


২০২৫ সালের অগাস্ট মাসের ১১ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রীয় সফরটি ছিল দুই দেশের সম্পর্কে একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি ছিল ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সফর, যা গত বছর অক্টোবর মাসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের ঢাকা সফরের প্রত্যুত্তর।
এই সফর কেবল গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতা নয় বরং তা ছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করার এক সুদৃঢ় পদক্ষেপ। এই সফরকালে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমবাজার, শিক্ষা, পর্যটন ও প্রতিরক্ষা খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোয় বিদ্যমান সম্পর্ক পর্যালোচনা ও শক্তিশালী করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের এই বৈঠক অভিবাসন, বিনিয়োগ এবং কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য এবং মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরে তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এই সফরে অভিবাসন সংক্রান্ত আলোচনা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ঐতিহাসিকভাবে, এই শ্রমবাজারের সাথে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ যেমন ভিসা জটিলতা, শ্রমিকদের শোষণ এবং কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা জড়িয়ে আছে।
তবে এই সফরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানোর ইঙ্গিত দেয়। এই সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনার একটি স্বচ্ছ ও নিরাপদ প্রক্রিয়া তৈরি হতে পারে। এর ফলে শ্রমিকদের বৈধ উপায়ে মালয়েশিয়ায় কাজ করার সুযোগ বাড়বে, পাশাপাশি তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
মালয়েশিয়া তার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনশক্তি পেতে পারে, অন্যদিকে বাংলাদেশ পেতে পারে বৈধ চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্স। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক চুক্তি নয় বরং অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা ও জীবনমান উন্নত করার একটি প্রতিশ্রুতি। দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হবে এবং এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই সফরের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে মোট পাঁচটি সমঝোতা স্মারক এবং তিনটি ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা, জ্বালানি, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য।
মালয়েশিয়া তার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনশক্তি পেতে পারে, অন্যদিকে বাংলাদেশ পেতে পারে বৈধ চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্স। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক চুক্তি নয় বরং অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা ও জীবনমান উন্নত করার একটি প্রতিশ্রুতি।
প্রতিরক্ষা সহায়তা: এই সমঝোতা সামরিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াবে। প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় এবং সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহায়তা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে আরও মজবুত করবে। এটি কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয় বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি: জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে সহায়ক হতে পারে। মালয়েশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি এবং এই খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা: এই চুক্তিটি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ বিনিময়ের সুযোগ বাড়বে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মালয়েশিয়া এখন থেকে আরও আকর্ষণীয় শিক্ষা গন্তব্য হতে পারে। পাশাপাশি, কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে বোঝাপড়া ও সহযোগিতা আরও বাড়বে।
ব্যবসা-বাণিজ্য: ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সহজ ও গতিশীল করবে। এটি পণ্যের আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা এবং দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে।
হালাল ইকোসিস্টেম: মালয়েশিয়া হালাল পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিশ্বজুড়ে শীর্ষস্থানীয়। হালাল ইকোসিস্টেম নিয়ে সই হওয়া নোট অব এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য এই বিশাল বাজারটিতে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের হালাল পণ্য বিশ্ববাজারে স্থান করে নিতে পারবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস হতে পারে।
এই চুক্তিগুলো কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয় বরং কৌশলগত ও মানবিক দিক থেকেও দুই দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে।
এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রত্যাশিত দিকটি ছিল রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মালয়েশিয়ার সাহসী অবস্থান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা চেয়েছেন।
তিনি এই সংকটকে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর জবাবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বোঝা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে এই আলোচনার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিক হলো, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য মালয়েশিয়া মিয়ানমারে একটি যৌথ শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে মোট পাঁচটি সমঝোতা স্মারক এবং তিনটি ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহায়তা, জ্বালানি, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য।
এটি কোনো সাধারণ কূটনৈতিক ঘোষণা নয় বরং এটি একটি অত্যন্ত সাহসী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আসিয়ান জোটের সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়ার এমন সরাসরি পদক্ষেপ মিয়ানমারের ওপর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে উপেক্ষা করে আসছে। কিন্তু যখন তাদেরই আঞ্চলিক অংশীদারদের একজন সরাসরি হস্তক্ষেপের ঘোষণা দেয়, তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, মালয়েশিয়া শুধু মৌখিক সমর্থন নয় বরং কার্যত এই মানবিক সংকটের সমাধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চাপে ফেলবে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত কাঠামো তৈরিতে বাধ্য করবে। মালয়েশিয়ার এই পদক্ষেপ আঞ্চলিক কূটনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে মানবিক সংকট সমাধানে সামরিক হস্তক্ষেপের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস দেখানো হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত নোট অব এক্সচেঞ্জগুলো ভবিষ্যতের সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দুই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরাসরি সহযোগিতা স্থাপিত হবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনা ও গবেষণার সুযোগ পাবে এবং মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে পারবে।
অন্যদিকে, কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়বে, যা ভবিষ্যতে আরও মসৃণ ও কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করবে। এটি কেবল কাগজ-কলমে চুক্তি নয় বরং এটি দুই দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ।
এই সফরটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে হলেও এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা প্রমাণ করে যে, এই সফর ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং ফলপ্রসূ। অভিবাসন খাতে স্বচ্ছতা, বিনিয়োগে আকর্ষণীয় পরিবেশ, হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার সমর্থন এই সবই বাংলাদেশের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে।
এটি কেবল একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গল্প নয়, বরং এটি একটি উন্নয়নশীল দেশের আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের মর্যাদা ও স্বার্থ তুলে ধরার এক সফল উদাহরণ। আশা করা যায়, এই সফরের মাধ্যমে স্থাপিত ভিত্তি ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর, শক্তিশালী ও টেকসই করবে। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানবিক ও কৌশলগত দিক থেকেও উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।
ড. সুজিত কুমার দত্ত : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd