আয় থেকে ব্যয় বেশি, সংসার আর চলে না

আয় থেকে ব্যয় বেশি, সংসার আর চলে না

‘৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে দু’মুঠো শাক, অন্য কিছু কিনতেই শেষ। মানুষ অধৈর্য হয়ে গেছে।’ দামের আগুনে বাজার কীভাবে জ্বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের এক খেদোক্তিতেই পরিষ্কার। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারও কম যাননি। গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ক্রেতা হিসেবে আমিও চাপে আছি।’

খোদ সরকারের উপদেষ্টা পর্যায় থেকে ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরের এমন ‘স্বীকৃতি’ প্রমাণ করে দেয়, পরিস্থিতি কতটা বেসামাল। সদাই করতে থলে হাতে বাজারে ঢুকে যোগ-বিয়োগ মেলাতে পারছেন না ক্রেতা। বেশির ভাগ মানুষের রোজগার স্থির থাকলেও খরচাপাতি যেন দৌড়াচ্ছে! দামের ঝাঁজে অনেক ক্রেতা বাজারফর্দে নিয়মিত চালাচ্ছেন কাঁচি। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে টিসিবি ও খাদ্য অধিদপ্তরের ট্রাকের পেছনে দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও। তাদের মধ্যে অনেকের অসহায় আর্তনাদ– ‘আর পারছি না।’

দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তেমনই একজন রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের আবদুর রহমান। ছেলেমেয়ে সমেত চারজনের সংসার। চাকরি করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাইনে ৪৮ হাজার। ঊর্ধ্বমুখী এই বাজারে সংসার চালাতে রীতিমতো খাবি খাচ্ছেন। সব খরচা বাদ দিয়ে হাতে থাকে বেতনের ১১ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘এ টাকায় মাস চালানো দুঃসাধ্য। চাল-ডাল থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম যেভাবে চড়ে আছে, তাতে ভালো-মন্দ খাওয়া ভুলতে বসেছি। এর মধ্যে পরিবারের কারও অসুখ-বিসুখ হলে পরিচিতজনের কাছে হাতপাতা ছাড়া উপায় থাকে না।’

আবদুর রহমানের মতো সব সাধারণ মানুষের হৃদয়ে এমনই রক্তক্ষরণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বস্তিতে নেই কেউ। অনেক পরিবারের খাবার তালিকা ছোট হয়ে আসায় শরীরে দেখা দিচ্ছে পুষ্টির ঘাটতিও। তবে দাম বাড়ার এই ধারা নতুন নয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের জমানায় জিনিসপত্রের দাম কয়েক গুণ বেড়েছিল। তারাও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দিয়েছিল ব্যর্থতার পরিচয়। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের ‘দামের ঘোড়া’ চ্যালেঞ্জে ফেলেছে অন্তর্বর্তী সরকারকেও। বাজারে লাগাম টানতে যদিও বর্তমান সরকার বিভিন্ন সময়ে ভোগ্যপণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, অভিযান চালানো, আমদানিতে শুল্ককর কমানো, আমদানির অনুমতিসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তাতেও মিলছে না সুফল। এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমানোর পাশাপাশি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রো-ভিসি ও অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা সমকালকে বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ঠিক করতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনা। প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও সক্রিয় হয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাজারে প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি টিসিবির সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রির আওতা বাড়িয়ে যুক্ত করতে হবে নতুন পণ্য।

দাম বাড়ছেই

বাজারে সবজির দর কিছুটা নাগালে থাকলেও চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দর বেড়েছে। মাঝারি চালের কেজি ৫৯ থেকে ৬৫ এবং মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত তিন মাসে এ দুই জাতের চালের কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৯ টাকা। এভাবে অন্য পণ্যের দামও বাড়ছে।

বাজারে যে কোনো একটি পণ্যের দর বাড়লে এর প্রভাব পড়ে অন্য পণ্যে। কারওয়ান বাজারের ফলের ব্যবসায়ী লিটন মিয়া বলেন, ‘এই ব্যবসার আয় দিয়েই চলে আমার সংসার। ফলের দাম বাড়ায় বিক্রি অনেক কমে গেছে। মানুষ ভাত খাবে, না ফল খাবে? নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে অন্য সবকিছুরই দাম বাড়ে। তাই বাড়তি দরে চাল-ডাল কিনতে হলে আমাকেও ফলের দাম বাড়ানো লাগে।’

সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গেল এক মাসে সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর ১১ শতাংশ, চিনির ১, মসুর ডালের প্রায় ৫, আলুর প্রায় ২২, পেঁয়াজের ২২, রসুনের ১০, রুই মাছের ১০ ও গরুর মাংসের ৩ শতাংশ দর বেড়েছে। তবে সরবরাহ বাড়তে থাকায় কিছুটা কমতির দিকে রয়েছে শীতের সবজির দাম। অথচ সরকার চাল, তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ ও ডিম আমদানিতে কোনোটির ক্ষেত্রে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার, কোনোটিতে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে।

শুল্ক ছাড়েও সুফল নেই

অন্তর্বর্তী সরকারকে একরকম চাপে ফেলে ইতোমধ্যে ছয়টি নিত্যপণ্যে শুল্ককর ছাড় করিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। আলু আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নির্ধারণের পাশাপাশি বিদ্যমান ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার। পেঁয়াজ আমদানিতে মোট করভার ১০ শতাংশ পুরোটাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। বড় ছাড় দেওয়া হয় চালে। আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ককর থেকে শুধু ২ শতাংশ অগ্রিম কর রেখে বাকিটা প্রত্যাহার করা হয়। এতে আমদানি পর্যায়ে কেজিতে দাম ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমার কথা। ডিমের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি ডজনে দাম কমার কথা ১৩ টাকা ৮০ পয়সা।

পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল এবং পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ১৫ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

চিনিতে দেওয়া হয় বড় ছাড়। অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনিতে শুল্ককর ১১ টাকা ১৮ পয়সা এবং পরিশোধিত চিনিতে ১৪ টাকা ২৬ পয়সা কমানো হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় দফায় পরিশোধিত চিনি আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক ১ হাজার ৫০০ টাকা কমানো হয়।

মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে ভোক্তা

এদিকে দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহ হ্রাস, সুদের হার বৃদ্ধি, শুল্ক কমানো এবং বাজার তদারকি জোরদার করেছে। তাতেও সফলতা কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয়েছে। এটি গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়লেও বাড়ছে না আয়। অক্টোবরে গড় শ্রম মজুরি বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আবার গড় আয়ের চেয়ে খাবার কিনতে গড় খরচ বেশি ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি আর আয়ের চিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে মানুষ কতটা কষ্টে আছে।

সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি সরকার

দাম বাড়ার পেছনে অনেকে দায়ী করছেন সিন্ডিকেটকে। অন্তর্বর্তী সরকার এখনও সেই সিন্ডিকেটের ভিত নাড়াতে পারেনি। সিন্ডিকেট দমনে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে প্রণীত হয় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ আইন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব আইন প্রয়োগে যে বিচারিক ব্যবস্থা দরকার, সেগুলো অনেক সময় কাজ করে না।

ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ সচল রাখতে হবে, আয় বাড়াতে হবে। তা ছাড়া যেসব ব্যবসায়ী সন্দেহভাজন বা পলাতক, তাদের আনতে হবে বিশেষ তদারকির আওতায়। যাতে তারা বাজার অস্থির করতে পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়তে না পারে। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের অনেক সংস্কার কর্মসূচিই বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কৃষিতে নজর দিতে হবে। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। সে জন্য পুরোনো সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি। কারসাজি যারা করে, তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই স্বস্তি ফিরতে পারে।

টিসিবির ট্রাকে লম্বা সারি

ঢাকার দুই সিটি এলাকায় ৫০ ট্রাকের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবি। প্রতিদিনই ট্রাকের পেছনে থাকছে ক্রেতার লম্বা সারি। অনেকেই পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরছেন। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে দাম বেশি হওয়ায় টিসিবির ট্রাকই তাদের ভরসা। তবে পণ্যের পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়ানোর দাবি তাদের। তেজগাঁওয়ের বাউলবাগ এলাকার রাহেলা বেগম বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আয়-রুজি বাড়েনি। মাছ কিনলে তরকারি কেনা যায় না। তরকারি কিনলে মাছ বাদ দেওন লাগে। এভাবেই চলছে আমগো জীবন।’

তেজতুরীবাজারের মেসে থাকেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনিক হোসেন। তিনি বলেন, ‘টিউশনির টাকায় পড়াশোনা করতে হয়। ফলে মেসে ভালো-মন্দ খাওয়ার সুযোগ কম। কোনোরকম জীবন বাঁচাতে যা কেনা লাগে, সেগুলোরও বেজায় দাম।’

মালিবাগের মো. ইসমাইল বলেন, ‘যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে আর যে টাকা রোজগার করছি, তা দিয়ে এখন সংসার চালানো যাচ্ছে না। প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে হয়। অনেক সময় পরিবারের বাড়তি আবদার মেটাতে গেলে কর্জ করা লাগে।’

samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here