কাউসার মুমিন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
(২২ মিনিট আগে) ১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ১:৫৯ অপরাহ্ন

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার কোনো না কোনো অংশে প্রায় প্রতিদিনই কাঁচি চালাচ্ছেন। ফেডারেল সরকারের দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষের বিভিন্ন ফেডারেল সেবা, আইন আদালত কিংবা ফেডারেল বিচার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অভিবাসন, প্রতিরক্ষা, এমনকি আন্তর্জাতিক মিত্রতা-এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা ট্রাম্পের কাটছাঁটের শিকার হচ্ছে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দীর্ঘদিনের আইনগত ন্যায্য অধিকার যে কোনো সময় কাটছাঁট হওয়ার আতঙ্ক নিয়েই এখন দিন শুরু হয় মার্কিনীদের। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ‘মানবাধিকারের সংজ্ঞা’ কাঁটছাট করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
মার্কিন গণমাধ্যম সংস্থা ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) গতকাল এমন কিছু ডকুমেন্ট ও মেমো হাতে পেয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার শব্দটির সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে ‘মানবাধিকার’-এর প্রচলিত ও স্বীকৃত সংজ্ঞা কার্যত সংকুচিত করা হয়েছে।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্বল কারাগার পরিস্থিতি, সরকারি দুর্নীতি বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বিধিনিষেধের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে না। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো কর্তৃক শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বন্ধ করা, স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা কিংবা রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলো আর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওই মেমো এবং আরও কিছু নথি থেকে জানা গেছে, কর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে তারা বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলো ‘সরাসরি ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা’র মধ্যে সীমিত রাখেন। যদিও মার্কিন আইন অনুযায়ী এসব প্রতিবেদন প্রতিটি দেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘পূর্ণ ও সম্পূর্ণ প্রতিবেদন’ হওয়া উচিত। কারণ, স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করেই সাধারণত মার্কিন কংগ্রেস বিদেশি সহায়তা ও নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলো সাধারণত প্রতি বছর মার্চ বা এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। তবে ২০২৪ সালের প্রতিবেদন ২০২৫-এর জানুয়ারিতে প্রস্তুত হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন সম্পাদনার কারণে সেগুলোর প্রকাশ বিলম্বিত হয়ে মে মাস পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে। জানা গেছে, নতুন সম্পাদিত প্রতিবেদনগুলো থেকে বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গসহ সমকামী জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য প্রসঙ্গও বাদ দেয়া হচ্ছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, প্রতিবন্ধীদের ওপর সহিংসতা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা হ্রাস, এলজিবিটিকিউ+ অধিকার এবং মানবাধিকার সংস্থার হয়রানি—সবকিছুই বাদ পড়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো সম্ভবত ট্রাম্প প্রশাসনের পরিবর্তিত বৈদেশিক নীতির প্রতিফলন। উক্ত মেমোতে হাঙ্গেরি, এল সালভাদরসহ ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সখ্যতা রয়েছে এমন ২০টি দেশের প্রতিবেদন বিশেষভাবে সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন, এল সালভাদর বিষয়ক সংশোধিত প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনের কারাগার পরিস্থিতি সংক্রান্ত অংশ পুরোপুরি মুছে ফেলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এল সালভাদোরের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন সংক্রান্ত এক চুক্তির কারণে দেশটির কারাগারগুলোতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ রয়েছে তা আড়াল করতেই এমন সম্পাদনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশটির সাথে সম্প্রতি সম্পাদিত এক অভিবাসন চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র অনিবন্ধিত অপরাধগ্রস্ত অভিবাসীদের অনেক সময় আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও এল সালভাদরের কারাগারে প্রেরণ করছে।
মানবাধিকার কর্মীরা এই পরিবর্তনগুলো উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ, বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবাধিকারের সংজ্ঞার এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদনা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক পল ও’ব্রায়েন বলেন, ‘এই পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় তাদের নেতৃত্বের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।’ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক মহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করবে, বিশ্বব্যাপী দমনমূলক সরকারগুলোকে বাড়তি সুযোগ করে দেবে এবং কতৃত্ববাদী সরকারগুলোর নিপীড়নের শিকার রিফ্যুজিদের যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কঠিন করে তুলবে।