তরুণ প্রজন্মের বিদেশমুখিতা: উদ্বেগের কারণ ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন

logo

আব্দুল মোমিত (রোমেল)

(১৭ মিনিট আগে) ২৮ আগস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:১২ পূর্বাহ্ন

mzamin

facebook sharing button

বর্তমান বাংলাদেশে একটি স্পষ্ট সামাজিক প্রবণতা চোখে পড়ে—তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে। এই বিদেশমুখিতা শুধুই ব্যক্তিগত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং তা একটি জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন তোলে। কেন এ প্রবণতা এত প্রবল হচ্ছে? এটি কি নিছক সুযোগের খোঁজ, নাকি দেশের ভেতরের কোনো কাঠামোগত সমস্যা এর জন্য দায়ী?

এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু ব্যক্তির ভবিষ্যৎ নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটার পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।

বাংলাদেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজকাল উচ্চশিক্ষা, উন্নত জীবনমান ও পেশাগত সুযোগের আশায় বিদেশমুখী হয়ে পড়ছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশ হারাচ্ছে তার সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ—যাদের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল।

প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মত প্রকাশে বাধা তরুণদের হতাশ করছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, গঠনমূলক ভাবনা ও চিন্তা প্রকাশ করাও অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, যা তাদের বিদেশমুখী করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ দেশে সীমিত। উন্নত দেশগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, গবেষণামূলক পরিবেশ এবং দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন তরুণদের আকৃষ্ট করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী থেকে শুরু করে গবেষক কিংবা উদ্যোক্তা—সবার মধ্যেই বিদেশে পড়াশোনা ও পেশাগত প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। শুধু ২০২৪ সালেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন, যার মধ্যে বড় একটি অংশ স্থায়ী বসবাসের লক্ষ্য নিয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জীবনের মানও একটি বড় কারণ। অনেকেই মনে করেন, বিদেশে গেলে তারা আরও স্বাধীনভাবে নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারবেন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

এই তরুণদের ভবিষ্যৎ নানা রকম হতে পারে। কেউ কেউ সফল হয়ে পরিবার ও সমাজকে সহায়তা করেন, আবার কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে নিজেদের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তবে অনেকে ‘ব্রেইন ড্রেইন’-এর শিকার হন—মানে তারা থেকে গেলেও তাদের মেধা দেশে কাজে লাগে না। কেউ কেউ আবার বিদেশের সংস্কৃতি ও জীবনে মানিয়ে নিতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে দেশ এক বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে। দক্ষ জনশক্তির অভাব, নেতৃত্ব সংকট এবং মেধার অপচয় দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

তাই এখনই সময় দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার। তাহলেই তরুণ প্রজন্ম দেশে থেকেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারবে।

অনেকেই আশাবাদী ছিলেন, বিদেশে গিয়ে এই তরুণেরা একদিন দেশে ফিরে এসে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় অবদান রাখবে। তবে বাস্তবতা হলো, অধিকাংশই থেকে যায় বিদেশেই—পরিবার, নাগরিক সুবিধা ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার খোঁজে।

ভবিষ্যৎ প্রশ্ন বাংলাদেশের সরকারের তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য এবং দেশে চাকরি পাওয়ার সহজ উপায় তৈরি করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

১. শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি

কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সম্প্রসারণ: টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার বাড়ানো যাতে তরুণেরা বাজারমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

ইংরেজি ও ডিজিটাল দক্ষতা শিক্ষা: আন্তর্জাতিক ও আধুনিক চাকরিতে ইংরেজি ও আইটি স্কিল খুব জরুরি, এ ব্যাপারে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিকায়ন: সিলেবাস আধুনিক প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা মনোভাব ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ভিত্তিক করা।

২. উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি বাড়ানো

স্টার্টআপের জন্য বিশেষ অনুদান ও ঋণ: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা।

বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা: কর ছাড়, প্রাথমিক বাজার প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ সহজতর করা।

উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সেবা: উদ্যোক্তা গাইডলাইন, ইনকিউবেটর ও মেন্টরশিপ ব্যবস্থা চালু রাখা।

৩. কর্মসংস্থান ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি

সার্বজনীন চাকরি মেলা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক চাকরির তথ্য সহজলভ্য করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।

বিশেষায়িত চাকরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: সরকারি খাতে ও দক্ষতা ভিত্তিক খাতগুলোতে চাকরি যোগানের জন্য প্রশিক্ষণ।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন শিল্প ও সেবা খাত: গ্রীন এনার্জি, ডিজিটাল সেবা, কৃষি প্রযুক্তি, উৎপাদন খাত সম্প্রসারণ।

৪. সামাজিক সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ উন্নয়ন

চাকরির গুণগত মান নিশ্চিত করা: শ্রম আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, ন্যায্য বেতন, কাজের পরিবেশ উন্নয়ন।

মেয়েদের কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ বাড়ানো: নারীদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।

শ্রমজীবী তরুণদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও সামাজিক নিরাপত্তা: জীবনমান উন্নত করতে।

৫. তথ্য-প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন উৎসাহিত করা

ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ানো: দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি।

আইটি ও সফটওয়্যার সেক্টর প্রসার: তরুণদের জন্য হ্যাকাথন, কনটেস্ট ও প্রশিক্ষণ সেশন আয়োজন।

গবেষণা ও উন্নয়ন (আর অ্যান্ড ডি): প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়।

৬. নীতিমালা ও প্রশাসনিক সহজীকরণ

চাকরি ও ব্যবসার জন্য সহজ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া: সরকারি ভিসা, লাইসেন্স, কর প্রক্রিয়া সহজ করা।

প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নীতিমালা গঠন: দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

তরুণদের মতামত গ্রহণ: নীতিমালা প্রণয়নে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানো।

৭. প্রবাসী দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার ও পুনর্বাসন

বিদেশে গিয়ে দক্ষতা অর্জিত তরুণদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া: রিহায়ারিং ও পুনঃপ্রশিক্ষণ সুযোগ। প্রবাসী তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা।

সংক্ষেপে, সরকারের উচিত হবে: শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানো, উদ্যোক্তা পরিবেশ তৈরি করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা তথ্য-প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, প্রশাসনিক ব্যাধি দূর করা, প্রবাসী তরুণদের ফিরিয়ে আনা

প্রশ্ন উঠছে—যদি মেধাবীরা বিদেশে থেকেই যায়, তাহলে দেশ স্বাবলম্বী হবে কীভাবে?

উত্তর খোঁজার সময় এখনই। তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তির স্বপ্নপূরণ নয়, বরং একটি দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার ঘাটতির প্রতিফলন। তবে এই সংকটের সমাধান তরুণদের দোষারোপ করে নয়, বরং তাদের আশার জায়গাগুলো পুনরায় শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।

আমরা যদি চাই তরুণ প্রজন্ম দেশেই থেকে দেশকে গড়ার কাজে অংশ নিক, তাহলে আমাদের দায়িত্ব তাদের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক, স্থিতিশীল ও স্বপ্নময় দেশ তৈরি করা—যেখানে তারা নিরাপদ, সম্মানিত ও মূল্যায়িত বোধ করবে।

তরুণদের শুধু দোষারোপ নয়, বরং তাদের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক, স্থিতিশীল ও স্বপ্নময় দেশ গড়ার পথ তৈরি করতে হবে। কারণ, তরুণরা দেশ ছাড়ে না—তারা শুধু সম্ভাবনার খোঁজে পাড়ি জমায়। সেই সম্ভাবনাটা যদি আমরা দেশেই তৈরি করতে পারি, তবে ভবিষ্যৎ আর বিদেশে নয়, এখানেই তৈরি হবে। ভবিষ্যতে যেই সরকারি বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা আসুক না কেন তাদের উচিত তরুণ প্রজন্মকে দেশে রেখে দেশকে উন্নয়নশীল করা কাজে ব্যবহার করা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ (প্রায় ৪৫% এর বেশি) ১৫–৩৫ বছর বয়সী—অর্থাৎ ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ এখন চলছে। এই জনশক্তিকে ঠিকভাবে কাজে না লাগানো মানে বিশাল সম্ভাবনার অপচয়।

তরুণরা যদি দেশে থেকে স্টার্টআপ, কৃষি প্রযুক্তি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ই-কমার্স, গ্রামীণ উদ্ভাবন ইত্যাদিতে কাজ করে, তাহলে দেশের অর্থনীতি অভ্যন্তরীণভাবেই শক্তিশালী হবে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনা ভালো, কিন্তু দেশের ভেতরে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। তরুণদের বিদেশে পাঠিয়ে নয়, দেশে রেখে গড়ে তুলতে হবে।

সরকার যদি ‘উন্নয়ন মানেই বিদেশে জনশক্তি পাঠানো’—এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে ‘উন্নয়ন মানেই দেশের প্রতিভাকে কাজে লাগানো’—এই দৃষ্টিভঙ্গি নেয়, তাহলে বাস্তব উন্নয়ন সম্ভব হবে। তরুণদের সস্তা শ্রমিক নয়, জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নির্মাতা হিসেবে দেখতে হবে।

লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here