‘রেড ক্রস’ থেকে ‘রেড ক্রিসেন্ট’ হতে পারলে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ থেকে ‘ভালোবাসা দিবস’ হতে অসুবিধা কোথায় ?

Minar Rashid

বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচীব ও প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী জনাব শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের লেখাগুলি আমি সব সময় মনোযোগ দিয়ে পড়ি । দুয়েকবার সরাসরি দেখাও হয়েছে। একবার আমার মেরিন একাডেমির এক ব্যাচমেইট ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা নিয়ে কিছু জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করেন । এই বিষয়ে নিজের জ্ঞান খুবই সীমিত হওয়ার কারণে এবং প্রশ্নটি জটিল মনে করায় বন্ধুটিকে তাঁর মত একজন বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়াকেই সঠিক মনে করেছিলাম ।

বন্ধুটি সেক্যুলার জীবন ধারায় অভ্যস্ত থাকলেও ইসলামের মানবিক দিক গুলির প্রতি বরাবর আকৃষ্ট ছিলেন । তাদের বিয়ের প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহে বিয়ের বার বা দিনটিতে বিবাহ দিবস পালন করতেন । তবে এভাবে কতদিন কন্টিনিউ করেছিলেন – সেই খবরটি পরে আর নিতে পারি নি ।
যাই হোক সেই বন্ধুটির মনে প্রশ্ন জাগলো , যাকাতের টাকা ব্যবহার করে দারিদ্র বিমোচনের মত কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহন করা যায় কি না ।
জনাব শাহ আব্দুল হান্নান অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন , একটা সমাজ আর্থিক ভাবে যতই অগ্রসর হোক , কিছু অভাবী ও দু:খী মানুষ সেই সমাজে অবশিষ্ট থাকবেই । কিছু মানুষ শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমাজের অন্য মানুষদের থেকে পিছিয়ে থাকবে । এই যাকাত সেই সব প্রান্তিক , দু:খী ও হতভাগা মানুষদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । এটা দিয়ে অন্য কিছু করার সুযোগ নেই । ‘
তাঁর এই বক্তব্য শুনে বন্ধুটি তার সেই ভাবনা থেকে সরে আসে ।
জনাব শাহ আব্দুল হান্নানের ‘অশ্লীল সংস্কৃতি ও ভ্যালেন্টাইন ডে ‘ লেখাটির উপর অন্যান্য অনেকের মত আমারও মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের এই টালমাটাল সময়ে তাঁর এই দিক নির্দেশনামূলক আলোচনা অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে ।

কিন্তু দিবসটিকে ঘিরে ধর্মীয় বলয় থেকে অনেকের আক্রমণের ভঙ্গি ও ভাষা আমার কাছে ভালো লাগে নি । আপনার পছন্দ না হলে পালন করবেন না , কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আক্রমন ও প্রতিরোধের চেষ্টা কতটুকু যুক্তিযুক্ত- তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে । আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এই দিনে সবাই কিন্তু তসলিমা নাসরিনের মত উন্মুক্ত সেক্স করার আহ্বান জানাচ্ছে না।

এর মাধ্যমে বিশ্ব মিডিয়ায় ইসলামকে আরো অসহনশীল ধর্ম হিসাবে তুলে ধরছি কি না – তা ভাবার সময় এসেছে । কেউ কেউ এটাকে বলছেন , বিশ্ব বেহায়া দিবস । শুধু এই দিবসে কেন – আমাদেরকে তো সারা বছরই বেহায়াপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কারণ , বেহায়াপনা চলছে নিত্য দিন ।
ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে- ধরে আনতে নির্দেশ পেয়ে আমরা রীতিমত বেঁধে নিয়ে আসছি ।

ইসলাম একটি জীবনমুখী ধর্ম । কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবনমুখী ধর্মকেই আমরা অনেক সময় জীবনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি , বিশ্ব সমাজে অহেতুক ভুল সংকেত পাঠাচ্ছি । কোথাও কোথাও নৈতিক অবস্থান শক্ত থাকলেও আমাদের সার্বিক উপস্থাপনা হয়ে পড়ছে আপত্তিকর ও ত্রুটিপূর্ণ ।

আমার তো মনে হয় ধর্ম হিসাবে ইসলাম সকল ধরনের ভালোবাসার সবক দিয়েছে । ।শুধু সবক দেয়া নয়, কীভাবে স্বামীর সাথে স্ত্রীর , সন্তানের সাথে পিতামাতার , এক ভাইয়ের জন্যে অন্য ভাইয়ের ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে তার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছে এবং তা পালনের তাগিদ দিয়েছে । অথচ আমাদের আশেপাশে এই ভালোবাসার অভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় । এগুলি নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনাও করতে চাই না।

এক খ্রীষ্টান ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে বলেন , দেখো ! খ্রীষ্টান ধর্ম তোমাদেরকে যতটুকু অধিকার দিয়েছে – তোমরা খ্রীষ্টান মেয়েরা তার চেয়েও অনেক বেশি আদায় করে নিয়েছো । কিন্তু ইসলাম তাদের মেযেদেরকে যতটুকু অধিকার দিয়েছে , তারা তার নূ্যনতম অংশও আদায় করতে পারে নি।

বলতে দ্বিধা নেই , আমাদের পরিবারগুলোতে মেয়েদের প্রতি আমাদের আচরণ খুবই নিষ্ঠুর ও অমর্যাদাকর । মেয়েদের প্রতি এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরনে অনেক সময় মৌলবাদী ও অ-মৌলবাদী পুরুষের মধ্যে খুব একটা ফারাক দেখা যায় না । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাশ করা আমার এক পাঠিকা স্বামী কর্তৃক কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন তা জানিয়েছেন । জেনে খুবই খারাপ লেগেছে । এই গোপন যন্ত্রণায় অনেক মেয়েই ছটফট করছেন । ইদানীং অনেক পুরুষও স্ত্রী কর্তৃক এই গোপন মাইরের কবলে পড়ে গেছেন । তারপরেও বলা যায় আমাদের সমাজে মেয়েদের উপরই এই নির্যাতনটি তুলনামূলক বেশি হচ্ছে ।

এই ধরনের নির্যাতন ও অবমাননার প্রশ্ন উঠলে তা স্বীকার না করে আমরা অতি দ্রুত এক ধরনের ডিফেন্সিভ মুডে চলে যাই ।
অন্যদিকে সমাজের দুয়েকজন ভাগ্যবতিকে সুলতানা রাজিয়া বানিয়ে আমরা নারীকে স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছি বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি ।

কাজেই বছরের একটা দিন এই ভালোবাসা সংক্রান্ত জমা খরচের হিসাব নিয়ে বসলে অসুবিধাটি কোথায় ?

আমরা যদি রেড ক্রসকে রেড ক্রিসেন্ট বানিয়ে মানব সেবা করতে পারি – তবে একই পদ্ধতিতে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে ‘ কে ‘ভালোবাসা দিবস ‘ বানাতে পারবো না কেন ?

ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এতে ক্ষতির চেয়ে লাভের পাল্লা ভারি হতে পারে ।

ভালোবাসা দিবসে কোন বেলেল্লাপনা নয় – কোন নিষিদ্ধ ভালোবাসা নয় । থাকবে একজনের জন্যে অন্য জনের শুদ্ধ , নিখাদ ও খাঁটি ভালোবাসা । সেই ভালোবাসা স্ত্রীর প্রতি
স্বামীর ভালোবাসা , বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, এক ভাইয়ের জন্যে অন্য ভাইয়ের ভালোবাসা।

কাজেই এই সাবজেক্টের কোন বিশেষজ্ঞ হিসাবে নয় – একজন ছাত্র হিসাবে এই প্রশ্নটি রাখছি জনাব শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের কাছে । আমরা যদি এটাকে গ্রহন করি , তবে তা করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে । আবার ত্যাগ করলেও তা করতে হবে অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে ।