গাছকাটা,নদীদখল,বনদখল,জমিদখলের রাজত্ব কায়েম করেছে,তেমনি সেপাইরা (ফেব্রেয়ারি ২০১১ সালে) হত্যা করেছে ৫৭ জন সামরিক অফিসারকে। এরূপ বিবেকহীনতায় সাধারণ নাগরিকগণও কম নয়।অপরাধ সনাক্ত না করে নিছক সন্দেহের বশে নিরীহ মানুষদের পিটিয়ে হত্যা করছে,যেমন ঢাকার গাবতলির কাছে আমিনবাজারে কিছুদিন আগে ৬ জন ছাত্রকে হত্যা করা হলো। এরূপ বিবেকহীনতা কোন সভ্যদেশে হয়না,কিন্তু বাংলাদেশে বার বার হয়।
দেশের রাজনীতি ও প্রশাসন অধিকৃত হয়েছে একই রূপ বিবেকহীন ব্যক্তিদের হাতে। ফলে সমগ্র দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সরকারি তহবিল তছরুফ,ঘুষ,ধোকাবাজি ও ফাঁকিবাজির রাজত্ব। আবর্জনা নির্মূলে আপোষ চলে না,আবর্জনা আবর্জনাই। তেমনি আপোষহীন হতে হয় অপরাধীদের নির্মূলেও। অপরাধীদের নির্মূলে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি হলো দেশের বিচার বিভাগ ও পুলিশের। অথচ সে কাজে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং সরকারের কাজ হয়েছে,এদুটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে লাঠিয়াল রূপে ব্যবহার করা। পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নিয়ে সরকার নেমেছে নিজেদের রাজনৈতিক শত্রু নির্মূলে। ফলে দেশ ও জনগণের প্রকৃত শত্রুদের দিকে নজর দেবার সময় তাদের নাই। গদীর আয়ু দীর্ঘ করা ছাড়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রায়োরিটি নাই। সরকারের সমালোচনা চিহ্নিত হচ্ছে গুরুতর অপরাধ রূপে,ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পেয়েছে মূক্ত ময়দান। সরকারি দল জানে,বিচার ও পুলিশ বিভাগে ভাল লোক বসালে দলীয় স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করা যাবে না। তাতে ঘনিয়ে আসবে তাদের নিজেদের বিপদ। ফলে এ দুটি বিভাগে পরিকল্পিত ভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয় ক্যাডারদের। অপরদিকে দেশের প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আদালতের সাজাপ্রাপ্ত নিজদলের খুনিদের বাঁচানো। আর আইনমন্ত্রী তুলে নিচ্ছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হাজার হাজার মামলা। ফলে দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল না হয়ে বরং দিন দিন সেটি প্রকটতর হচ্ছে। ফলে দেশ দ্রুত বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। আর জনগণের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ? সংকট এক্ষেত্রে এতটাই গুরুতর যে বিপুল সংখ্যক জনগণ শুধু চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের ভোটই দেয় না,বরং আগ্রহভরে তাদের পক্ষে মিছিল করে,লাঠি ধরে এবং তাদের বিজয় নিয়ে উৎসবও করে।
বাংলাদেশে যে কোন উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো এই বিবেকহীনতা। যে কোন উন্নয়ন-কাজে পুঁজি চাই। গাছ যেমন মাটি ছাড়া জন্মায় না,অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নও পুঁজি ছাড়া গড়ে উঠে না। তবে সে পুঁজি স্রেফ অর্থ-সম্পদ নয়। অর্থ-সম্পদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানব-সম্পদ। অর্থনীতির ভাষায় একেই বলা হয় সোসাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক পুঁজি। এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশই প্রাকৃতিক সম্পদে অতি সমৃদ্ধ। কিন্তু সেসব দেশে শিল্প-বিপ্লব আসেনি। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবও আসেনি। বিপুল সম্পদ সত্ত্বেও এশিয়া-আফ্রিকার বহুদেশ এখনও দান-খয়রাত নির্ভর। অথচ বিপ্লব এসেছে প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র দেশে। ইংল্যান্ড,জার্মান,জাপান ও কোরিয়া তার উত্তম উদাহরণ। এসব দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের কারণ উন্নত সোসাল ক্যাপিটাল তথা মানবিক উন্নয়ন। মানব-উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক,সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন আসে না –এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটিই হয়নি।
সবচেয়ে বড় অপরাধ
প্রতি সমাজেই কিছু রোগাগ্রস্ত মানুষ থাকে। তবে বিপর্যয় ঘটে যখন সে রোগ মহামারি রূপে সর্বস্তরে দেখা দেয়। বাংলাদেশে সে ভয়াবহ মহামারিটা ঘটেছে বিবেকের রাজ্যে। বরং দেশ আজ অধিকৃত হয়েছে অসুস্থ বিবেকের মানুষদের হাতে। শেখ মুজিব ও তাঁর দলের সবচেয়ে বড় অপরাধটি গণতন্ত্র হত্যা ও বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা নয়। বরং সেটি হলো,অমানবিক বা বিবেকহীনতার রাজনীতি। মানুষের বিবেক বা মানবতা অনাহারে মারা যায না। রোগজীবাণূ বা পোকামাকড়ের কামড়েও মারা যায় না। বরং মারা যায় মগজে মিথ্যা বাসা বাঁধাতে। মানবতার সবচেয়ে বড় দূষমণটি হিংস্রপশু বা রোগজীবানূ নয়,বরং সেটি মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের কারণে আল্লাহর আযাব নেমে আসে। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছে, “ফাসিরু ফিল আরদে,ফানজুর কাইফা কানা আকিবাতুল মোকাজ্জাবীন”।
ঈমানদারদের বড়যুদ্ধটি তাই মিথ্যার বিরুদ্ধে। লড়াই এখানে কোরআনী সত্যকে প্রতিষ্ঠা করায়। অথচ শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল ভিত্তিই ছিল মিথ্যার উপর,এবং সে মিথ্যাকে তিনি বিপুল ভাবে বিজয়ীও করেছেন।
কিন্তু কি ছিল শেখ মুজিবের সে মিথ্যা? কোন একক মিথ্যা নয়,শেখ মুজিব বহু মিথ্যার জনক। তার মুখে উচ্চারিত মিথ্যাটি স্রেফ তিরিশ লাখের মৃত্যু ও দুই লাখের ধর্ষণ নয়। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু,পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের উপনিবেশ,পাকিস্তানীরা বাঙালীর শত্রু,বাকশালই গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তি জাতিয়তাবাদ,সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র –শুধু এগুলিও নয়। বরং মুজিবের বড় মিথ্যাটি উচ্চারিত হয়েছিল মহান আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামের প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন অঙ্গিকার ও সে লক্ষ্যে কোরবানীই হলো মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। সে গুণের বলেই মানুষ মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার জান্নাত পায়। অথচ তেমন অঙ্গিকারকে শেখ মুজিব সাম্প্রদায়িকতা বলেছেন। সে মিথ্যা নিয়ে তিনি মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নেমেছিলেন। সে যুদ্ধের অংশ হিসাবেই শরিয়ত প্রতিষ্ঠার রাজনীতি বা সে লক্ষ্যে দলগড়াকে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে আইন করে নিষিদ্ধ করেছেন। এমন নিষেধাঙ্গা পাকিস্তান আমলে ছিল না,এমনকি ব্রিটিশ আমলেও ছিল না।পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা শিক্ষাবোর্ড,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে কোরআনের আয়াত ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে সেটি সহ্য হয়নি। সে সব স্থান থেকে সে আয়াতগুলি তিনি বিলুপ্ত করেছিলেন। বিষ দেহ হত্যা করে,আর মিথ্যা হত্যা করে বিবেককে। আর মুজিব দেশে মিথ্যার প্রবল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হত্যা করেছেন বাঙালীর বিবেককে। আর বিবেকের মৃত্যু হলে সে বিবেক ফিরাউনকে খোদা বলে মেনে নেয়, মুর্তিকে ভগবান বলে এবং মিথ্যুক বলে হযরত মূসা (সাঃ)র ন্যায় মহান নবীকে। তখন সে গরু-ছাগল,শাপ-শকুন,পাহাড়-পর্বত, নদনদী এমনকি লিঙ্গকেও পুজা দেয়।
মুজিবের কাছে অতি প্রয়োজনীয় ছিল মিথ্যার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। সেটি তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থে।তাঁর অনুসারিরা তাই শুধু তিরিশ লাখ নিহত ও দুই লাখ ধর্ষণের বিষয়টিই প্রতিষ্ঠা করেননি,বরং নিজেকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর ন্যায় আরেক মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা করেছে। সে সাথে চরিত্র-হনন করেছে দেশের ইসলামপন্থিদের। হিরোইন ব্যবসায়ীরা চায় মানুষ অধিক সংখ্যায় নেশাগ্রস্ত হোক। কারণ তাতে হিরোইনের কাটতে বাড়ে। তেমনি স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তরাও চায় মানুষ বিবেকহীন হোক। তাতে তাদের দুঃশাসনও শ্রেষ্ঠ শাসন রূপে নন্দিত হয়। স্বৈরাচারিদের রাজনীতিতে মিথ্যাচর্চা এবং মিথ্যাচর্চার পথ ধরে জনগণের বিবেকহত্যা তো এজন্যই এতটা প্রায়োরিটি পায়। মুজিবের স্বৈরাচারি দুঃশাসন আওয়ামী বাকশালীদের কাছে শ্রেষ্ঠ শাসন তো তেমন বিবেকহীনতার কারণেই। কোন দেশ কখনই খরা,প্লাবন,রোগ-ভোগ বা যুদ্ধ-বিগ্রহে তলাহীন হয় না। বাংলাদেশে খরা,প্লাবন ও রোগের মহামারি বহুবার এসেছে। কিন্তু তাতে দেশ কোনকালেই ভিক্ষার ঝুড়ি হয়নি,বিশ্বজোড়া অপমানও জুটেনি -যেমনটি মুজিবামলে হয়েছে। বহুদেশ বছরের পর বছর যুদ্ধ করেও তলাহীন হয়না। সেটি হলে প্রকাণ্ড দুটি ব্শ্বিযুদ্ধের পর ইউরোপে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হতো এবং বহুলক্ষ মানুষ সে দুর্ভিক্ষে মারা যেত। কিন্ত সেটি হয়নি। বরং দেশ তলাহীন হয় বিবেকহীনতায়। তখন পুকুরচুরি হয় অফিসে অফিসে এবং সেটি হয় সমগ্র দেশজুড়ে।
নর্দমার কীটগুলো যদি নর্দমার মধ্যেই কিলবিল করে তবে তাতে বিপদ দেখা দেয় না। কিন্তু ড্রেন উপচিয়ে সেগুলো যখন গৃহে প্রবেশ করে তখন মহামারি শুরু হয়। তেমনি বিবেকহীন মানুষগুলো ডাকাতপাড়া,পতিতাপল্লি,বন-জঙ্গল বা কারাগারে সীমাবদ্ধ থাকলে তাতে দেশে বিপর্যয় আসে না। কিন্তু দেশের রাজনীতি,প্রশাসন ও আইন-আদালত যখন তাদের হাতে অধিকৃত হয়,তখন দেশ দ্রুত বিশ্বরেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। তখন খোদ রাষ্ট্র পরিণত হয় অপরাধের অবাধ ক্ষেত্র। হিটলারের একার অপরাধ জার্মানীর সকল অপরাধীর সম্মিলিত অপরাধের চেয়েও অধিক। কারণ,হিটলার দেশের রাজনীতি,প্রশাসন, আদালত ও সেনাবাহিনীকে ভয়ানক অপরাধীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। হত্যাকান্ডকে প্রচণ্ডতর করতে হাজার হাজার খুনিদের জন্য দরওয়াজা খুলে দিয়েছিল। তাদের হাতে ভয়ানক অস্ত্রও তুলে দিয়েছিল। সমগ্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও উপায়-উপকরণ পরিণত হয়েছিল নির্যাতন ও আগ্রাসনের হাতিয়ারে। জাহান্নামের রাস্তা গড়েছিল সমগ্র রাষ্ট্র জুড়ে,এমনকি সেটিকে বর্ধিত করেছিল প্রতিবেশী দেশেও। নমরুদ-ফিরাউন, হালাকু-চেঙ্গিজসহ সকল কাফের শাসকদের তো সেটিই মূল অপরাধ। অপর দিকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ)এর একার নেক-আমল কোটি কোটি মানুষের নেক আমলের চেয়েও অধিক। কারণ তিনি জাহান্নামের রাস্তা বন্ধ করে জান্নাতমুখি সিরাতুল মুস্তাকিম গড়েছিলেন রাষ্ট্রের সমগ্র প্রশস্ততা নিয়ে। নির্মূল করেছিলেন দুর্বৃত্ত মানুষদের বেড়ে উঠার ঘাঁটিগুলো। নবীজী (সাঃ)র নেক আমলের ফলেই অসংখ্য মানুষ যেমন বিগত ১৪ শত অবধি জান্নাতের পথ পেয়েছে,তেমনি অনাগত ভবিষ্যতেও পেতে থাকবে। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) তো এ জন্যই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এত বড় কাজ অন্য কোন নবী বা রাসূলের দ্বারা হয়নি। মুসলমান হওয়ার অর্থ হলো,নবীজীর সে আদর্শকে গ্রহণ করা। তার সে মিশনকে নিজের মিশন রূপে গ্রহণ করা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন,“তোমরাই হলে শ্রেষ্টতম উম্মত, তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। তোমরা নির্দেশ দিবে ন্যায় কর্মের এবং ফিরিয়ে রাখবে অন্যায় কর্ম থেকে। এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে।” –(সুরা ইমরান, আয়াত ১১০)। তাই শ্রেষ্ঠতম উম্মত হওয়ার পথটি নিছক নামায-রোযা ও হজ-যাকাতে সীমিত নয়। বরং সেটি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে জিহাদী মিশন নিয়ে বাঁচা। নামায-রোযা,হজ-যাকাত মূলত সেরূপ বাঁচাতে ঈমানী শক্তি জোগায়। তাই নিছক রাজনীতির লক্ষ্যে মুসলমান রাজনীতি করে না। জাতিয়তাবাদ,সমাজবাদ,সেক্যুলারিজম ও অন্যকোন মতবাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও রাজনীতি করে না।বরং মু’মিনের রাজনীতি হলো সমাজকে পবিত্র ও সমৃদ্ধ করার রাজনীতি। এরূপ রাজনীতিকে ইসলামে জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ রাজনীতিতে প্রাণ গেলে শাহাদত লাভ এবং বীনা বিচারে জান্নাত লাভ ঘটে। এরূপ বিশাল পুরস্কার অন্য কোন নেক কাজে নেই।
যে ভ্রষ্টতা বাঁচার মিশনে
মানুষ মাত্রই কোন মিশন নিয়ে বাঁচে – হয় সেটি আল্লাহর আনুগত্যের নতুবা বিদ্রোহের। চোর-ডাকাতদের জীবনেও মিশন থাকে -সেটি আল্লাহর অবাধ্যতার তথা পাপের। এ পথ শয়তানের। মহান আল্লাহর নির্দেশিত মিশনটি হলো “আমারু বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার” অর্থঃ “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ”।
এমন পথভ্রষ্ট ব্যক্তি তখন শয়তানের মিশন নিয়ে অগ্রসর হয়। দেশে এমন পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়লে প্লাবন আসে দুর্বৃত্তির। তাই যে কোন রাষ্ট্র বা সমাজে সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে অন্যদের দূরে সরানো। সেটি যেমন ব্যক্তির দ্বারা হতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রের দ্বারাও হতে পারে। পথভ্রষ্ট করার কাজে রাষ্ট্র জড়িত হলে তখন সে বিদ্রোহের সাথে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত হয়। তখন রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ লোক-লস্কর সে কাজে নিয়োজিত হয়। রেডিও-টিভি ও পত্র-পত্রিকা তখন শয়তানের কণ্ঠে পরিণত হয়। দেশ তখন দুর্বৃত্তির পথে দ্রুত এগুয়,এমনকি দুর্বৃত্তিতে দ্রুত বিশ্বরেকর্ডও গড়ে। দূর্বৃত্তিতে বাংলাদেশের বিশ্বে ৫ বার প্রথম হওয়ার কারণটি এ নয় যে, দুর্বৃত্তরা দেশের মাঠঘাট,গ্রাম-গঞ্জ ও বনজঙ্গল দখলে নিয়েছে। বরং তাদের দখলে গেছে দেশের রাজনীতি,পুলিশ,প্রশাসন,আইন-আদালত, রেডিও-টিভি ও বুদ্ধিবৃত্তি। নামাযের সময় হলে প্রতিটি মুসলমানকে নামায পড়তে হয়। এবং রোযার মাস এলে রোযা রাখতে হয। নইলে সে কাফের হয়। এখানে কোন অস্পষ্টতা বা আপোষ নেই। তেমনি কোন মুসলমান যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পায় তখন তার দায়িত্ব হয় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ। সেটি না করলে তাকে কি মুসলমান বলা যায়? অথচ শেখ মুজিব ও তাঁর দল করেছে উল্টোটি। গাজী গোলাম মোস্তাফার (মুজিবামলে ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের সভাপতি ছিলেন এবং রিলিফের মাল লুণ্ঠনে তার দুর্নীতি বিশ্বময় প্রচার পেয়েছিল) মত হাজার হাজার দূর্নীতিপরায়ন অপরাধীদের জন্য তিনি রাস্তা অবাধ খুলে দিয়েছেন। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ দূরে থাক,ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়াকেও মুজিব আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে তিনি রক্ষিবাহিনী গড়েছিলেন,এবং তাদের হাতে তিনি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। আর এখন সে মুজিবী নীতির অনুসরণ করছেন তাঁর কণ্যা শেখ হাসিনা ও বাকশালীরা অনুসারিরা। তবে পার্থক্য হলো,এখন মুজিবের সে রক্ষিবাহিনীটি নেই। সে কাজটি করছে সশস্ত্র দলীয় ক্যাডারগণ –সেটি যেমন পুলিশ ও র্যাবের পোষাকে তেমনি সাদা পোষাকে।
ধর্ম পালনে কোন জবরদস্তি নেই। ইচ্ছা করলে কেই কাফের হতে পারে,মুনাফিকও হতে পারে। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারিদেরও ছিল। কিন্তু অন্যদের ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের মিশন থেকে রুখার কোন অধীকার তাঁর ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেয়ে সে গর্হিত কাজে তিনি বল প্রয়োগ করেছেন। এখানে তিনি যুদ্ধ করেছেন মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে। শরিয়তের বিধানে এটি গুরুতর অপরাধ। মুসলিম রাষ্ট্রে এমন অপরাধ সরকার প্রধানের দ্বারা হলে তখন দ্রুত নীচে নামে সমগ্র দেশ। মুজিবের সে ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশের অর্জনটি অতি অপমানকর। দেশটির হাজারো বছরের ইতিহাসে এমন ব্যর্থতার নজির নেই। বরং অতীতে শায়েস্তাখানের বাংলাদেশ রেকর্ড গড়েছিল শান্তি ও সমৃদ্ধিতে। অথচ মুজিব দেশটিকে তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছেন। শুধু অর্থনীতিতে নয়,নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও। চোর-ডাকাত বাংলাদেশের মাটিতে আজকের ন্যায় শত বছর আগেও ছিল। তাদের হাতে প্রতিবছর বহু শত বাড়ি লুটপাটও হয়েছে। কিন্তু তাতে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ার অপমান জুটেনি। মুজিবের একার অপরাধ এজন্যই বাংলাদেশের ইতিহাসের সকল অপরাধীদের চেয়েও অধিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকের অপরাধীরা অগ্রসর হয়েছে বস্তুতঃ তাঁর ঐতিহ্য ধরেই। অগ্রসর হচ্ছেন শেখ হাসিনাও। আজকের ব্যর্থতাও মূলত মুজিব আমলের ব্যর্থতারই ধারাবাহিকতা। কথা হলো, এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কোন জাতি কি সভ্যরূপে বাঁচতে পারে? একবার নয়,হাজার বার নির্বাচন হলেও কি এ সমস্যার সমাধান হবে? বিবেকহীনতা ও নীতিহীনতার সমাধান তো নির্বাচন নয়।
বাঙালীর ব্যর্থতা ও রবীন্দ্রনাথ
বাঙালীর মানুষ রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের চোখে। সে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছিলেন,“হে বিধাতা, সাত কোটি প্রাণীরে রেখেছো বাঙালী করে,মানুষ করোনি।” উপরুক্ত কবিতার চরণে বাঙালীর যে পরিচয়টি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল সেটি নিছক প্রাণী রুপে,মানুষ রূপে নয়। বাঙালীর ব্যর্থতার জন্য রবীন্দ্রনাথ মহান আল্লাহ রাব্বুল-আলামীনকে দায়ী করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান ছিলেন,তাঁর নিজের অপরাধটিও এখানে কম নয়। তাঁর সে অপরাধটি সম্ভবতঃ অজ্ঞতাপ্রসূত। রবীন্দ্রনাথের ন্যায় একজন অমুসলমানের পক্ষে স্রষ্ঠার মানবসৃষ্ঠির রহস্য এবং সে সাথে মানবের সামর্থ জানা থাকার কথা নয়। সেটি জানতে হলে মহান আল্লাহর নিজের ভাষ্যটি জানা চাই, সেজন্য পবিত্র কোরআনের জ্ঞান চাই। মহান আল্লাহতায়ালা বাঙালীদেরকেও অন্যান্য মানুষের ন্যায় শ্রেষ্ঠ-সৃষ্টি রূপে সৃষ্টি করেছিলেন। মহৎ গুণে মহামানব বা ফেরেশতা-তূল্য হওয়ার সামর্থ যেমন তার আছে,তেমনি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হওয়ার স্বাধীনতাও আছে। বাঙালী বেছে নিয়েছে নীচে নামার পথটি। ফলে এ ব্যর্থতার জন্য পরম করুণাময় মহান আল্লাহকে দায়ী করাটি শুধু অজ্ঞতাই নয়, চরম অকৃতজ্ঞতাও।
বাঙালীরর মানুষ হওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ রায়টি দিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় শত বছরের বেশী কাল আগে। যাদের ব্যর্থতা নিয়ে আফসোস করেছিলেন তারা ছিলেন বাঙালী হিন্দু। সেকালে বাঙালী বলতে শুধু বাঙালী হিন্দুদেরই বুঝানো হতো। মুসলমানগণ গণ্য হতো স্রেফ মুসলমান রূপে। হিন্দু মানসের সে চিত্রটি ফুটে উঠেছে এমনকি শরৎচন্দ্রের লেখাতেও।শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন,“আজ আমাদের পাড়ায় বাঙালী ও মুসলমানদের মাঝে খেলা।” শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরি বাঙালী হিন্দুদেরকে চিত্রিত করেছেন আত্মঘাতি রূপে।কিন্তু যে বাঙালী হিন্দুদের ব্যর্থতা নিয়ে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরি আফসোস করেছেন তাদের সফলতা সেদিন কম ছিল না। তারাই বাংলায় জাগরন এনেছিলেন। বাংলার হিন্দুদের সে জাগরন উপমহাদেশের ইতিহাসে “বাঙালী রেনেসাঁ” নামে পরিচিত। সমগ্র ভারতের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ব্যানার্জি,চ্যাটার্জি,বোস,বসু,ঘোষদের ন্যায় বাঙালী হিন্দুর লেখা বই পড়ানো হত। উপমহাদেশের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ ছিল তাদের তুলনায় শিক্ষা,সাহিত্য,বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে অনেক পিছনে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ তাদের ভারত শাসনের কাজে প্রশাসনের যে লৌহ-কাঠামো গড়ে তুলেছিল তা এই বাঙালী বাবুদের নিয়েই।
প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন? সেদিন আর যাই হোক বাঙালী দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়েনি। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেনি। কেড়ে নেয়া হয়নি বিরোধীদের কথা বলা বা স্বাধীন ভাবে লেখালেখি করার স্বাধীনতা। পক্ষি-শিকারের ন্যায় বহু হাজার বিরোধীদলীয় কর্মীদের রক্ষিবাহিনীর দ্বারা হত্যা করা হয়নি। হরতালের নামে যাত্রিভর্তি বাসে আগুণ দেয়নি বা লগি বৈঠা নিয়ে রাস্তায় সেদিন মানুষ খুণ হয়নি। নিজ দেশের ৫৭ জন সামরিক অফিসারকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহকে বিকৃত করে পায়খানার ড্রেনেও ফেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ধর্ষণে সেঞ্চুরীই হয়নি –যেমনটি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ীমী লীগের অনুগত ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা হয়েছে। সেদিন বিদেশের পতিতাপল্লিতে ও ব্যাভিচারিদের গৃহে ভোগ্যপণ্যের ন্যায় ব্যবহারে হাজার হাজার বাঙালী নারী চালানও হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সেদিন বাঙালীর মানুষ হওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে আফসোস করেছেন। মুসলমান না হওয়ার কারণে ব্যর্থ মানুষদের সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের রায়টি কি -তা তিনি জানতেন না। মহান আল্লাহতায়ালা এরূপ ব্যর্থ মানুষদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে অতি কঠিন কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন,“উলায়িকা কা’আল আনয়াম,বাল হুম আদাল” অর্থঃ তারা হলো গবাদী পশুর ন্যায়,বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বুঝাতে চেয়েছেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে যারা বিশ্বাস করে না এবং তাঁর প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকীম বেয়ে যারা পথ চলে না তারা শুধু পশুর ন্যায়ই নয়,ব্যর্থ হয় পশুসুলভ গুণাবলী পেতেও। যারা দুর্বৃত্তির পথে চলায় অন্যসব পাপীষ্ঠদের হারিয়ে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হতে পারে, নীচে নামার সে যাত্রা-পথে তাদেরকে আর কে হারাতে পারে?
শিকার ধরার পর নিহতের লাশটি কোন পশুই ড্রেনে ফেলে না। ধর্ষণে পশুরা সেঞ্চুরিও করে না। এক লাশের বদলে বিপক্ষের দশ লাশ ফেলে না। যাত্রীভর্তি বাসে আগুণ দেয় না। পশুরা শিকার ধরে শুধু বেঁচে থাকার স্বার্থে, ক্ষুধা মিটে গেলে অন্য শিকার ধরে না। তাই জঙ্গলে গাদাগাদি করে লাশ পড়ে থাকে না। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়াই বাংলাদেশে লাশের ছড়াছড়ি। শেখ মুজিব একাই তার শাসানামলে বহু হাজার লাশ ফেলেছিলেন। শেখ হাসিনা নিজেও লাশ ফেলার রাজনীতি করছেন জোরেশোরে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলার। শত শত লাশ ফেলেছে জাসদ ও তার গণবাহিনী। সর্বহারার রাজনীতির নামে বহু হাজার লাশ ফেলছে মার্কসবাদী সন্ত্রাসীরা। পিলখানায় ৫৭জন অফিসারকে লাশ বানিয়েছে সেপাইরা। বার বার লাশ পড়ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বহুবার সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক মিছিলে। বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে। পত্রিকায় প্রকাশ,বাংলাদেশে প্রতিদিন লাশ হচ্ছে দশ জনের বেশী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক গ্লানিকর ব্যর্থতা। কিন্তু বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়,টিভি আলোচনায়,নাটকে ও সিনেমায় বা পাঠ্যপুস্তকে এ ব্যর্থতার কোন আলোচনা নেই। বরং এসব ব্যর্থতা চেপে রেখে দেশকে যারা তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে পরিনত করলো বা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বানালো তাদেরকে বাংলার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রূপে চিত্রিত করা হচ্ছে। সমাজে যখন দুর্বৃত্ত বা পাপাচারিরা বিজয়ী হয় তখন তাদের দুর্বৃত্তি ও পাপাচারের নিন্দা হয় না,বরং প্রশংসিত হয়। ডাকাতপাড়ায় এজন্যই ডাকাতি কর্মের নিন্দা হয় না। পতিতাপল্লিতে তেমনি নিন্দিত হয় না ব্যাভিচার। পাপাচার-কবলিত সমাজে পাপাচারের নেতা-নেত্রীগণ বরং বীর বা বীরঙ্গনা রূপে চিত্রিত হয়। নমরুদ,ফেরাউন,আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মত দুর্বৃত্তগণ তো সে কারণেই নিজ নিজ দুর্বৃত্তকবলিত সমাজে নেতা রূপে গৃহীত হয়েছে। একই কারণে বাংলাদেশে নেতৃত্বের আসন পেয়েছে ইসলামবিরোধী দুর্বৃত্ত নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণ। শুধু রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানই তাদের দখলে যায়নি,দখলে গেছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও স্কুল-কলেজের শ্রেণীকক্ষগুলোও। ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলোতে তাই দুর্বৃত্ত নেতাদের কুকীর্তিগুলোকে গৌরবময় করে দেখানো হয়।
অরণ্যের অরাজকতা
জঙ্গলে কেউ নিহত হলে খুনির শাস্তি হয় না। সেখানে আদালত নাই। বিচারক,উকিল এবং পুলিশও নেই। এক পশু আরেক পশুকে ধরিয়ে দেয় না,সাক্ষিও দেয় না। একই রূপ অরণ্যের অরাজকতা নেমে এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বহুশত আদালত আছে। বহুহাজার পুলিশ,হাজার হাজার উকিল এবং বহুশত বিচারকও আছে। তাদের পালতে রাজস্বের বিশাল অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু তাদের সামর্থটি কোথায়? সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, দেশে প্রতিদিন এগারো জন খুন হয়। কিন্তু দেশের আদালতগুলোর সবগুলো মিলে দিনে একজন খুনিরও কি শাস্তি দিতে পারছে? বিচার হচ্ছে রাজনৈতিক প্রয়োজনে। খুনি,চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীগণ জনগণের শত্রু,কিন্তু তারা সরকারের শত্রু নয়। ফলে তাদের বিচার নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। পুলিশ এবং আদালত ব্যস্ত সরকার বিরোধীদের দমনে। প্রকৃত খুনিরা তাই অভয় অরণ্য পেয়েছে বাংলাদেশকে। পিলখানা হত্যাকান্ডের খুনিদের গ্রেফতারে সরকার ঘটনার দিন কোন উদ্যোগই নেয়নি। ফলে দিন-দুপুরে রাজধানীর মধ্য দিয়ে শত শত খুনি অনায়াসে পালিয়ে যেতে পেরেছে, যেন খেলা দেখে ফিরছে। দুষ্টের দমন,ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ আছে এমন কোন দায়িত্বশীল সরকার কি অপরাধীদের গ্রেফতারে এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে? পাশেই ক্যান্টনমেন্ট,সেনাবাহিনীকে বললেও তারা সমগ্র পিলখানা ঘিরে ফিলতে পারতো। সরকার নিজের গদিরক্ষায় সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়, কিন্তু ৫৭ জন সেনা অফিসারদের বাঁচানোর জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়নি। দায়িত্বহীনতা আর কাকে বলে? অথচ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে সরকারের কোন আলসেমী নেই। নানা বাহানায় তাদের জেলে তোলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলাও দায়ের হচ্ছে। সরকারের বিশেষ আক্রোশ ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে। একাত্তরে অস্ত্র ধরেছে,কাউকে খুন করেছে বা ধর্ষণ করেছে সে প্রমাণ পুলিশের কাছে নাই এমন ব্যক্তিদের ধরে সরকার কাঠগড়ায় তুলছে। তাদের বিচারে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আদালত গড়ছে এবং বিচারক ও উকিলদের নিয়োগ দিচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারকগণের ব্যস্ততা তাদের ত্বরিৎ শাস্তি দেয়া নিয়ে। অথচ আজ যারা রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে নামছে,দিনদুপুরে মানুষ খুণ করছে,যাদের ছবি পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে,তাদের গ্রেফতার নিয়ে সরকারের কোন আগ্রহই নেই। সরকারের প্রায়োরিটি কোথায় সেটি বুঝতে কি এরপরও কিছু বাঁকি থাকে?
ডাকাতদের দস্যুতায় অনেকের ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাতে জাতি বিপাকে পড়ে না। কিন্তু জাতি সংকটে পড়ে যদি রাষ্ট্র ছিনতাই হয়।অথচ বাংলাদেশ সেরূপ ছিনতাইকারীদের মুখে বার বার পড়ছে। এসব ছিনতাইকারিরা কখনো বা সেনাবাহিনীর,কখনো বা রাজনৈতিক বাহিনীর লোক। কখনো বা ছিনতাই হয়েছে ভোটের মাধ্যমে,কখনো বা হয়েছে অস্ত্রের মাধ্যমে। যেমন বাকশালী মুজিব এসেছিল ভোটের মাধ্যমে। অপরদিকে স্বৈরাচারি এরশাদ এসেছিল অস্ত্র হাতে নিয়ে। কিন্তু মানবাধিকার পদদলনে ও গণতন্ত্র হত্যায় উভয়ের সন্ত্রাস ও স্বৈরাচার কি কোন পার্থক্য রাখে? মুজিব কেড়ে নিয়েছিলেন বাকস্বাধীনতা এবং হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্র। অথচ মানুষের ন্যূনতম মানবাধিকার শুরুই হয় কথা বলার অধিকার থেকে। সে অধিকারটুকু কেড়ে নেয়ার অর্থ হলো মানুষকে মানবতাশূণ্য করা। তিনি লুণ্ঠন করেছিলেন সভাসমিতি ও পত্রিকা প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাকশাল। একই অপরাধ করেছিল এরশাদ। মুজিবের বাকশালী দর্শন এবং এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারি দর্শনে কোন পার্থক্য নাই বলেই ২০০৮ সালে তারা আবার একাকার হয়ে গেছে। জাসদ ও জাসদের গণবাহিনীর সন্ত্রাসও ভিন্ন ছিল না মুজিব এবং এরশাদের সন্ত্রাস থেকে। পিলখানায় যেরূপ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার চেয়েও ভয়ানক হত্যাকান্ড শুরু করেছিল কর্নেল তাহের,হাসানূল হক ইনু,আব্দুর রব,সিরাজুল আলম খান –এসব জাসদ নেতারা। সেপাহীদের বিল্পবের নামে পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনী নির্মূলের। বহু অফিসারকে তারা হত্যাও করেছিল। গণবাহিনী গঠন করে হত্যা করেছিল বহু হাজার মানুষকে। এতবড় অপরাধের পরও তাদেরকের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং এরশাদের আমলে জাসদ গৃহপালীত বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। আর আজ শামিল করে নেয়া হয়েছে সরকারে। এরা সবাই একই ঝাঁকের কৈ,ফলে আজ ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে গেছে।
বেড়েছে মাছিচরিত্রের মানুষ
কোন স্থান কতটা অস্বাস্থ্যকর সেটি পরিমাপের সবচেয়ে সহজ মাপকাঠি হলো,সেখানে আবর্জনা বা মলমূত্র ফেললে কত দ্রুত কতটা মাছি উড়ে এসে বসে তা দেখে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে আবর্জনা ফেললেও তাতে মাছি বসে না। কারণ, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশামাছি জন্ম নেয় না। মশামাছি বেড়ে উঠার স্থানগুলোই নির্মূল করা হয়। অথচ সেগুলি পরিচর্যা পায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তেমনি দুর্বৃত্তকবলিত সমাজে বিপুল ভাবে বেড়ে উঠে দুর্বৃত্তরা,এবং তারা সারিবদ্ধ হয় দুর্বৃত্ত নেতাদের পিছনে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিণত হয় তাদের অধিকৃত প্রতিষ্ঠানে। অথচ উন্নত সমাজে কঠিন হয়ে পড়ে দুর্বৃত্তদের বেড়ে উঠা। নির্মূল করা হয় দুর্বৃত্তদের প্রতিষ্ঠান। ফলে উন্নত সমাজে দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারিগণ ভোট পায় না। সাহাবাদের আমলের ইসলামি রাষ্ট্রে আবু জেহল ও আবু লাহাবের মত দুর্বৃত্তরা তাই বাজার পায়নি। বস্তুত একটি রাষ্ট্র কত্টা মানবতাশূণ্য ও দুর্বৃত্তকবলিত সেটি বুঝার জন্য শুধু পতিতাপল্লি বা ডাকাত পাড়ার দিকে তাকানোর দরকার পড়ে না। প্রেসিডেন্ট ভবন,প্রধানমন্ত্রী ভবন বা মন্ত্রীপাড়ার দিকে নজর দিলেই সেটি স্পষ্ট বুঝা যায়। বুঝা যায় প্রশাসনের দিকে তাকালে। সেটি আরো বুঝা যায় নির্বাচনে দুর্বৃত্ত প্রার্থীগণ কতটা ভোট পায় তা দেখে। দেহের তাপমাত্রা মাপার জন্য যেমন থার্মোমিটার,তেমনি একটি দেশের মানুষ মানবিক বা নৈতিক পরিচয়ে কতটা পিছিয়ে আছে সেটি মাপার মাপকাঠি হলো দূর্নীতি। যে দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয় সে দেশের নৈতিকতার দুরবস্থা বুঝতে কি অন্ধেরও অসুবিধা হয়? বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের সে নৈতিক পরিচয়টি একবার নয় পর পর পাঁচবার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মূল সমস্যা ভূমি,ভুগোল বা জলবায়ু নয়,বরং মাছি চরিত্রের মানুষ। এদের সংখ্যা বিপুল। দিন দিন সে সংখ্যা আরো দ্রুত বাড়ছে। আবর্জনার দিকে ছুটে যাওয়া থেকে মাছিকে রুখা যায় না,তেমনি মাছি চরিত্রের মানুষদের রুখা যায় না লোভ-লালসা ও স্বার্থশিকার থেকে। এরশাদের মত প্রমাণিত স্বৈরাচারি,দন্ডিত অপরাধী এবং চরিত্রহীন ব্যক্তি যেভাবে ৫ সিট নির্বাচিত হয় তাতে কি বুঝতে বাঁকি থাকে বাংলাদেশের মুল সমস্যাটি কোথায়? প্রশ্ন হলো,আজ যদি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কোন রাসূল কোরআনের শরিয়তি বিধান নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হতেন তবে ক’জন তাঁকে সমর্থণ করতো? ক’জন তাঁর দলকে বিজয়ী করতো? ক’জন শরিয়তের পক্ষ নিত? আজ কোন নবী-রাসূল নেই,কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সে কোরআনী শরিয়ত তো রয়ে গেছে। সে শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠাই বা ক’জন সমর্থণ করছে? দেশের আদালতে তো বিজয়ী হয়ে আছে ব্রিটিশের কুফরি বিধান। মুসলমান রূপে বাংলাদেশীদের এ কি বিশাল ব্যর্থতা নয়? সে ব্যর্থতা নিয়েই বা হুশ ক’জনের? এ ব্যর্থতা নিয়ে কেউ কি পরকালে সফলতা পাবে?
বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা,টিভি,গল্প-উপন্যাস ও স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ভুয়সী প্রশংসা করা হয় একাত্তরের চেতনার ধারকদের। সে চেতানধারীদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে জাহির করা হয়। কিন্তু সে বিশেষ চেতনাধারি ব্যক্তিবর্গ কারা? কি তাদের চরিত্র? বাংলাদেশের ইতিহাসে কে প্রথম গণতন্ত্র হত্যাকারি? কে বাকশালী স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠাতা? কে ভারতের সাথে ২৫ সালা দাসচুক্তি করে? কার আমলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে আসে যাতে বহু লক্ষ মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায়? ৭ই নভেম্বরে সিপাহী বিপ্লবের নামে যারা সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা শুরু করেছিল তারাই বা কারা? রক্ষিবাহিনী, গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টির নামে হাজার হাজার মানুষকে নৃশংস ভাবে কারা হত্যা করেছে? স্বৈরাচারি এরশাদের আমলে কারা গৃহপালিত বিরোধী দল সেজে গণতন্ত্রের সাথে মস্করা করেছে? কারা জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মঈনকে সমর্থণ করেছে? বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বিষয়গুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে এগুলো আলোচিত হয়নি। দেশবিদেশের ভূগোল,জলবায়ু,জীবজন্তু বা কীটপতঙ্গের জীবনী পড়ানোর চেয়ে এ বিশেষ বাঙালী জীবদের প্রকৃত ইতিহাস পড়ানো কি বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়? শাপকে শাপ,বিষকে বিষ রূপে না চিনলে বাঁচাটি নিরাপদ হয় না। তেমনি জাতির দুর্বৃত্তদের না চিনলে জাতিরও কল্যাণ হয় না। হিটলার,হালাকু,চেঙ্গিজ ও মীরজাফরদেরকে মহামানব রূপে চিত্রিত করা শুরু হলে সে জাতির সাধারণ মানুষও তাদেরকে অনুকরণীয় মডেল চরিত্র রূপে গ্রহণ করে। ছাত্ররা তখন তাদের মত হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ভাবে। দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার পক্ষ থেকে বিষাক্ত শাপকে ভগবান রূপে কীর্তন গাওয়া শুরু হলে সাধারণ মানুষ তখন শাপকে পুঁজা দেয়া শুরু করে। বাংলাদেশে সে কাজটি প্রচণ্ড ভাবে হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র-হত্যাকারিও জাতির পিতা রূপে গৃহীত হয়েছে। এবং বিপুল ভোট পায় তাঁর অনুসারিরা। সমগ্র পৃথিবীতে সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ হওয়ার যে অপমানটি বাংলাদেশের জুটেছে,সেটি ভূমি বা জলবায়ুর কারণে নয়। বরং সে জন্য দায়ী দেশবাসীর রুগ্ন চেতনা-চরিত্র ও মূল্যবোধ। সে রুগ্নতাটি এসেছে রুগ্ন চরিত্রের মানুষদের মডেল চরিত্র রূপে গ্রহণ করার কারণে। একাত্তরের চেতনাধারীরা এভাবে জাতির গলায় বিশ্বজোড়া অপমানের মালা পড়িয়ে দিয়েছে।
রুগ্নতা সর্বস্তরে
ব্যক্তির রুগ্নতা গোপন থাকে না। শ্বাসকষ্ট,জ্বর,দুর্বলতা বা পঙ্গুত্ব নিয়ে সেটি সবার সামনে হাজির হয়। জাতির রুগ্নতা তেমনি ধরা পড়ে বিবেকহীনতা,নীতিহীনতা,অপরাধ-প্রবনতা,মিথ্যাচার,স্বৈরাচার,সন্ত্রাস ও নানারূপ দুর্বৃত্তির মধ্য দিয়ে। বাঙালীর জীবনে সে রুগ্নতা আজ ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে যেভাবে খুন করা হলো সেটি নিজেই কোন রোগ নয়,বরং বিবেকে বেড়ে উঠা ভয়ানক অসুস্থ্যতার লক্ষণ। অফিসারগণ কি অপরাধ করেছিল যে তাদেরকে খুন করে এবং দেহকে বিকৃত করে লাশগুলোকে পায়খানার নর্দমাতে ফেলতে হবে? বিগত দুই বিশ্বযুদ্ধে বহু কোটি মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোন রণাঙ্গণেই এত অফিসারকে একদিনে প্রাণ দিতে হয়নি। কোন শত্রু অফিসারকে লাশ হয়ে পায়খানার ড্রেনেও যেতে হয়নি। শত্রু বাহিনীর অফিসারের লাশের সাথে এমন অবমাননা হিটলারের সৈন্যরাও করেনি। বস্তুতঃ পিলখানায় সেদিন শুধু লাশকে ড্রেনে ফেলা হয়নি,ড্রেনে ফেলা হয়েছে মানবতাকে। আর সেটি কোন দুর্বৃত্ত ডাকাতদের হাতে নয়। বরং তাদের হাতে যারা প্রতিদিন দেশবাসীর রাজস্বের অর্থে প্রশিক্ষণ পেয়েছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে। খুণ,রাহাজানি বা সন্ত্রাসের ন্যায় জঘন্য অপরাধ কোন ভদ্র লোকালয়ে হলে বিপদগ্রস্তদের সাহায্যে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। মানুষ খুন,ছিনতাই বা ধর্ষণ গরু-ছাগলের সামনে হলে তাদের ঘাস-পাতা খাওয়ায় ছেদ পড়ে না। উদ্ধারে তারা এগিয়েও আসে না। তেমনি অবস্থা হয়েছিল সেদিন ঢাকায়। রাজধানীর কেন্দ্রে বহু ঘন্টা ধরে খুন,ধর্ষণ ও লুটতরাজ চললেও কোন নিরাপত্তা বাহিনীই সেদিন এগিয়ে আসেনি। সরকারও কোন উদ্যোগ নেয়নি। বরং খুনিদের সাথে সরকার নিস্ফল আলোচনায় বসেছে। এই হলো বাংলাদেশের সরকারের পরিচয়। সরকার তার কুৎসিত চরিত্র সেদিন আড়াল করতে পারিনি। এমন একটি সরকার থেকে জনগণ আর কি আশা করতে পারে?
আরো লক্ষণীয় হলো,এমন বিবেকহীনতা যে শুধু পিলখানায় ঘটেছে তা নয়। এমন অপরাধ যে কিছু সেপাই,কিছু দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী এবং কিছু রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে ঘটছে তাও নয়।বরং একই রূপ বিবেকহীনতা বিরাজ করছে তাদের মাঝেও যাদের হাতে অধিকৃত দেশের প্রেসিডেন্ট ভবন,প্রধানমন্ত্রী ভবন ও সংসদ ভবন। তাদের হাতে যে শুধু মানুষ হত্যা হয়েছে বা হচ্ছে তা নয়,বরং পদদলিত হয়েছে এবং হচ্ছে ন্যূনতম মানবিক অধিকারও। এক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষ্যটি বড়ই করুণ এবং শিক্ষাপ্রদ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে তাঁরই হাতে সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবেচেয়ে জঘন্য অপরাধ,তাঁর হাতে নিহত হয়েছে গণতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকশালী স্বৈরাচার। জনগণের সামনে নেতাগণই হলো আদর্শ,তাদের কাছ থেকে কর্মীগণ পায় রাজনীতির দর্শন, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতি ও সংস্কৃতি তাই স্বৈরাচারি নেতা থেকে শেখা যায় না। খোদ দলীয় নেতাটি যখন বিরোধীদলের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেন,তখন তার দলের কর্মীগণ তো বিরোধীদের বেঁচে থাকাটিই অসম্ভব করে। বাংলাদেশে তো সেটাই ঘটছে। মুজিব-অনুসারিদের হাতে একারণেই ঢাকার রাস্তায় দাড়ি-টুপিধারিদের লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যার মত ঘটনা ঘটেছে।
খুনিদের পক্ষ নেয়ার রুচি ভদ্রলোকের থাকে না,সেরূপ রুচি তো খুনিদের।।যে কোন সভ্য দেশে সভ্য মানুষ মাত্রই খুনিদের শাস্তি চায়। এজন্যই জনগণের রাজস্বের বিপুল অর্থব্যয়ে আদালত বসে। সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব আদালতের বিচারকে দ্রুত,সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ করা।কিন্তু সেরূপ রুচি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের যেমন নাই,প্রধানমন্ত্রীরও নাই। তাই খুনের মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত বহু অপরাধীর শাস্তি প্রেসিডেন্ট মাফ করে দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনা তো এক লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলতে বলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজাপ্রাপ্ত খুনীর শাস্তি মাফ করতে বাধ্য করেছিলেন স্বৈরাচারি এরশাদকে। কারণ সাজাপ্রাপ্ত খুনিরা ছিল তার দলের ছাত্রকর্মী। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইটের উপর মাথা রেখে ইট দিয়ে মাথা থেথলিয়ে হত্যা করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুইজন কর্মীকে। আদালতে সে অপরাধ প্রমানিত হয়েছিল এবং খুনিদের শাস্তিও হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে সে শাস্তি পছন্দ হয়নি। খুনিদের প্রতি শেখ হাসিনার দরদের সে ইতিহাস এবং তাদের মুক্তি নিয়ে তাঁর আপোষহীন আব্দারের কাহিনী লিখেছেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান তাঁর আত্মকথা-মূলক বইতে। খুনিদের মাফ না করলে আলোচনায় বসবেন না -সেটিই ছিল শেখ হাসিনার আবদার। আওয়ামী বাকশালীদের সে বিবেকহীনতা শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার একার নয়। সে বিবেকহীনতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী। তারই ফল,আগুন দেয়া হয়েছে যাত্রীভর্তি বাসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা বার বার লাশ হচ্ছে। মানুষ খুন হচ্ছে রাজপথে।একই রূপ নৃশংস বিবেকহীনতা একাত্তরে দেখা গেছে বিহারীদের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার বিহারীকে যেমন হত্যা করা হয়েছে,তেমনি তাদের ঘরবাড়ী,দোকানপাঠ ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে আত্মসাৎ করা হযেছে। সে বর্বরতার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্য থেকে যেমন প্রতিবাদ উঠেনি,তেমনি প্রতিবাদ উঠেনি বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেও। অথচ যে কোন সভ্যদেশে সেটি কাঙ্খিত। একাত্তরের যুদ্ধের তান্ডব ১৬ই ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়নি একাত্তরের চেতনার বাঙালী তান্ডব। নর্দমার পাশে বস্তিতে বাস করে সেটিরই স্বাক্ষর বিগত ৪০ বছরেরও বেশী কাল ধরে বিহারীরা বহন করছে। তবে রোগের ভাইরাস শুধু রুগ্নব্যক্তির দেহে সীমিত থাকে না,সেটি দ্রুত অন্যদের দেহেও প্রবেশ করে। রোগ তো এভাবেই ভয়ানক মহামারি ঘটায়। সেটি ঘটে মানবিক বা চারিত্রিক রোগের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের মানবিক সমস্যাটিতে তাই শুধু পেশাদার খুনি বা সন্ত্রাসীদের রোগ নয়,বরং তাতে প্রবলভাবে আক্রান্ত সমগ্র দেশ। বাংলাদেশের সমস্যা কোথায় সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে?
Source: Dr Firoz Mahboob Kamal