Prothom Alo
ঢাকা

আবার দলের ভেতর থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) শীর্ষ নেতা জি এম কাদের। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দলের দশম কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এবার জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় একটি অংশ তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে। এই অংশটি ২৮ জুন রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এর নেতৃত্বে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সম্মেলন সামনে রেখে এক প্যানেলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চেয়ারম্যান ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে প্রার্থী হবেন। তাঁরা সম্মেলনে দলীয় গঠনতন্ত্রের বহুল বিতর্কিত ধারা-২০ এর (ক) উপধারাটিতে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ধারার ক্ষমতাবলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, অপসারণ ও তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন। এই ধারাটিকে তাঁরা চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী বলছেন।
অবশ্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, নতুন করে দলীয় প্রধানকে চ্যালেঞ্জ জানানোর যে তৎপরতা, সেটি ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান–পরবতী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নতুন রূপ। এর লক্ষ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেমনটা ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েও হয়েছিল। তখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ ও জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে সে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
আমি চেয়ারম্যান পদে ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আমরা দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন চাই।
জি এম কাদের ও তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাদের দাবি, এখন দলে বিভক্তি সৃষ্টি করে জি এম কাদেরের নেতৃত্ব বেহাত করার লক্ষ্যে জাতীয় পার্টির একটি অংশকে নির্বাচনে নেওয়ার টোপ দেওয়া হয়েছে। সেই টোপে পড়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ জাতীয় পার্টির সম্মেলনকে উপলক্ষ বানাচ্ছেন। তাঁরা দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-ধারার (ক) উপধারাকে নতুন করে সামনে আনছেন। অথচ এই নেতারা দলীয় গঠনতন্ত্র মেনেই এত দিন জাতীয় পাটির রাজনীতি করেছেন, অনেকে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীও হয়েছেন।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এবারের সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভেতর থেকে গঠনতন্ত্রের ২০-ধারার সংশোধনী আনার তৎপরতা টের পেয়ে জি এম কাদের ১৬ জুন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ সম্মেলন কেন্দ্রের হল বরাদ্দ বাতিল করায় ২৮ জুনের সম্মেলন হচ্ছে না। নতুন করে হল বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে সম্মেলনের তারিখ ও সময় জানানো হবে। বিষয়টি জানিয়ে ১৬ জুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের চিঠি দিয়েছেন।

জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির সম্মেলন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য গত ২০ মে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় ২৮ জুন বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন এ সিদ্ধান্তও হয় যে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বরাদ্দ না পেলে কাকরাইলে দলীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে সম্মেলন করা হবে। কিন্তু জি এম কাদের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে তাঁর প্রেস সচিবের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সম্মেলন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর বিরুদ্ধে দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারসহ একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য এক হয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রওশন এরশাদের সঙ্গে থাকা আরও কিছু নেতা। যাঁদের বিভিন্ন সময় জি এম কাদের দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন (বাবলা), আবদুস সাত্তার ও কাজী মামুনুর রশীদ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সবাই সম্মেলন করতে এক জোট হয়েছেন।
এঁদের কারণেই জাতীয় পাটিকে আওয়ামী লীগের দোসর বা দালাল হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁদের আমরা সম্মান দিয়ে পদে রেখেছিলাম।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৮ জুন কাউন্সিল করব। আমি চেয়ারম্যান পদে ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আমরা দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন চাই।’
এ দিকে মঙ্গলবার (১৭ জুন) সন্ধ্যায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার এক যৌথ বিবৃতিতে দলীয় চেয়ারম্যানের সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও অনভিপ্রেত বলে মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, দলীয় গঠনতন্ত্র ও প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ২৮ জুন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করবেন।
জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-ধারার (ক) উপধারা সংশোধনের তৎপরতায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হকও (চুন্নু) সম্পৃক্ত রয়েছেন। ফলে জি এম কাদেরের ওপর চাপ আরও বাড়ল।
মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান (জি এম কাদের) সব সময় গণতন্ত্রের কথা বলেন, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ ধারাটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক। এই ধারাবলে তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। আমি ওনাকে পরামর্শ দিয়েছি, এই ধারাটি একটু সংশোধনের। তিনি তাতে রাজি নন। ফলে আমাকেও তিনি যখন ইচ্ছা বাদ দিতে পারেন। এ রকম ইনসিকিউর (নিরাপত্তাহীন) অবস্থায় আমি থাকতে চাই না।’
জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনার লক্ষ্য রয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের। সেটা আঁচ করতে পেরে মুজিবুল হক আগে থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। সব মিলিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের নতুন তৎপরতা, বিশেষ করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের একীভূত উদ্যোগ জি এম কাদেরের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এঁদের কারণেই জাতীয় পাটিকে আওয়ামী লীগের দোসর বা দালাল হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁদের আমরা সম্মান দিয়ে পদে রেখেছিলাম। তাঁরা সব সময় ফাও কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হয়তো কেউ এঁদের কিছু প্রলোভন দিয়েছে। কিন্তু তারা কোথাও দাঁড়াতে পারবে না। আমি মনে করি, আবর্জনার ওই গ্রুপটা চলে গেলে দলটা বরং একটা লাইনে থাকবে।’
অবশ্য ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই জি এম কাদের রাজনৈতিকভাবে চাপে রয়েছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে জুলাই গণ-অভুত্থানের ঘটনায় করা একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচি পালনে বাধা ও হামলার মুখে পড়েছে দলটি। জি এম কাদেরের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর আগে জি এম কাদের ও তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সর্বশেষ তিনি দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।