একটি জাতির আত্মহত্যার মহড়া
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠণ করা হবে বলে সংসদ ও জাতিকে অবগত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার কথার সূত্র ধরে তথ্যমন্ত্রী ইনু আরো সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, ঈদের পরপরই এই বিশেষ ট্রাইবুনালের কাজটি শুরু করা হবে। আমাদের সংবিধানের যে অলিগলি বা চোরাগলি এবং আমাদের সার্বিক নীরবতা আজ শেখ হাসিনা ও ইনুকে এই মহা শক্তি সালী করেছে তা আলোচনা করা জরুরি।
২০২১ সাল খায়েশান্তরে ২০৪১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সমস্ত পথের কাঁটা সরাতে এই ধরনের বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠণের কোন বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে শুধু এই ধরনের ট্রাইবুনাল গঠনেই হাসিনা -ইনুরা সক্ষম নন, তার পটভূমি রচনার সমস্ত উপায় এবং কলা কৌশলও তাদের পূর্ণ এখতেয়ারে রয়েছে। চাহিবামাত্রই অনুগত প্রশাসন, পুলিশ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীর আড়ালে সংস্কৃতি ও বিনোদন জগত এবং নিজের বিশাল কর্মীবাহিনী এই পটভূমি রচনায় নিজ নিজ সার্ভিসটুকু দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলনকে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিতে এখন আর মাশাল্লাহ কোন সময় লাগবে না। পৃথিবীর বড় বড় স্বৈরাচার যে ধরনের নিষ্ঠুর উপায়ে বিরোধী শক্তিকে দমন করেছে, শেখ হাসিনার কৌশল তা থেকে ভিন্ন নয়।
বিষয়গুলি অনেক আগে থেকেই আমরা বলতে চেষ্টা করেছি। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই হুমকি দেয়ায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য টুকু আরেকটু খোলাসা হয়ে পড়েছে। স্পষ্ট হয়েছে যে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে সৃষ্ট এই ট্রাইবুনালই শেষ ট্রাইবুনাল নয়, এটা শুরু মাত্র।
১৯৭১ সালে যে বাঙালি মেজর সাহেব সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাক বাহিনীকে কমান্ড করেছেন, সেই প্রাণ কোম্পানীর মালিক তুরিন আফরোজদের তুড়ি মেরে সহি সালামতেই নিজের জন্যে স্বাভাবিক মৃত্যুকে নিশ্চিত করে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এক খানা শোকবাণীও তার থালার মত বড় কপালে জুটে গেছে। কাজেই অপার রহস্যটি বুঝতে বড় বড় দার্শনিক বা বুদ্ধিজীবী হওয়ার দরকার নেই।
কিন্তু সমস্যা হলো কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না, বলে না। কাজটি শুরু করা হয়েছে মহান স্বাধীনতার আবেগ মিশ্রিত যুদ্ধাপরাধের বিচারটি দিয়ে। এটা নিয়ে সামান্য উসখুস করলে ‘অন্য’ অর্থ হয়ে যেতে পারে। সবকিছু বুঝেও, সবকিছু জেনেও দেশের বিবেক বলে ঘোষিতরা চুপ মেরে রয়েছেন। ফলে সংবিধান ও দেশের বিচার ব্যবস্থার যতটুকু ক্ষতি করার তা করা সম্পন্ন হয়ে গেছে। দেশের মানুষকে স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে একমাত্র যে নেত্রী রয়েছেন, তিনি নিজেও অাজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছেন।
কাজেই এ কাজটি ( খালেদা জিয়ার জন্যে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠণ ) এখন শেখ হাসিনার জন্যে আসলেই পানি ভাত হয়ে পড়েছে। সংবিধানকে কাঁটাছেড়া করে এমন অবস্থায় নেয়া হয়েছে যে, এখন তা ১৬ কোটি মানুষকে রক্ষা করার চেয়ে একজন ব্যক্তির মর্জি, খায়েশ বা বাসনা পূরণের হাতিয়ার হয়ে পড়েছে। এর ভয়াবহ পরিণতি এখনও আমাদের অনেকের উপলব্দিতে আসছে না, বরং এখনও শৃগালের মত ভাবছি, গাছের আগায় পানি উঠলে দেখি কাক(রাজাকার) কী করে থাকে?
বিবেক ও সকল মানবিক প্রজ্ঞা আজ আত্মবিধ্বংসী চেতনা, সুবিধাবাদ ও অন্ধ আক্রোশের কাছে হার মেনেছে। সংবিধানের মূল স্পিরিটকে অবজ্ঞা করার যে প্রবণতা নতুন করে শুরু হয়েছে তা ষোল কোটি মানুষকে যারপরনাই নিরাপত্তাহীন ও অরক্ষিত করে তুলেছে। এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতাটি যদি আমাদের সার্বিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞায় প্রতিরোধ করতে না পারি, তবে আমাদের জন্যে সামনে ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করে আছে ।
আমাদের সংবিধানে কিছু অনুচ্ছেদ আছে , যেগুলিকে বলা যায় সংবিধানের Pole Star বা ধ্রুবতারা । এই ধ্রুবতারাগুলি কারো জন্যে স্থান বা জায়গা পরিবর্তন করবে না। এগুলি আসলেই ষোল কোটি মানুষের রক্ষাকবজ। নিজের সুবিধা মত সংবিধানকে কেউ যেন ব্যবহার না করতে পারে তজ্জন্যে এই ধারাগুলি ধ্রুবতারার মত সব সময় একই জায়গা থেকে আলো বিতরন করে যাচ্ছে। তবে আমাদের সীমাহীন অজ্ঞতা, অমার্জনীয় নীরবতা ও অজানা ভীতি সেই আলোটির মাঝখানে একটি মেঘ তৈরি করে দিয়েছে। আর এ কারনেই আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে এই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, আমাদের সংবিধানের সেই অমূল্য রত্নগুলির দিকে একবার চোখ বোলান। তাহলেই বুঝতে পারবেন কেন এই ধারাগুলিকে সংবিধানের পোল স্টার বা ধ্রুবতারা বলা হচ্ছে।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের দফা (২) তেমনি একটি ধ্রুবতারা। এখানে বর্ণিত আছে :
জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। “
তেমনিভাবে অনুচ্ছেদ ৩১- এ উল্লেখ আছে :
আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইন অনুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন,স্বাধীনতা,দেহ,সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
এই শব্দগুলি আসলেই সংবিধানের প্রাণ। এগুলির সাথে যদি, কিন্তু, যেহেতু, সেহেতু ইত্যাদি যোগ করা যাবে না। অন্য কোন দফা বা ধারা দিয়ে এই প্রাণের স্পন্দনটি নষ্ট করা যাবে না। এই রক্ষাকবজের জন্যে আজ যেমন শেখ হাসিনা বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে নিজের খায়েশ মত ট্রাইবুনাল গঠণ করতে পারেন না তেমনি কোন রাজনৈতিক পালাবদলে বেগম খালেদা জিয়াও ভবিষ্যতে একই ধরনের কাজ করতে পারবেন না ।
অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয়, সাংবিধানিক এই রক্ষাকবজগুলির কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচারের মত একটি মহৎ কাজ করতে গিয়েই সাংবিধানিক এই রক্ষাকবজগুলিকে আরো বেশি করে অসার বা অকেজো করে ফেলা হয়েছে। যে খেলাটি ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ( মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদের অক্সিলারি ফোর্সদের বিচার করা হচ্ছে) নিয়ে শুরু হয়েছে অচিরেই তা অন্যদের নিয়ে শুরু হবে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠণের হুমকি তারই অংশ। কাজেই বাবা মারা গেছে সেটা নিয়ে তেমন দুঃখ নেই। টেনশনটা হলো যম যে বাড়ি চিনে গেছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর দফা ২ এর উপর ভিত্তি করেই সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে চিন্তা করলে যে যুক্তিতে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল হয়েছে সেই একই যুক্তিতে ৪৭ (৩) ও ৪৭ক এর (১) ও (২) দফা বাতিল(Void) হয়ে যায় । আকাশের ধ্রুবতারা মত সংবিধানের ৭(২) ও ৩১ অনুচ্ছেদ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্যে জায়গা পরিবর্তন করবে না। কারন এই দফাগুলির কারনে যারা বা যাদের নিকট পরিজন সুবিচার পায় নি বলে মনে করছে ( জুডিশিয়াল কিলিং বা সাংবিধানিক কিলিং গণ্য করছে) তারা ভবিষ্যতে কোন আদালতের শরনাপন্ন হলে ইতোমধ্যে সৃষ্ট রায়ের নমুনা ( Anwar Hossain Vs Bangladesh 41 DLR (AD)) এবং উথ্থাপিত এই প্রশ্নগুলি এড়ানো কঠিন হবে । কারণ, এ সরকারই শেষ সরকার নয় এবং এ আদালতই শেষ আদালত নয়। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছেন তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে সবকিছু একদিন এই ভাবে পাল্টে যেতে পারে। ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নিই না। এদেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, কোন একটি দল বা গোষ্ঠিকে আজীবনের জন্যে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
আরো একটা বিষয় সাংবিধানিক ও আইনগত প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে, আইন মন্ত্রণালয়ের ২৫শে মার্চ ২০১০ এবং ২২শে মার্চ ২০১২ তে প্রকাশিত দুটি গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উক্ত নিয়োগের মাধ্যমেও প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। নজর দিন সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদের দফা (৩) এ। সেখানে স্পষ্ট বর্ণিত অাছে, এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বিধিসমূহ সাপেক্ষে কোন্ কোন্ বিচারক লইয়া কোন্ বিভাগের কোন্ বেঞ্চ গঠিত হইবে এবং কোন্ কোন্ বিচারক কোন্ উদ্দেশ্যে আসন গ্রহণ করিবেন, তাহা প্রধান বিচারপতি নির্ধারন করিবেন।
এবং
৯৪ অনুচ্ছেদের দফা (৩):
প্রধান বিচারপতি এবং আপীল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করিবেন। ‘
আইসিটির এই দুর্বলতাগুলি নিয়ে
বিভিন্ন অান্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থা তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করলেও সরকার তাতে কোনরূপ কান দেয় নি ।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে ৪৭(৩) ও ৪৭ক অনুচ্ছেদের ১ ও ২ দফাটি তুলে ধরা হলো।
৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বর্ণিত অাছে, এই সংবিধানে যাহা কিছুই বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং অান্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্যে কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দিকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারনে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না। ‘
অনুচ্ছেদ ৪৭ক এর ১ দফায় বর্ণিত
যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকার সমূহ প্রযোজ্য হবে না।
অনুচ্ছেদ ৪৭ক এর ২ দফায় বর্ণিতঃ এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’
এখন মনে হচ্ছে, যে ধারাগুলি দিয়ে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে সেই ৪৭ (৩), ৪৭ক এর (১) ও (২) এর অনুরূপ কোন খড়গ বেগম জিয়া এবং তার দলের অন্যান্য নেতাদের উপর প্রয়োগ করা হবে। এই সিলসিলা যদি শুরু হয়ে যায় তবে এই ভূখন্ডে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রত্যেকটি দল চাইবে তার বিরোধী পক্ষের উপর ৪৭(৩) এবং ৪৭ক এর (১) ও (২) প্রয়োগ করতে। মনে হচ্ছে, জাতি হিসাবে আমরা এক আত্মহত্যার মহড়া শুরু করে দিয়েছি।
কোন দল পারবে না অন্য কোন জন সম্পৃক্ত দলকেই সমূলে বিনাশ করতে। এই বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করব ততই আমাদের মঙ্গল হবে। এদেশে সবাইকে নিয়ে এক সাথে থাকতে হবে।
ওপরের এই সব সাংবিধানিক ধারা ও আইনের বাইরেও কিছু কথা রয়েছে। মানুষের জন্যেই আইন, আইনের জন্যে মানুষ নয়। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে সারা পৃথিবী মাতোয়ারা। কিন্তু সেই নেলসন ম্যান্ডেলার অনেক আগেই প্রথমে বঙ্গবন্ধু ও পরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমার বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমার মূল কাজটি করে গেছেন এবং পরবর্তিতে তার ফিনিশিং টেনেছেন শহীদ জিয়া। ‘বাঙালি ক্ষমা করতে জানে’ বলে বড় গলায় বড়াই করে গেছেন। সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী ভুট্টোর সাথে গলাগলি করে বিষয়টির সমাপ্তি টানতে চেয়েছেন। আমাদের মহান এই দুজন নেতাই পরবর্তিতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু কেউ কোন যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকার কর্তৃক নিহত হন নি।
এই ধরনের যুক্তি দেখালে অনেকেই পাল্টা প্রশ্ন করেন , তিনি সবাইকে ক্ষমা করেন নি। যারা সরাসরি হত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণের মত কাজ করেছে বঙ্গবন্ধু সেই সব অপরাধীদের ক্ষমা করে যান নি। যারা এসব অপরাধ করেছিল অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে ভিক্টিমরা তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭৩ সালের কোলাবেরটর বা দালাল আইনে যে ২৮ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, আজকের অভিযুক্তদের ( জামায়াত ও বিএনপি থেকে অভিযুক্ত) একজনও সেই তালিকায় ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তখনকার চিফ প্রসিকিউটর খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার এই দাবিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। ডিজিটাল এই যুগে বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রাখার সুযোগ নেই। সরকার যাকে বহির্বিশ্বের চাপ বলছে তা মূলত আন্তর্জাতিক মহলের যথাযথ উদ্বেগ।
মাইকেল ক্রস নামক এক ব্রিটিশ নিউজ এডিটর লিখেছেন, Beyond the obvious point that any miscarriage of justice involving the death penalty should be a matter of concern , the Dhaka tribunal raises two issues. One is the abuse of the term ‘ international’ which should be reserved for war crimes proceedings under genuinely international jurisdiction. The other is the potential for political over-spill. Jamaat-e-Islami is a political force in some parts of UK , and while I have little sympathy with its members I would not like them to be handed a victim card to play.
অর্থাত্—স্পষ্টতই ন্যায়বিচারের কোনো রূপ স্খলন হেতু যদি কোনো মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তবে তা আন্তর্জাতিক মহলের জন্য দারুণ উদ্বেগের কারণ হবে। ঢাকার ট্রাইব্যুনালটি দুটি প্রশ্নের উদ্রেক করে। প্রথমটি হলো আন্তর্জাতিক শব্দটির অপব্যবহার। কারণ এই পরিভাষাটি শুধু আন্তর্জাতিক জুরিসডিকশনের তদারকিতে অনুষ্ঠিত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জন্যই সংরক্ষিত থাকা উচিত। অন্যটি হলো সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। জামায়াতে ইসলামী যুক্তরাজ্যের কোনো কোনো অংশে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এদের সদস্যদের প্রতি আমার খুব সামান্যই সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু এরা কারও হাতে অবিচারের শিকার হোক তা আমি চাই না।
মাইকেল ক্রস তার সেই নিবন্ধে নুরেমবার্গ বিচারের প্রধান প্রসিকিউটর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসনের একটি উদ্ধৃতি টেনেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের আগে আগে রবার্ট জ্যাকসন বলেছিলেন, It would be better to shoot Nazi leaders out of hand than pervert the process of law by setting up a sham court. তিনি আরও বলেছেন, You must put no man on trial under the forms of judicial proceedings if you are not willing to see him freed if not proven guilty.
অর্থাত্—‘প্রহসনের আদালতে বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিকৃত বা কলঙ্কিত করার চেয়ে অভিযুক্তদের কোনো বিচার ছাড়া গুলি করে মেরে ফেলাই উত্তম।’ আর ‘যদি অপরাধ প্রমাণিত না হলে অভিযুক্তকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুুত না থাক, তবে কাউকে বিচারের আওতায় এনো না।’
আজ পুরো পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হচ্ছে। যে বিশেষ ট্রাইবুনালে মৃত্যুদন্ডের মত চূড়ান্ত সাজা দেয়া হচ্ছে তার খুটি নাটি প্রত্যেকটি বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ পড়ছে।
এই আদালত কর্তৃক মৃত্যু দন্ডের দুটি রায় ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। কয়েকজন কারাবস্থায় মৃত্যুবরন করেছেন। কাজেই আমাদের পক্ষে এর মধ্যবর্তি একটি ফলাফলটি অনুধাবন করা সহজ হয়েছে।
এখন কয়েকটি প্রশ্ন ,
১) এই দু’জনকে ফাঁসি দেয়ার ফলে কি সমাজে আইনের শাসন ( যা এই বিচারের মূল উদ্দেশ্য বলে প্রচার করা হয়েছে ) আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে ?
২) নারীদের উপর যে সহিংসতা বা ধর্ষণ এখনও অব্যাহত রয়েছে , অভিযুক্ত বাকি কয়েকজনকে ফাঁসি দিলে কি সমাজ থেকে ধর্ষণ কর্মটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা কমে যাবে ?
৩) এদের কয়েক জনকে ফাঁসি দিলে কি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণটা কমে যাবে কিংবা শেয়ার বাজারের লুন্ঠিত টাকা ফেরত পাওয়া যাবে ?
৪) এদের গলায় দড়ি ঝোলালে কি সমাজে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, হত্যা কমে যাবে ?
উপরের বেনিফিটগুলি না আসলেও
একক জাতি সত্ত্বার চমৎকার এই রাষ্ট্রটি স্হায়ীভাবে দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ছে। আমার বন্ধুরা যারা দেশে কিছু সহায় সম্পদ কিনেছিল এবং একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে একদিন এই দেশে ফিরে আসবে তারা সেই সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। দেশে মোটামুটি ভালো চাকুরি থাকার পরেও বিদেশে চলে যাওয়ার পায়তারা অনেকেই করছেন । ১৯৯১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই দেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতে পেরেছি তা আজ হতাশায় আচছন্ন হয়ে পড়েছে।
অাসুন এসবের পেছনে মূল কারনটি খুজে বের করি। গুটি কয় মানুষের ‘হাড় কড়মড়ে ‘ রোগ ( সতীনের ছেলেকে কতলের নিমিত্তে বিছানার পাটির নিচে কঞ্চি রেখে রাণীর সেই রোগের মত) সারানোর জন্যে পুরো জাতিকে এই অবস্থায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। সামনের হানাহানিটুকু আরো স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
এই অবস্থা থেকে এখনও যারা দেশটিকে উদ্ধার করতে পারেন তাদের কাছে একান্ত নিবেদন, এই দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। কয়েকজন মানুষকে কতলের উদ্দেশ্যে আমাদের সকল মানবিক প্রজ্ঞা ও বিবেককে যেন কতল না করে ফেলি। এরা যদি জুলুমের শিকার হন তবে এদের আত্মার অভিশাপ পড়বে সারা জাতির উপর।
আমাদের আজকের অবস্থা নিঃসন্দেহে আমাদের সম্মিলিত পাপের ফসল। ষোল কোটি মানুষ ও তাদের অনাগত বংশধরদের রক্ষাকবজ সংবিধানের ধ্রুবতারাগুলির সম্মুখের মেঘগুলি সরিয়ে ফেলুন। তা না হলে ইতিহাস আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না বা ছাড়বে না। কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্যে কাজ করার দরকার নেই। আমাদের সংবিধানের পোল স্টার বা ধ্রুবতারাগুলিকে শুধু আপন মহিমায় জ্বলতে দিন। পুরো জাতি যে আত্মহত্যার মহড়ায় শামিল হয়েছে, তা থেকে এ জাতিকে উদ্ধার করুন।