জিএম কাদেরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল এনায়েতের

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ০০

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিমকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। নিজেকে সিআইএর এজেন্ট ও দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক পরিচয় দেওয়াকে পুলিশ ভুয়া এবং প্রতারণা বলে বর্ণনা করেছে। ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আজ থেকে জয়েন ইন্টারগেশন সেল বা টাস্কফোর্সে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র আমার দেশকে জানায়, ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত করিম স্বীকার করেছেন তার সিআইএর এজেন্টের পরিচয় ভুয়া। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ২০১৪ সালে বিএনপি ভাঙার অ্যাসাইনমেন্টে তিনি জড়িত ছিলেন। তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা ও ‘র’-এর যোগসাজশে তিনি এ কাজ করেছেন। এনায়েত করিম ১৪ জন রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বের নাম প্রকাশ করেন, যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় ছিলেন। এ কাজে তিনি দেড় কোটি টাকাও খরচ করেছেন। ২০২৩ সালে বনানীর শেরাটন হোটেলের ইনসাফ কায়েম কমিটির অনুষ্ঠানের খরচও তিনি বহন করেন।

 

দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার অবস্থা সৃষ্টি হয়, তখনই তিনি বাংলাদেশে এসে উপস্থিত হন এবং কিছু বিনোয়োগ করে মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে নেন। এভাবে তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশে এসে তৎপরতা চালান এবং তৎকালীন ডিজিএফআই তাকে ভাড়াটে হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল বলে জানা গেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পর আবার তিনি বাংলাদেশে এসে তৎপরতা শুরু করেছেন। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার একটি গুঞ্জন আছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেল করিয়ে আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ধাঁচের সরকার গঠনের যে ষড়যন্ত্র চলছে, তার সঙ্গে এই ভুয়া সিআইএর এজেন্ট জড়িত থাকতে পারেন। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে সূত্র জানায়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশ তাকে রিমান্ডে এনেছে। তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য জানতে পেরেছে ডিবি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, এনায়েত বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ নিয়ে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করতেন। ২০১৪ সালে তিনি বিএনপি ভাঙার জন্য দেড় কোটি টাকা ব্যয়ের কথা স্বীকার করেছেন।

এই টাকা তিনি ইনসাফ কমিটি এবং বিএনপির সংস্থারপন্থি কয়েকজন নেতার পেছনে খরচ করেছেন বলে দাবি করেছেন। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ বনানীর শেরাটন হোটেলে ইনসাফ কমিটির যে সভা আয়োজন করা হয়েছিল ওই সভার পুরো হোটেল খরচ তিনি দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনায়েত খুব ধূর্ত প্রকৃতির লোক।

আসল কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। এনায়েত দাবি করেছেন, তার সঙ্গে ১৪ জন নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি তাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম, ডিজিএফআই-এর সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) তাবরেজ শামস, সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) সাইফুল আলম, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি, জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জাতীয় পার্টির নেতা কাজী মামুনুর রশীদ, বিএনপির সাবেক অফিস সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিক উলফাত, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ও সাখাওয়াত হোসেন বকুল। এই ১৪ জনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে তিনি দাবি করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় এই ব্যক্তিদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন করছেন এবং তৃতীয় ব্যক্তির হাতে কাজ বাস্তবায়নের জন্য পৌঁছে দিয়েছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী এনায়েত নিজেই সিআইএর জাল ডকুমেন্ট তৈরি করেছেন। সেগুলো তিনি ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের দেখিয়ে সিআইএর বড় এজেন্ট বলে দাবি করতেন। স্ক্যান করা ডকুমেন্ট তিনি আবার কাউকে মোবাইলে পাঠাতেন। বাংলাদেশে ডিজিএফআইএর তৎকালীন কর্মকর্তারা হাসিনা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘র’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে তাদের এজেন্ট হিসেবেই তিনি কাজ করেছেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী তার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন বলেও জানা গেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েতের তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিন্টো রোডের সামনে গাড়ি নিয়ে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি নিজেকে সিআইএর পরিচালক দাবি করেন। পরে পুলিশ তাকে এবং তার সহযোগী এস এম গোলাম মোস্তফাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। গত সোমবার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক দুজনকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি ইলিয়াস কবীর বৃহস্পতিবার রাতে আমার দেশকে জানান, ‘এনায়েত বড় মাপের প্রতারক। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।’

রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী ১৪ ব্যক্তির মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে এনায়েতের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানার জন্য গতকাল বিকাল ৩টায় ফোন করলে আমার দেশ-এর নাম শুনেই ফোন কেটে দেন। এরপর কয়েকবার ফোন করলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির অপর অংশের সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, আমার সঙ্গে দুই মাস আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে এনায়েত করিমের সঙ্গে দেখা হয়, তবে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

শওকত মাহমুদ বলেন, আমার সম্পর্কে দেওয়া খবরটি সঠিক নয়। এনায়েত করিম আমাদের দলকে ফাইন্যান্স করেননি। তার তৎপরতা সম্পর্কে আমি কিছু জানিনা।

‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, এনায়েত গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে সিআইএর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। কখনো সরকার উৎখাতের স্বপ্ন দেখানো, কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর স্বপ্ন দেখান তিনি। আবার তিনি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল ডিনারে আমন্ত্রণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে থাকেন। এ কথা বলে সবার কাছে তিনি মোটা অংকের টাকা নেন।

সূত্র জানায়, তিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ২০০৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট পান। গত ৬ সেপ্টেম্বর সকালে নিউইয়র্ক থেকে কাতার এয়ারওয়েজে করে তিনি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অবস্থান নেন। পরে তিনি রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান নেন। তার সঙ্গে যাদের সখ্য তাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতেন বলে দাবি করেন।

সূত্র জানায়, এনায়েত পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা কোনো ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করতেন না। দেশে এবং বিদেশে টাকা লেনদেনে তার পূর্ব পরিচিত লোকজনের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করতেন। এ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হওয়া তার সহযোগী আজাদকে ব্যবহার করতেন।

সূত্র জানায়, এনায়েত যে ১৪ জনের নাম বলেছেন সেই ১৪ জনকে পুলিশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তবে কাউকে হয়রানি করা হবে না বলে পুলিশ জানায়। যদি এনায়েতের প্রতারণার সঙ্গে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

মামলার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা জানান, সিআইএর এজেন্ট পরিচয় দিয়ে এনায়েত হাতিয়ে নিয়েছেন অঢেল টাকা। বিশেষ করে তিনি গুলশানের একাধিক ব্যবসায়ীকে আমেরিকায় শুল্কমুক্ত পণ্য কিনে দেওয়ার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এনায়েত জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তার ফ্লোরিডায় ফ্ল্যাট রয়েছে, সেখানে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। তবে আমেরিকায় তিনি কী কাজ করেন ওই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

সূত্র জানায়, এনায়েতের সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়া গোলাম আজাদ মোস্তফা একাত্তর টিভিতে জিএম অপারেশন হিসেবে কাজ করতেন। ৫ আগস্টের পর তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তাকে ২ লাখ টাকা বেতনে নিজের সহকারী হিসেবে রেখেছিলেন এনায়েত করিম। মোস্তফার মাধ্যমে এনায়েত তার টাকা বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন। এর আগে একবার চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন এনায়েত।

সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জাতীয় পার্টি নেতা কাজী মামুনুর রশীদ পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। জিএম কাদেরের সঙ্গে তার আগে পরিচয় ছিল না বলে এনায়েত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here