একাকী বাংলাদেশ? 

নিজাম দস্তগীর

বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীন জাতিসত্ত্বা যাকে সবাই সার্বভৌমত্ব বলে তা টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন হবেl  আমার এই ধারণাটা এসেছে বাংলাদেশের ভৌগলিক এবং বিশ্বের নিকট অতীত ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে l  আপনি ওয়ার্ল্ড ম্যাপের দিকে দেখুন l

সর্ব পশ্চিমে মরক্কো থেকে আফরো-এশিয়ার মধ্য দিয়ে কাজাখাস্তান পর্যন্ত একটা বিশাল অংশ জুড়ে অবিচ্ছেদ্যভাবে যে দেশগুলি আছে তারা সবগুলি মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ l এই দেশগুলির রাজনীতি, ভাষা বা সংস্কৃতি বিভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে একটি অবিচ্ছেদ্য ধর্মীয় বন্ধন l

তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এমনকি অনেক সময় সামরিক সংঘাত হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে এই দেশ গুলির জনগণের ধর্মীয় বন্ধন তাদের প্রতিরক্ষায় বিশাল ভূমিকা রেখেছে l গত কয়েকশত বছরের ইতিহাসই তার বড় প্রমাণ l

অনেকটা এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের মত ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সমর শক্তি ইরাক, আফগানিস্তানের মত দেশ গুলিকে পরাজিত করতে পারে নি l

চেচনিয়ার মত মাত্র দশ লক্ষের অতি ক্ষুদ্র দেশটিকে বাগে আনতে  রাশিয়ার মত পরাশক্তিকে বহু বছর যুদ্ধ করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে l বর্তমানে চেচনিয়ায় নেতৃত্ত্বে যে সরকার আছে তা অনেকটাই অটোনোমাস l

এই বলয়ের বাইরে অল্প যে কয়েকটি মুসলিম সংখ্যা গরিস্ট দেশ আছে বা ছিল, তাদের পরিণতি ভাল হয় নি l যেমন, আলবেনিয়া, বসনিয়া বা মূর যুগের স্পেন l মূর মুসলিমরা স্পেন শাসন করেছিল প্রায় আটশ বছর l সমগ্ৰ ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে ছিল, তখন শুধু স্পেনেই জ্বলছিল সভ্যতার বাতি l পঞ্চদশ শতাব্দীতে ক্রিস্টান ইউরোপ সেই স্পেন থেকে মুসলমানদের মুছে দেয় সম্পূর্ণভাবে l

ইউরোপের আলবেনিয়া ছিল মুসলিম সংখ্যা গরিস্ট দেশ l দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে আনোয়ার হোজ্জার কম্যুনিস্ট সরকার সেখানে ধর্ম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয় l কম্যুনিস্ট শাসনের পতনের পর এখন সেখানে কি পরিমাণ ধর্ম পরায়ন মুসলমান আছে বলা মুস্কিল l

মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর যুগস্লাভিয়া ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয। তাতে যে সিভিল ওয়ার হয়, সেখানে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ বসনিয়াতে চালানো হয়েছে জেনোসাইড, হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানকে। ইউরোপ তাতে কোন কার্যকর বাঁধা দেয় নি। বহু দূর থেকে ইরানের ইসলামী গার্ড কিছুটা হলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল শুধু।

এই বাইরে আছে ছোট ব্রুনাই আর মালেয়শিয়া, কিন্তু তাদের পাশে আছে বিশাল ইন্দোনেশিয়া l তাঁরা কিছুটা হলেও সুরক্ষিত, যদিও কিছুদিন আগে ইস্ট তিমুরকে ইন্দোনেশিয়ার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে l

সেই হিসাবে মুসলিম সংখ্যা গরিস্ট দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একেবারেই দলছুট এবং একাকী l বাংলাদেশই একমাত্র মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ট দেশ যার আসে পাশে কোন মুসলিম সংখ্যা গরিস্ট দেশ নেই l যাকে  সম্পূর্ণ রূপে ঘিরে আছে মুসলিম সংখ‍্যালঘু দেশ ভারত এবং মায়ানমার l

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশিরা এই  ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম। বাংলাদেশের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় আমি এই ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক বাস্তবতার কোন উল্লেখ দেখি না l

কেমন করে যেন এই আলোচনাটা একটি ট্যাবু হয়ে আছে, যেন এটি বিশ্লেষণ করা বা ধর্তব্যের মধ্যে আনা, একটি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘ধর্মীয় এক্সট্রিমিজম’।

অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেই মিয়ানমারের মত দুর্বল একটি দেশ

কোন রকম উস্কানি ছাড়াই তাদের দেশের বিশাল একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আমাদের দেশে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ঠেলে দিয়েছিল l  এটা ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর প্রথম বড় আঘাত।

সেই বিপদের সময় এগিয়ে এসেছিল মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া আর তুরস্কের মত মুসলিম দেশ গুলি l এই মানবতা বিরোধী রাষ্ট্রীয় অপরাধের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস এ সফলতার সাথে কেস দিয়েছে আরেকটি ছোট্ট মুসলিম দেশ গাম্বিয়া !

এত দিনের পুরোনো বন্ধু রাষ্ট্র ভারত এবং চীন তখন কি সাহায্য করেছে ?

শেখ হাসিনার প্রিয় বন্ধু মোদী তখন দ্রুত উড়ে গিয়েছিলেন রেঙ্গুনে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সর্বাত্মক সহযোগিতার l তাদের দিয়েছিলেন একটি সাবমেরিন। অপরদিকে এটা নিশ্চিত যে, চীনের সবুজ সংকেত ছাড়া মায়ানমারের সেনাবাহিনী এই জেনোসাইডাল কাজটি করার সাহস পেত না।

আজ দেখুন ভারতের প্রতি নতজানু সরকারের পতনের পর তাদের কি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া l তারা যে কোন প্রকারে বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারকে একটি সাম্প্রদায়িক সরকার হিসাবে দেখাতে তারা দেশে বিদেশে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তাদের মিডিয়া যেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে, যাতে নিরব সম্মতি আছে মোদি সরকারের। বাংলাদেশের স্বাধীন নতুন সরকারকে অকার্যকর করতে তারা যেন বদ্ধ পরিকর।

তুরস্কে একটি প্রচলিত কথা আছে এই যে, এই দুনিয়ায়  তুর্কিদের কোন বন্ধু নেই l প্রকৃত পক্ষে এই কথাটি বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য l

আমাদের ইন্টেলিজেন্সিয়ার এটি একটি বড় ব্লাইন্ড স্পট l ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁরা এই দিকটি আলোচনায় আনতে নারাজ l  এর জন্য আমাদের কি করতে হবে ?

কোন একটি সম্ভাব্য বিপদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার আগে  তা সর্বপ্রথমে  একনলেজ বা এর সম্ভাব্যতা অনুধাবন করতে হবে l যা আপনি জানেন না, বা বুঝার চেষ্টা করেন না, তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় বের করবেন কিভাবে ?

কয়েক দশক আগেও ভাতৃপ্রতিম দুই রাষ্ট্র ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে মরণ পণ যুদ্ধ হবে তা কি কেউ কল্পনাও করেছিল ?

দেশের ভবিষ্যত এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য এই গুরুত্ত্বপূর্ণ দিকটি কিভাবে আমাদের বিবেচনায় বা ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তা হয়তো একদিন অতি বিস্ময়ের বিষয় হয়ে থাকবে l

নিজাম দস্তগীর  :  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক  ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া