তাহলে তো ২০২১ সালে কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া আফগানিস্তানের তালেবান-পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিরও এখনো সে দেশের বৈধ শাসকই থাকার কথা!
ফিলিপাইনের নির্বাচনী ফলাফল (১৯৮৬) অগ্রাহ্য করা স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস, ইরানের বিপ্লব (১৯৭৯) ঠেকাতে ব্যর্থ শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি এবং চীনের মূল ভূখণ্ডে মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টদের বিজয় (১৯৪৯) রুখতে না পারা রাষ্ট্রপ্রধান চিয়াং কাইশেক দেশত্যাগী হলেও কেন তাঁরা তাঁদের দেশে মরণোত্তর বৈধ শাসকের মর্যাদা পাবেন না?
আরও অনেকেই গণরোষ অথবা বিপ্লবের তোপে প্রাণ হাতে নিয়ে পদত্যাগ না করেই দেশ থেকে পালিয়েছিলেন। তাঁরা গদি ফিরে পেয়েছিলেন কি না, তা সম্ভবত আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত সহিংসতার ‘গুরু’ নানক সাহেবরা জানেন না।
সম্ভবত সে কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে ‘তিনি এবং তাঁরা’ দাবি করেছেন, শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী।
কয়েক দিন আগে বঙ্গভবনে অবস্থানরত হাসিনা-নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পলাতক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রের কপি হাতে পাননি বলার পর আওয়ামী লীগের নৌকা যেন হালে পানি পায়।
শুরু হয় ‘হুক্কাহুয়া’। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ওঠে।
সিনিয়র সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি এই যে ‘গল্পখানি’ শুনিয়েছেন, তা শুধু তাঁর ৬ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে হাসিনার পদত্যাগের স্বীকৃতিকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না, আইনি বিশ্লেষণেও তা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’
এ সময় তিন বাহিনীর প্রধানেরা তাঁর পেছনে দণ্ডায়মান ছিলেন। পুরো জাতি সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন।
এরপর তিনি বলছেন, তাঁর কাছে নাকি পদত্যাগপত্র নেই। মিডিয়াতে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার খবর প্রকাশ পেল আর তা বঙ্গভবন থেকে হারিয়ে গেল! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
ইতিমধ্যে বেশ কিছু টেলিফোন আলাপের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। সেসব অডিওতে শেখ হাসিনাকে কথা বলতে শোনা গেছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে।
এসব টেলিকথোপকথন যে শেখ হাসিনারই, তা কর্তৃপক্ষ থেকে বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না করা হলেও এটি যে শেখ হাসিনারই কণ্ঠস্বর, সে বিষয়ে প্রায় কেউই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষও কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেননি।
‘ফাঁস হওয়া’ অনেকগুলো অডিওর একটিতে ‘শেখ হাসিনাকে’ বলতে শোনা গেছে, ভারতে যাওয়ার আগে তিনি গণভবন থেকে পদত্যাগ করতে বঙ্গভবনে যেতে পারেননি।
তবে তিনি কোন আপস ফর্মুলার অধীনে ঢাকা ত্যাগের সুযোগ পান তা স্পষ্ট করেননি। সে কারণে এখন তিনি পদত্যাগপত্রে সই করেছেন বা করেননি, তাতে কার কী এসে যায়?
হাসিনার বিনা নোটিশে দৃশ্যপট থেকে প্রস্থান ক্ষমতাবলয়ের সুবিধাভোগী এবং সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের জন্য একটি তীব্র ট্রমা।
এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে তাঁরা হয়তো বিশ্বাস করতে চান, ‘ম্যাজিক লেডি’ নিশ্চয়ই ‘ফুরুং ফারাং ফাঁস’ বলে দেশে ঢুকে পড়বেন এবং কিছু একটা ঘটে যাবে।
তাঁদের দিক থেকে সেই চেষ্টা হবে অনুপ্রেরণার সন্দেহ নেই। তবে বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনা যদি হত্যা, গুম, দুর্নীতি, ভোট ডাকাতি, অর্থ পাচার, দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপসহ কোনো অপরাধ করেননি বলে আত্মবিশ্বাসী হন, তাহলে তিনি ফিসফিস না করে দেশে ফিরে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন।
তিনি তা করলে অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভারতের সঙ্গে অপরাধীর বহিঃসমর্পণ (এক্সট্রাডিশন) প্রক্রিয়া ছাড়াই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে হেফাজতে নিতে পারবে।
আওয়ামী মানসের পরাজয়ের গ্লানি, ভয় ও স্বর্গ হারানোর বেদনা অনুমান করা যায়। কিন্তু বিপ্লবের পক্ষের মানুষের ‘করোনাভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী’ প্রতিপক্ষের জন্য দরদ দেখানো একটু মুশকিলের।
কারণ, হত্যাকাণ্ড এবং বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেওয়া হাসিনার প্রশাসন ও দল শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ও সহাবস্থানের পথ খোলা রাখেনি।
২০১৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর এবং ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের আগেও যদি শেখ হাসিনাই বৈধ প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকতেন, তাহলে ৫ আগস্ট তিনি এবং তাঁর দলবল এক দিনেই হাওয়া হয়ে গেলেন কেন?
জনপ্রিয় দলের কর্মী-সমর্থকদের তো বড় মিছিল করার কথা। কেনই বা পিছু হটা আয়োজনে হাসিনা যেখানে আশ্রয় পেলেন, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের সদ্য শপথ নেওয়া প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানালেন?
কারণ, হাসিনার পৃষ্ঠপোষকেরাও দেখেছেন, ঢাকায় কোটি জনতার ঢল, বড় বড় নগরে লাখ লাখ মানুষের মিছিল, মফস্বল শহর এবং সারা দেশের গ্রামে গ্রামে বিজয়োল্লাস।
ওই সব মিছিল ও সমাবেশই হাসিনার অবৈধ শাসন চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান এবং নতুন বাংলাদেশ ও জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণের বৈধতা দেওয়ার মুহূর্ত।
এটি ফ্যাসিবাদী ইতিহাসের আপাতত দাঁড়ি টানা (‘পিরিয়ড’ বা ‘ফুল স্টপ’)।
পেছনে ফিরে দেখুন, হাসিনার আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি আস্থাশীল হলে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপিসহ তখনকার বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করার সাহস পেত।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে তারা ভোটে পরাজিত হলে পরাজয় মেনেও নিত।
ভুলোমনাদের স্মরণ করিয়ে দিই, ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টির ফলাফল বিনা ভোটে নির্ধারিত হয়েছিল এবং বাকি নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি।
২০১৮ সালে আগের রাতে ব্যালট বাক্স বোঝাই করায় ‘উহাকে নৈশকালীন নির্বাচন বলা হইয়া থাকে’।
২০২৪ সালে আরেকটি একতরফা নির্বাচনে ৯৫ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্র বর্জন করে হাসিনা আমলের নির্বাচন কেমন তা আবারও প্রমাণ করে দেয়।
একদা ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ উপাধি পেতে আকুল হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিলেন।
সুতরাং জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের আগে থেকেই শেখ হাসিনা সরকারের ‘জনপ্রিয়তার বৈধতা’ (পপুলার লেজিটিমেসি) ছিল শূন্যের নিচে বা মাইনাসে।
তারাই আজ উল্টো ইউনূস সরকার এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সেই সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, যে বৈধতা তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গণমানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে শতাব্দীর এক অনন্য বিপ্লব উড়িয়ে দিয়েছে।
হাজার মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই বিপ্লবে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও হাসিনার আওয়ামী লীগ অপরাধবোধ (রিমোর্স) না দেখিয়ে অজ্ঞাত স্থান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। তারা সবকিছু ওলট-পালট করে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে।
ফ্যাসিবাদের উপকারভোগীদের নিশ্চয়ই সেই পরিমাণ অর্থ, নেটওয়ার্ক, জনবল ও দম আছে, যাতে চলমান সংস্কার ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে নাশকতা করা যায়।
এসব প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মনে করিয়ে দিচ্ছে, আসলেই দলটির আদর্শ ফ্যাসিবাদ।
১৯৭৫ সালেও হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিজের ‘মহৎ মৃত্যু আনি’ একদলীয় বাকশাল-ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন।
অতিশয় ইতিহাসসচেতন দলটির নিজস্ব ফ্যাসিবাদী লিগাসির জন্যই হয়তো এর ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে নিমজ্জিত ছিল।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ হলেও এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে শক্তিশালী কোনো যুক্তি থাকছে না।
এখন বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ প্রকাশ্য, যৌক্তিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক সহানুভূতি পাওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
সেই দলকে জীবিত করতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসনে কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
অথচ জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি পার্টির মতো বিচারের মুখোমুখি হতে পারে আওয়ামী লীগও।
আওয়ামী ভাবনায় যা-ই হোক, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ কেবল ডক্টর ইউনূস সাহেবের উপদেষ্টা পরিষদের বিষয় নয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনে যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং ভালো কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে জাতির জন্য, তা হাতছাড়া করা তো যাবেই না; বরং এটা যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা হবে শুভ শক্তির জাতীয় দায়িত্ব।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুজব অধিকাংশ সময় সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
যেমন সেনানিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর সরকার এবং ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের গুজব আগে থেকেই বাজারে ছিল।
যাহোক, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তাঁর জাতীয় পার্টির সহযোগিতায় দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের অত্যাচার, অবিচার, দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড সহ্য করে নব্বইয়ের সফল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরও স্বৈরাচারী এরশাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের মূল্য জাতি দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসরণ করার ভুল স্বীকার করেনি, জাতির কাছে মাফ চাওয়া তো বহু দূরের কথা।
এবারও কায়দাটা ঠিক করছে ইউনূস সরকারকে নিন্দিত করার প্রকল্প হাতে নিয়ে। দেশের ও গণতন্ত্রকামী জনগণের অমঙ্গল কামনায় দিন কাটছে ফ্যাসিবাদ সমর্থকগোষ্ঠীর।
এ ব্যাপারে বিপ্লবের পক্ষের সব শক্তির অনুধাবন করা দরকার, নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথ খুব মসৃণ হবে না। বিপ্লব কারও কাছে বর্গা দিলে বিপ্লবের উদ্দেশ্য নস্যাৎ করতে প্রতিবিপ্লবীরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে ‘বর্গাচাষিদের’।
আওয়ামী ভাবনায় যা-ই হোক, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ কেবল ডক্টর ইউনূস সাহেবের উপদেষ্টা পরিষদের বিষয় নয়।
রাজনৈতিক পরিবর্তনে যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং ভালো কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে জাতির জন্য, তা হাতছাড়া করা তো যাবেই না; বরং এটা যারা বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা হবে শুভ শক্তির জাতীয় দায়িত্ব।
- খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক
- prothom alo