ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও বাংলাদেশ প্রশ্ন

গোলাম সোহরাওয়ার্দী
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯: ২৫

ওয়াশিংটনে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা মন্তব্য তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ ইস্যুটা প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর ছেড়ে দেব।’ অনেকে এর ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।

ভারতীয় মিডিয়া এই বক্তব্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যাতে মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভাগ্য ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে বলে যে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, এর মাধ্যমে তারই সত্যতা মিলেছে। ভারতীয় মিডিয়ার উপস্থাপন এমন ছিল যেন ভারতকে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের সবুজ সংকেত দিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সত্য হলো, দেশটির মিডিয়ায় মার্কিন নীতির বদলে আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে তাদের নিজস্ব বয়ানই প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলাদেশ নিয়ে নাক গলাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র—ট্রাম্পের মন্তব্যে স্পষ্টত তারই প্রতিফলন ছিল। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম একে বাংলাদেশের ওপর ভারতের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সমর্থনের আলামত হিসেবে তুলে ধরেছে। বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নিরপেক্ষতার আভাসই ছিল, অন্যকিছু নয়। একইসঙ্গে এই ঘটনার মাধ্যমে যে বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে, তা হলো মিডিয়ার শাব্দিক অনুবাদ গ্রহণ করা ঠিক নয়, বিশেষত ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে মন্তব্যের আক্ষরিক অনুবাদই সবকিছু নয়।

tramp-modi-2

যেমন কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এর মাধ্যমে ট্রাম্প বুঝিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না। যে বিষয়ে তার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, এ রকম একটি বিষয় সম্পর্কে তিনি কথা বলতে চাননি। তিনি ভেবেছেন, এটা মোদির ওপর ছেড়ে দেওয়াই যথার্থ হবে। প্রত্যুত্তরে মোদিও কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করার সুযোগ লুফে নেননি।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এটা কেবল ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং কৌশলগত জোট গঠন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হবে। এই পরিবর্তন অধিকতর শক্তিশালী বাংলাদেশকে নির্দেশ করছে, যেখানে সফট পাওয়ার ও কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাবে ঢাকা।

বাংলাদেশ এখন আর নিস্ক্রিয় খেলোয়াড় নয়। ভারতের আধিপত্য মোকাবিলায় চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব স্থাপনের মাধ্যমে এটি দৃশ্যমান হয়েছে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহাযোগিতার জন্য প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার ভূকৌশলগত অবস্থান সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাচ্ছে। এক্ষেত্রে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। এতে বোঝা যাচ্ছে, মিত্রতায় বৈচিত্র্য আনতে পররাষ্ট্রনীতিকে আরও সূক্ষ্ম করছে ইউনূস সরকার।

ভারতে বহুবিধ অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। তার ওপর আধিপত্যবাদী অবস্থানের কারণে জটিল হয়ে উঠেছে তার আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষাগুলোও। হাসিনা ও তার দলের সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা সামনে এনেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশটির পুরোনো ভূমিকা। এটি আমাদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব দৃঢ়ভাবে যেকোনো পুতুল শাসনের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের জন্য ইলন মাস্ক কী খেলা দেখাতে পারেন, তা মাথায় রাখা উচিত। ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মাস্কের। তিনি বাংলাদেশ থেকে স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য কাজ করছেন। প্রফেসর ইউনূস ও মাস্কের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কথোপকথনে বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা দেখা গেছে। মাস্ক জানেন, এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও অনগ্রসর জনসাধারণের জন্য গেমচেঞ্জার হতে পারে।

ভারতের বাধার পরও ইলন মাস্কের এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের একটি স্বীকৃতি। মাস্ক বাংলাদেশের এমন একটি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন, ভারত যাকে বৈধ সরকার বলে স্বীকার করে না।

পরিশেষে বলা যায়, চলমান কৌশলগত নিরপেক্ষতা এটিই প্রমাণ করে, ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। স্টারলিংকের মতো অর্থনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে ওয়াশিংটন। মার্কিন অবস্থান এটাও প্রমাণ করে, আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ভারতের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যদি চীন, পাকিস্তান ও ইলন মাস্কের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, সেক্ষেত্রে ভারতীয় আধিপত্য তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক প্রভাবকে সংহত করতে এই অবস্থানকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় বাংলাদেশ।

সাউথ এশিয়া জার্নাল থেকে ভাষান্তর মেহেদী হাসান

Source : dailyamardesh

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here