খুলনায় মেরিন একাডেমি – মরার উপর খাড়ার ঘা
(জন সচেতনতার উদ্দেশ্যে লেখাটি যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দিন )
” খুলনার বটিয়াঘাটায় মেরিন একাডেমি স্থাপন হচ্ছে বলে জানালেন খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান।
সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টায় মহানগর আওয়ামী লীগের প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি।
মিজানুর রহমান বলেন, রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে খুলনা সফরকালে বানৌজা তিতুমীরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। খুলনায় মেরিন একাডেমি স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই। এসময় মেরিন একাডেমি স্থাপনের জায়গা নির্ধারণের জন্য বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে অবিলম্বে প্রস্তাবনা পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ”
উপরের এই সংবাদটি পড়ে সারা শরীরে একটি মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার ইলেক্ট্রিক শকের শিহরণ অনুভব করলাম। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাস্তব দুনিয়া থেকে কতটুকু দূরে অবস্থান করেন, উপরের সংবাদটি তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গ্লোবাল বাংলাদেশি মেরিনার্স ফোরামের সর্বশেষ তথ্য মতে, মেরিন একাডেমির ৪৭,৪৮ ও ৪৯তম ব্যাচের সর্বমোট ১৯২ জন ক্যাডেট এখনও জাহাজে উঠতে পারেন নি। ইতোমধ্যে ৫০তম ব্যাচের পাসিং আউটের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে ১২টি প্রাইভেট একাডেমির ৪৪৩ জন বেকার ক্যাডেট যুক্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় খুলনায় মেরিন একাডেমি স্থাপনের ভয়াবহ সংবাদটি শুনতে হয়েছে।
একজন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা বেকার আর মেরিন একাডেমি থেকে পাশ করা বেকারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এটা শুধু তাদের চাকুরি জীবনের শুরু নয় – এটা তাদের অন দা জব ট্রেনিং বা ডাক্তারদের মত ইন্টার্নি করার একটা সময়। ইন্টার্নি না করলে যেমন কেউ পরিপূর্ণ ডাক্তার হতে পারবে না। তেমনি সিড়ির ধাপের মত এই সব সি-টাইম শেষ করতে না পারলে সে পরিপূর্ণ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বা নেভিগেটর হতে পারবে না।
মেরিন একাডেমির প্রাক্তন ক্যাডেট হিসাবে এই সব সম্ভাবনাময় তরুণদের কাছ থেকে তাদের জীবন যন্ত্রণার চিঠি পেয়ে সান্ত্বনার কোন ভাষা খুঁজে পাই না। একটা বোবা অার্তনাদ প্রকাশ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় চোখে পড়ে না। এদের চাপা কান্না শোনার মত আজ কেউ নেই।
মেরিনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন যে এই সেক্টরটিতে কী ভয়ংকর ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম সম্মানজনক একটি পেশা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মূল মেরিন একাডেমির সাথে সাথে বর্তমান মহাজোটের সরকার ১৮টি বেসরকারী মেরিন একাডেমির অনুমোদন দিয়ে এখানে মহাজট সৃষ্টি করেছে । এই অনুমোদনটি দেয়ার আগে বিশ্ব শিপিং মার্কেটের চিরাচরিত মেজাজ, গতি প্রকৃতি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্যাডেট ও অফিসারদের চাহিদা সম্পর্কে কোনরূপ কার্যকর গবেষণা চালানো হয় নাই। বরং যত অনুমোদন তত লাভ, এই ফর্মূলাটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
আমার আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছি যে, এই মেরিটাইম সেক্টরটি ছিল দেশের জন্যে একটি সোনার হাঁস। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে এখান থেকে জাতি সত্যি সত্যি অজস্র সোনার ডিম পেতে পারত । কিন্তু কিছু লোভী ব্যক্তি এই সোনার হাঁসটিকে জবাই করে পেটের সবগুলি ডিম খেতে গিয়ে জাতির এই মহা সর্বনাশটি করেছে।
শিপিং মার্কেটের চাহিদার প্রকৃতিটি Sinusoidal. এই চাহিদার গ্রাফটি একবার উপরে উঠে যায়, আরেকবার সর্ব নিম্নে নেমে যায়। গ্রাফের উপরের দিককার সংখ্যা দেখে প্রডাকশন (ক্যাডেটের সংখ্যা) বাড়িয়ে ফেললে গ্রাফের নিচের সময়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়। বর্তমান সরকারের অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের কারণে এবং কয়েকজন কর্মকর্তার সীমাহীন লোভের কারণেই মেরিটাইম সেক্টরে বর্তমানে এই ভয়াবহ অবস্থাটির সৃষ্টি হয়েছে।
তারপরেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেরিন একাডেমির প্রাক্তন ক্যাডেট সহ মেরিন সেক্টরের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি এই অবস্থা থেকে উত্তরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমানে প্রথম কাজটি করা উচিত, অতি সত্ত্বর সরকারী ও বেসরকারী মেরিন একাডেমিগুলিতে ভর্তির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা। প্রাইভেট একাডেমির ভর্তি আপাততঃ সম্পূর্ণ স্থগিত করে মেরিন একাডেমির ইনটেইক সর্বনিম্নে নামিয়ে অানা ( প্রতি ব্যাচে ৩০ থেকে ৪৮ জন) । তা না হলে সুধীদের এই সব উদ্যোগ হবে সেই হতভাগা মায়ের মত ; যে মা তার ক্ষুধার্ত সন্তানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে খালি পাতিলে শুধু পানি ফুটাচ্ছে।
মায়ের এই দরদটির মত এই সব সুধীদের মনের এই কষ্ট ও প্রচেষ্টাকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখতে চাই না। তবে তাদেরকে বিশ্ব বাজারের বর্তমান বাস্তব অবস্থাটির দিকে তাকাতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
ইন্ডিয়ার মত দেশে যেখানে শত শত ক্যাডেট ও জুনিয়র অফিসার চাকুরি পাচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশের ক্যাডেট ও জুনিয়র অফিসারদের চাকুরি পাওয়া কতটুকু সহজ হবে সেই হিসাবটি করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কোন ধরনের প্যানিক সৃষ্টি করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং বাস্তব পরিস্থিতিকে সম্যক ধারন করে সমস্যা উত্তরণে কার্যকর উপায় বের করার নিমিত্তেই এই লেখা। বর্তমান অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা মেনে নিয়েই যতদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন প্রাইভেট একাডেমি গুলির নতুন ভর্তি আপাতত স্থগিত এবং মূল মেরিন একাডেমির ক্যাডেট সংখ্যা সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা দরকার।
ইতোমধ্যে অনেকেই অনেক প্রস্তাব রেখেছেন। কেউ কেউ কিছু কাজ শুরু করেছেন। এই সব উদ্যোগ ও প্রস্তাব অবশ্যই সমস্যা উতরাতে সহায়তা করবে। মেরিন একাডেমির তেরতম ব্যাচের ক্যাপ্টেন আব্দুর রাজ্জাক একটি সুন্দর প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি Bangladesh Flag vessels protection ordinance 1982 এর implement করতে চান। এই আইন অনুযায়ী দেশের আমদানী রফতানী পণ্যের শতকরা ৪০ ভাগ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল কর্তৃক পরিবহণ করতে হবে। এর ফলে দেশীয় মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা বাড়বে এবং ক্যাডেট ও অফিসারদের চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি একটি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু এই বিড়ালের গলায় ঘন্টি কিভাবে বাঁধা হবে এবং কে বাঁধবে সেটাও দেখার বিষয়। কারণ তখন বিদেশী মালিকদের পক্ষে দাঁড়াবে বিশ্ব ব্যাংক ও আই এমএফের মত সংস্থাগুলি। তাদের পক্ষে থাকবে ফ্রি মার্কেট ইকোনোমির সকল যুক্তি ও শ্লোগান।
তারপরও চেষ্টা করতে অসুবিধে নেই। আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলে অন্ততপক্ষে গাছের আগায় তো পৌছানো সম্ভব হবে।
তবে রিলিফের বস্তা বাড়িতে পৌছানোর আগেই যেন দ্বিতীয় বিয়ের ঘটক বাড়িতে পৌছে না যায় । দেশ ও জাতির স্বার্থেই পরিবার পরিকল্পনার আদলে এই নিয়ন্ত্রণ বা মেরিটাইম পরিকল্পনাটি নেয়া দরকার।
আমি ইতোমধ্যেই গ্লোবাল বাংলাদেশি মেরিনার্স ফোরামে এই প্রস্তাবটি রেখেছি। অধিকাংশ মেরিনার এটাতে সমর্থন দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, গলা কেঁটে ফেলে গলা ব্যথার চিকিৎসা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখানে শরীরের ফোঁড়া বা টিউমারকে গলা ভেবে মারাত্মক ভুল করা হচ্ছে। সু্স্থ স্বাভাবিক সময়ে এই টিউমারগুলি ছিল নির্দোষ, অসুস্থ্য শরীরে এখন তা ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। সারা শরীরকে বাঁচাতে কিছু ক্যান্সার কেটে ফেলতে হবে। কাজেই আমি ক্যান্সার বা ফোঁড়া কাটতে বলেছি, গলা কাঁটতে বলি নি।
কারণ, আমাদের মত দেশে মেরিটাইম শিক্ষাকে প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেয়া কখনই নিরাপদ হবে না। ক্যাডেট এম্প্লয়মেন্টের সক্ষমতা বিবেচনায় একটি বা দুটি প্রাইভেট মেরিন একাডেমির অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যেভাবে গণহারে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা পুরো সেক্টরটিকেই জবাই করে ফেলা হয়েছে। দেশের যে লাখ লাখ মেধাবী তরুণ এই পেশায় আগ্রহ দেখাতো এই অবস্থা চলতে থাকলে কোন মেধাবী ছাত্র আর এই পেশায় আসবে না। তখন সস্তা শ্রমের শ্রমিক পাঠানোর মত সস্তা দরের নাবিক বানানোর ফ্যাক্টরি হবে এই বাংলাদেশ।
সোনার হাঁসটিকে জবাই করলেও এখনও পুরাপুরি মারা যায় নি। সবাই মিলে চেষ্টা করলে সোনার এই হাঁসটিকে এখনও বাঁচানো সম্ভব।