জুলাই সনদ কি সংবিধানের চেয়েও শক্তিশালী হতে চলেছে?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত করা জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া প্রকাশের পর থেকেই একটি মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্নটি হলো—গণ-অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে তৈরি এই সনদ কি দেশের সংবিধানের চেয়েও শক্তিশালী হতে চলেছে?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে সনদের অঙ্গীকারনামায় প্রস্তাবিত দুটি দফা। এর একটিতে বলা হয়েছে, ‘এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করব এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনও আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।’ অপর দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, সনদের বৈধতা বা জারির কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

এই প্রস্তাবগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নাগরিকদের বিচারিক সুরক্ষার অধিকারের পরিপন্থী বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলো। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের মতে, কোনো আইন সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান পেলে দেশে কার্যত সংবিধানের অস্তিত্ব থাকে না। তিনি বলেন, ‘তখন জুলাই সনদটাই সংবিধান হয়ে যাবে। কিন্তু জুলাই সনদ তো আর সংবিধান না।’ তার মতে, এই সনদ একটি ‘নৈতিক ডকুমেন্ট’ বা অঙ্গীকার হতে পারে, কিন্তু একে আইন হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই।

একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতা দলিল এবং কোনো সমঝোতাকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হলে তা একটি খারাপ নজির তৈরি করবে। তিনি বলেন, ‘বস্তুত দেশে তো এখন সংবিধান আছে, রাষ্ট্র আছে, স্বাধীনতাও আছে। এক্ষেত্রে আমরা এই সমঝোতা দলীলকে কীভাবে আইনি এবং বৈধ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করতে পারি সে চিন্তা করা উচিত।’

তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই প্রস্তাবগুলোর পেছনে ভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছে। কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদের ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে’ এবং গণ-অভ্যুত্থানে মানুষের আত্মত্যাগকে আইনি সুরক্ষা দিতেই এই ধারাগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মতে, সনদে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থাপন করার জন্য নয়।

তিনি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, ‘বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দশ বছর বলা নেই। কিন্তু আমরা আলোচনায় সব দল একমত হয়েছি। এখন এটাকে তো প্রাধান্য দিতে হবে।’ আলী রীয়াজ প্রশ্ন তোলেন, সংবিধানে যা আছে, তাই যদি বহাল থাকে, তাহলে ‘এত আলোচনার প্রয়োজন কী ছিল?’ তার বক্তব্য অনুযায়ী, বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে কোনো প্রস্তাব সাংঘর্ষিক—এই যুক্তিতে যেন সংস্কার কার্যক্রম থামিয়ে দেওয়া না যায়, সেজন্যই সনদের বিধানকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের উদ্দেশ্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মনে করেন, রাজনৈতিক সরকার যেন ভবিষ্যতে এই ঐকমত্য বাতিল করতে না পারে, সেই সুরক্ষা প্রয়োজন। তবে এর জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ খুঁজে বের করতে হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা এবং সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে পড়েছে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ। সংসদের অনুপস্থিতিতে কীভাবে এর আইনি সুরাহা হবে এবং সংবিধানের সঙ্গে এর সম্পর্ক কেমন হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here