মুদ্রিত সংস্করণ
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া ১৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে আদালতে হাজির করা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর।
সেনাসদর সংবাদ সম্মেলন করলেও বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়নি জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে ডকুমেন্টারি পদ্ধতিতে কেউ বলেননি যে আটক রাখা হয়েছে, মিডিয়াতে যেটা এসেছে, আমরা সেটা আমলে নিচ্ছি না। যেহেতু আমরা জানি না, তাই এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না। আমাদের যদি বলা হয় যে আটক রাখা হয়েছে, তাহলে আইন অনুযায়ী তাকে অবশ্যই আদালতের কাছে আনতে হবে। এটাই বিধান।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া ২৫ কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন এখনো সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি ১৪ জনকে এবং অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (এলপিআর) থাকা একজনকে হেফাজতে নেয়ার কথা গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো: হাকিমুজ্জামান।
বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের দুটি এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একটি মামলায় গত ৮ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এরপর তুমুল আলোচনা এবং তাদের গ্রেফতারের দাবি উঠলে সেনাসদর এ বিষয়ে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে জানায়, সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। হেফাজতে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুলের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, ১৫ জন সেনাকর্মকর্তা যে সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছেন, তাদের স্ট্যাটাস কী হবে? তারা কি এখন গ্রেফতার? জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সংবিধানে আছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনেও আছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতেও আছে যে যেখানেই গ্রেফতার করা হোক, তাকে আদালতের জন্য যতটুকু সময় ব্যয় হবে, সেটুকু ছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত করতে হবে। এটা হচ্ছে আইনের বিধান।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন নয়, সংবিধানেও এটি স্বীকৃত যে গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার বেশি কাউকে আটক রাখা যায় না। যদি আদালত আপনাকে আটক করার অথরিটি দেন, তাহলে কেবল তখনই আটক করতে পারবেন। যাকে যখনই গ্রেফতার করা হবে, আদালতের বিধান হচ্ছে, তখনই তাকে আদালতে আনতে হবে। আদালত তাকে আটক রাখতে বললে আটক রাখা হবে। আদালত তাকে জামিন দিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেয়ার কর্তৃত্ব (অথরিটি) তখন আদালতের কাছে চলে যায়। এটাই হচ্ছে আইনি ব্যাখ্যা।’
সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, সেনাকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা তা পায়নি। তবে তার আগেই চাকরিরত ওই কর্মকর্তাদের হেফাজতে নেয়ার পদক্ষেপ নেয় তারা।
আবার তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ ব্যাখ্যা (ওই সেনাকর্মকর্তাদের আটক রাখার বিষয়ে) চাননি। যদি চান, তখন আমরা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই তাদের দেব।’
তাজুল ইসলাম আরো বলেন, সংবিধান নিজেই বলেছে, ১৯৭৩ সালের আইনটি সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী। তাই এই আইনের কোনো ধারা সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এমনকি এ নিয়ে দায়ের করা রিট আবেদনও গ্রহণযোগ্য নয়।
সামরিক হেফাজতকে গ্রেফতার বা আটক হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাইব্যুনালে না আসা পর্যন্ত আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না। আদালতের বাইরে যা ঘটছে, তা ব্যাখ্যা করা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
ফ্যাসিস্ট পতনে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল : এদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে দানবে পরিণত হওয়ার কারণেই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
গতকাল রোববার শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্বে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের কথা তুলে ধরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে দানবে পরিণত হয়েছিল। প্রথমে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। পরবর্তীতে গুম-খুনের সংস্কৃতি চালু করে। এরপর নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়, তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা বাতিল করে। দেশে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পায়। এসবের মাধ্যমেই তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) ক্রমান্বয়ে এক দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছিল।
বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ব্যারিস্টার আরমানকে গুম করে রাখার সময় তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তাজুল ইসলাম বলেন, ব্যারিস্টার আরমানের ব্যাপারে একজন বলেছিলেন, উনি তো ইনোসেন্ট। উনাকে ছেড়ে দেয়া যায় না। কেন, তোমার অসুবিধা হচ্ছে? প্রয়োজনে তাকে শেষ করে দাও।
আওয়ামী লীগ সরকার তার মেয়াদকালে ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী দলসহ যেকোনো ধরনের ভিন্নমতকে নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সুপরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করতে এবং ভিন্নমতের কণ্ঠকে দমন করার জন্য সরকারের অভিজাত অথবা বিশেষ বাহিনীকে ‘সামরিকীকরণ’ করা হয়েছিল। ঢাকায় অবস্থিত মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর প্রতিবেদন অনুসারে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে ৭০০-এর বেশি মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫০ জনেরও বেশি মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তথ্যমতে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬১১ জন ব্যক্তি নিখোঁজ হন। এর মধ্যে ৩৮৩ অন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালে এক প্রতিবেদনে ৮৬ জন গুমের সংখ্যা উল্লেখ করে। দেশী ও বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উপরোক্ত প্রতিবেদনগুলো থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপকতা, নৃশংসতা ও সুনির্দিষ্ট প্রবণতা নির্দেশ করে।
তিনি উল্লেখ করেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুম করার তীব্রতা এতটাই গভীর ছিল যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) উপর মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ ছাড়াও কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের প্রায়ই আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকা গোপন আটক রাখার প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনাসমূহে বেআইনিভাবে আটক করে রাখা হয়েছিল। এই ধরনের বলপূর্বক গুমের চর্চার মাধ্যমে বিরোধী মতাদর্শের মানুষ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ গড়ে তোলা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের শিকার হয়েছেন সহস্রাধিক ব্যক্তি, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, দিনমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, ব্লগার, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, কার্টুনিস্ট, ধর্মীয় নেতাসহ সব স্তরের, শ্রেণী পেশার মানুষ। সম্প্রতি গুম কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত অন্তর্বর্তী রিপোর্টে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তার বর্ণনায় রয়েছে। প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট অনুযায়ী বহু সংখ্যক মানুষের নাম উল্লেখে গুমের বর্ণনা করা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, প্রকৃত গুমের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গুমের পর কী করা হয় তার উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার। এছাড়া ডা: ফয়েজ, চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী। তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানকেও গুম করে টিএফআই সেলে রাখা হয়েছিল। এছাড়া একরাতে ১৩ জনকে হত্যার ঘটনাও রয়েছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার হচ্ছে। আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনের অধীনে এর আগে দুই ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি রায় হয়েছে। যুক্তিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলের ফিরিস্তি তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম। ১/১১-এর সেনাশাসনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, দাবি আদায়ের নামে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সেনা সমর্থিত গুমের বিষয়ে তাজুল বলেন, তখন পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইত না। হাইকোর্ট বলতেন, গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়া। শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব। এ বিষয়ে হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘১৯৭২ সালে রক্ষীবাহিনী গঠন করে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ওই সময় এই বাহিনীর মাধ্যমে ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে মুজিবের আমলেই ধ্বংস করে দেয়া হয়। মেজর (অব:) এমএ জলিলের নির্বাচনী ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে ছিনিয়ে ঢাকায় এনে তার প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতি, দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের ঘটনায় অফিসিয়ালি ২৭ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে, বাস্তবে এর সংখ্যা আরো বেশি। সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর শেখ মুজিব সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কোথায় সিরাজ শিকদার!’
১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ও দেশের বাইরে থেকে আসা ত্রাণ লুটপাট এবং বিদেশে পাচার ও বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, তখন দুই আনার লবণের দাম হয়েছিল ৮০ টাকা। ওই সময় অভাবের কারণে মানুষ ডাস্টবিন থেকে কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে। অথচ ওই সময় শেখ মুজিবের বাসভবনে তখন ফরাসি সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। তাকে মুজিব জিজ্ঞেস করেন, বাংলা নাকি চাইনিজ খাবার খাবেন। তিনি চাইনিজে খেতে চান। পরে পাশের কামরায় গিয়ে দেখেন, খাসি, চিতল মাছসহ বাংলা খাবারের প্রাচুর্য রয়েছে টেবিলে। তার একটি বইয়ে ওই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সেই বইয়ে ফালাচি লিখেছেন, ‘আহা! আমি কেন চাইনিজ খেতে রাজি হলাম।
এ সময় আদালত জানতে চান, আলোচ্য মামলায় এই ঘটনা দিয়ে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন। জবাবে তাজুল বলেন, এটা আওয়ামী লীগের অপরাধী মনের পরিচায়ক। এটা সামনে না থাকলে তাদের শাসনামলের নমুনা জাতি বুঝতে পারবে না। তাই এই পটভূমি বিচারের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশী রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়। এটা ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, যাতে ইচ্ছামতো নির্বাচন করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় জুডিশিয়াল কিলিং, এর মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসি দেয়া হয়। হাসিনাকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আপনি (একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচার করেন।’ হাসিনা জবাব দেন, ‘বিচার করার জন্য প্রমাণ কোথায় খুঁজে পাবো।’ প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, ‘প্রমাণের ব্যবস্থা আমি করবো।’
বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশী রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়। এটা ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ।
বিচারকদেরও জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার : অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
বক্তব্যের এক পর্যায়ে তাজুল ইসলাম সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদার বলেন, ‘যারা বিচার করেন, তাদের অ্যাকাউন্টেবিলিটির ব্যবস্থা থাকা দরকার, জুডিশিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি কাউন্সিল।
পরে মধ্যাহ্ন বিরতিতে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সুপ্রিম কোর্টের সাথে প্রতারণা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মামলার রায়ে ওপেন কোর্টে তিনি একটি রায় দিয়েছিলেন, পরে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করেন। এ প্রসঙ্গটি আজ ট্রাইব্যুনালে উত্থাপন করলে ট্রাইব্যুনালের মাননীয় চেয়ারম্যান এ মন্তব্য করেন।’
তাজুলকে প্রশ্ন করা হয়, যেসব সেনাকর্মকর্তাকে গুম-খুনের মামলায় সেনা হেফাজতে নেয়া হয়েছে, তাদের ‘স্ট্যাটাস’ কী? তখন তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে কোনো কথা হলে তিনি বলতে পারবেন। এর বাইরে কোনো বিষয়ে কথা বলার সঠিক কর্তৃপক্ষ তিনি নন। তবে সেনাকর্মকর্তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা যেসব কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে, সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানোর কথা জানতে পারার কথাও উল্লেখ করেন প্রধান কৌঁসুলি।
ক্রসফায়ারের নির্মমতা বর্ণনা করতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুরে একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়, তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে আগুন লেগে যায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হা-হা করে হাসছিল। আমরা তদন্তের সময় এ বিষয়ে একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাথায় কেন গুলি করা হয়?
তারা উত্তর দেয়, ‘মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হয়।’ এখান থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সময় ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা বোঝাতে চাই যে, এই ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি, এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্র্যাকটিস।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘১৯৭২ সালে রক্ষীবাহিনী গঠন করে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ওই সময় এই বাহিনীর মাধ্যমে ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে মুজিবের আমলেই ধ্বংস করে দেয়া হয়।
এর আগে ৮ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই অনুযায়ী রোববার সকালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে প্রসিকিউশন। আদালতে আসামি হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, ৮ অক্টোবর প্রসিকিউশনের পক্ষে সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো: আলমগীরকে আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়। আসামিরা পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়েই এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এর পরের ধাপই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কের পরেই মামলাটি রায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজন আসামি। তারা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে মামুন পরে রাজসাক্ষী হিসেবে হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার সাক্ষ্য মামলায় অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে প্রসিকিউশন সূত্র।
হাসিনার মামলা সরাসরি সম্প্রচারকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা হয়েছে। রোববার দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রোববার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শুরু হয়। চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে এই যুক্তিতর্ক সরাসরি সম্প্রচার করার সময় সাইবার হামলা হয় বলে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম বলেন, প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) যুক্তিতর্ক সরাসরি সম্প্রচারের সময় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সাইবার অ্যাটাক (হামলা) হয়। ফেসবুক পেজটি সাময়িকভাবে ডিজেবল (নিষ্ক্রিয়) করে দিয়েছিল হামলাকারীরা। পরে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘তারা (হামলাকারীরা) যে আমাদের ভয় পায়, এই যে যুক্তিতর্ক, এটার যে এভিডেন্স, তাদের যে নিষ্ঠুরতার বর্ণনা, এটা যাতে দুনিয়াবাসী জানতে না পারে, তাদের জানতে দিতে এই অপরাধীরা চায় না। সে জন্য আমাদের ফেসবুক পেজের ওপর তারা সাইবার হামলা চালিয়েছে।’