শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। দেশের অভাবনীয় এক পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুরোধে তিনি এই দায়িত্ব নেন। নতুন বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন, গুরুত্বপূর্ণ নানা খাতে সংস্কারের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ।
প্রথম আলো:ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপনাকে শুভেচ্ছা। দুই মাস হয়নি আপনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। একদম নতুন সময়, একদম নতুন দায়িত্ব, যেটা হয়তো আগে কখনো ভাবেননি। এই দায়িত্ব আপনার কেমন লাগছে? আপনি কেমন আছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আছি। ভালো আছি। একটা নতুন দায়িত্ব। বড় দায়িত্ব। দায়িত্ব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে যে একটা দায়িত্ব এল, সেটা বহন করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা, সেটাকে কাজে পরিণত করতে সচেষ্ট আছি।
প্রথম আলো:আমরা জানি যে দুই দশক ধরে আপনাকে অনেক গালাগাল শুনতে হয়েছে। আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে। পদ্মার পানিতে আপনাকে চুবানোর কথাও হয়েছে। আপনার তো জেলে যাওয়ার কথা, হয়তো এ সময় আপনার জেলে থাকার কথা ছিল। হঠাৎ করে সবকিছু বদলে গেল। আপনিই এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটা অবাক করা, অদ্ভুত ও বিস্ময়কর পরিবর্তন। এমন কিছু যে হতে পারে, আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন?
ড. ইউনূস: এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতার মতো। আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম। একেবারে উল্টো একটা অবাক চিত্র। অতীতেও এ রকম আহ্বান জানানো হয়েছিল আমাকে। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। মাফ চেয়েছি বরাবর। এটা কোনো দিন সিরিয়াসলি ভাবিনি যে দায়িত্ব নিতে হবে। এবার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। এ জন্য দায়িত্বও নিয়েছি।
প্রথম আলো:আপনি কীভাবে এই বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কীভাবে হলো? আপনি কোন পর্যায়ে এসে সম্মতি দিলেন?
ড. ইউনূস: ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পত্রিকায় টেলিভিশনের নিউজে তাঁদের দেখছিলাম। বরাবর যেভাবে আন্দোলন হয়, এভাবেই দেখছিলাম। আমি তখন বিদেশে ছিলাম যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। প্যারিস অলিম্পিকে একটা দায়িত্ব পালন করছিলাম। ওটার ডিজাইনিংয়ে আমি ইনভলভড ছিলাম। এ সময়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় প্যারিসের একটা রাস্তার নাম আমার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, সেটার উদ্বোধন করেছিলাম। কাজেই আমি এদিকে দেখছি, ওই দিকেও দেখছি, দূরের দৃশ্য হিসেবে।
আমার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তারা বলছিল: ‘স্যার এখন ফিরবেন না, এখন অবস্থা ভালো না। এলেই বোধ হয় আপনাকে জেলে নিয়ে যাবে। আপনি একটু দূরে থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে বলব, কখন আসতে হবে।’ কাজেই আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং এ রকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখো। তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে।
আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ যে আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি এ ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন যে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।
প্রথম আলো:এই সিদ্ধান্ত তো আপনি নিলেন। ছাত্রনেতারা ছাড়া বাইরের আর কারও সঙ্গে কি আপনার পরামর্শ করার সুযোগ হয়েছিল?
ড. ইউনূস: আর কে যে আছে, তা–ও তো আমি জানি না। আমার কিছু জানা ছিল না।
প্রথম আলো:ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক…
ড. ইউনূস: এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।
প্রথম আলো:আপনি দেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, দুই মাস আগে। সময়টা ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। সময়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. ইউনূস: একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।
প্রথম আলো:আপনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর আপনার কখনো বঙ্গভবনে, গণভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। নাকি গিয়েছেন?
ড. ইউনূস: আমি গিয়েছি যদ্দিন আওয়ামী লীগের বাইরের সরকার ছিল, তারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছে। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও আমি দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম।
প্রথম আলো:এবার আপনি আবার জাতিসংঘ অধিবেশনেও যোগ দিয়ে এলেন। সব প্রথা ভেঙে জো বাইডেনের সঙ্গে আপনার বৈঠক হলো। তারপর বিল ক্লিনটন। এর বাইরেও আরও অনেক রাষ্ট্রনেতা। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আমরা দেখলাম, অনেক উৎসাহ–উদ্দীপনা বাংলাদেশের পরিবর্তনে এবং সেটা আপনাকে কেন্দ্র করে। আপনার উপস্থিতি, আপনার পরিচিতি অনেক কাজে লেগেছে। অনেক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। সব মিলিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে?
ড. ইউনূস: একটা হলো, তাদের সবার মনে উৎসাহ জেগেছে। উৎসাহ জেগেছে যে এই দেশটা আবার নতুন করে দাঁড়াতে পারবে। দেশের যে গতিপ্রকৃতি তারা দেখছিল, তাতে তারা উৎসাহ বোধ করছিল না। এই পরিবর্তনের ফলে এবং আমাকে সামনে পেয়ে এদের অনেকেই খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এদের অনেকেই ছিল আমার পরিচিত মুখ ও বন্ধু, যাদের সঙ্গে আমার আগে থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজেই আমাকে কাছে পেয়ে তারা খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এবং সেই উৎসাহ তারা নানাভাবে প্রকাশ করেছে।
আমরা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বৈঠক বন্ধুদের বৈঠকে পরিণত হয়েছে। আলাপ হয়েছে, কী দরকার তোমরা বলো, সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নেব। সত্যি সত্যি তারা তাদের লোকজন নিয়ে এসেছে। অফিসারদের অনেকে আমাকে চেনে, যেহেতু নানা কাজে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেভাবেই তারা গ্রহণ করেছে এবং খুব উৎসাহসহকারে করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য–সহযোগিতা কী দরকার আমাদের। আমিও একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে অতীতের মতো করে দেখলে হবে না। নতুন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন ভঙ্গিতে চিন্তা করতে হবে। আগের ক্যালকুলেশন বাদ দিতে হবে। অনেক বড় স্তরের ক্যালকুলেশন দিতে হবে। আমরা বড় জাম্পে যেতে চাই। এবং আগে অনেক শর্ত দিয়ে যেভাবে রাখছিল, সেভাবে না। যার সঙ্গেই আলাপ হচ্ছিল, এই একটা বিষয়ে জোর দিচ্ছিলাম। তারাও অ্যাপ্রিশিয়েট করছিল। সঙ্গে সঙ্গে একজন তো ওখান থেকে ফোন করে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছিল, ওইটা করে দাও।
আমরা কথা বলছি আর ফাঁকে ফাঁকে নির্দেশও চলে যাচ্ছে। তো খুব উৎসাহ বোধ করলাম। আমি বললাম, শুধু টাকার অঙ্ক বাড়ালে হবে না, এটার যে গতি…আমরা এখানে চুক্তি সই করলাম, ওই টাকা আসতে আসতে বহু বছর লেগে যায়, শেষ পর্যন্ত ওটা কাজে লাগে না। আমি বলেছি, আমাদের দ্রুতগতিতে দরকার। এই পরিবর্তনে আশু পরিবর্তন দরকার। কাজেই সব রকমের আয়োজনের যে ব্যবস্থা তোমাদের আছে, তা সংক্ষিপ্ত করে আমরা যাতে কাজে লেগে যেতে পারি, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করো। সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলল: আমরা বিষয়টা বুঝেছি। দ্রুতগতিতে যাতে হয়, আমরা সেটার ব্যবস্থা করব।
প্রথম আলো:তারা দ্রুতগতিতে করল। আপনাকেও তো সবাইকে নিয়ে দেশে কিছু করার বিষয়টি দেখতে হবে। সে জন্য সংস্কারের যে উদ্যোগগুলো আপনি নিয়েছেন, সেগুলো জরুরি।
ড. ইউনূস: অবশ্যই। আমাদের জোর ছিল সংস্কারে। আমাদের যদি সংস্কার করতে হয়, দ্রুতগতিতে করতে হবে। ধীরে–সুস্থে সংস্কার করার সুযোগ আমাদের নেই। কাজেই সেই সংস্কারগুলো আমাদের এখন থেকে শুরু করতে হবে। একটা বিধ্বস্ত কাঠামোর ওপর আমরা শুরু করেছি।
প্রথম আলো:আমি এখানটায় আসছিলাম। আপনি তো বাইরে থেকে সরকারের ভেতরটা অতটা জানতেন না। সাধারণভাবে জানতেন অন্যায়, অবিচার, রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি ইত্যাদি। তো আপনি এসে কী দেখলেন? কী পেলেন?
ড. ইউনূস: ভাঙা হাট। কোনো জিনিস ফাংশন করে না। একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্ট্রাকচার আছে, এক ব্যক্তিপূজার জন্য যা যা লাগে, সে ব্যবস্থাগুলো আছে। ওনার হুকুমে কী কী হয়, ওনার ইচ্ছাপূরণের জন্য সব ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণের জন্য তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। কাজেই এ রকম একটা ভাঙাচোরা জনপ্রশাসন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।
প্রথম আলো:আপনাদের যাত্রা তো অনেক কঠিন…।
ড. ইউনূস: অত্যন্ত কঠিন।
প্রথম আলো:আপনি আসার আগে এতটা বুঝেছেন কি?
ড. ইউনূস: ভেতরে ঢুকে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল। আগে আবছা আবছা বুঝতাম যে এটা এ রকম। কিন্তু এটা যে এত ভাঙা, তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। নির্দেশ কী উদ্দেশ্যে দিয়েছিল, কী করেছিল এবং টাকাটা কীভাবে খরচ হয়েছিল, চুক্তিটা কেন হয়েছিল, নানা রকম বিষয়। কাজেই টাকার বণ্টন কীভাবে হয়েছিল? সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল, যে যেখানে পারো নিয়ে নাও, এই হলো সুযোগ। এভাবেই চলেছে। সেই পরিস্থিতি থেকে নিয়মশৃঙ্খলায় আসা, আমাদের তো আর কোনো রাস্তা নেই। কাজেই এটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে আসা খুব কঠিন কাজ।
প্রথম আলো:কাজটা কঠিন আবার সময়সাপেক্ষ। গত ৮ আগস্ট বিমানবন্দরে নেমেই বলেছিলেন, আপনার প্রথম কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা। এ ক্ষেত্রে আপনারা কতটুকু সফল হলেন?
ড. ইউনূস: চেষ্টা করছি। এখনো সফল হইনি। এখনো তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু এখনো উন্নতি হয়নি। কিঞ্চিৎ হয়েছে হয়তো। কিন্তু যে পর্যায়ে আসার কথা, সেই লেভেলে হয়নি। কাজেই আমাদের সার্বিক চেষ্টা হবে, ওটাকে আগে স্থির করা। এটা প্রথম কাজ। এটা না করলে তো বাকি জিনিস করতে পারছি না।
প্রথম আলো:অবশ্য কাজটা এত সহজও নয়। পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়েছে। এখন মানুষকে আশ্বস্ত করবেন কী দিয়ে? আপনি কি প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন?
ড. ইউনূস: ওপর থেকে তো সব সহযোগিতা আছে। কিন্তু গুঞ্জন শুনি, এখানে গোপনে বসে আছে। আমরা এগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এগুলো শুনলে কিন্তু কোনো কাজ করা যাবে না। যেভাবে আছে, সেভাবেই আমরা চলছি। যেহেতু পুলিশের পুরোপুরি সার্ভিসটা আমরা পাচ্ছিলাম না, সে জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন এগিয়ে আসে। তারা এগিয়ে এল। তারপর বলল, আমাদের তো কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠল। আমরাও রাজি হলাম। প্রাথমিকভাবে তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দুই মাসের জন্য দিলাম। যাতে করে তারা মাঠে নামতে পারে।
প্রথম আলো:দুই মাস সময়টা কি আপনি যথেষ্ট মনে করছেন?
ড. ইউনূস: আমরা মনে করলাম, প্রথম দুই মাস দিয়ে দেখি। যদি মনে হয় কাজ হচ্ছে, তাহলে তো তা বাড়াতে হবে। আশা করি, তারাও সম্মত হবে। এটা নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে চাইছি। তবে দুই মাস পরীক্ষামূলক বিষয়। নানা রকমের দুশ্চিন্তাও আসে। এটাতে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় কি না। একজন না বুঝে ক্ষমতার একটা অপব্যবহার করে ফেলল, তাহলে তো সেনাবাহিনীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য, অফিসার যদি তা করে, এটার দুর্নাম সেনাবাহিনীর ওপর আসবে। আমাদের ওপরও আসবে, কেন আপনি এটা দিলেন। আমরা সেটাও দেখতে চাইছি, তারাও সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো:আপনি বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। কাজের যা অগ্রগতি, তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট?
ড. ইউনূস: এটা নির্ভর করে আপনি কি এক্সপেক্ট করেন। সরকার একটা মহা–ইঞ্জিন। এই মহা–ইঞ্জিন আমরা চালু করার চেষ্টা করছি। প্রথমে আমরা ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে চেষ্টা করছি, চালানো যায় কি না। এটা নড়লে আমরা সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ারের দিকে যাব। এটা হলো বিষয়। আমরা এক ধাপে থার্ড গিয়ারে চলে গেলাম, ফুল স্পিডে চলে গেলাম, এটা সম্ভব না। কাজেই ওই গতিটা আমাদের অ্যাডজাস্ট করতে হবে। তারপর যেন পুরো স্পিডে যেতে পারি। এটা কিন্তু বেশি সময় দিলে তা–ও হচ্ছে না। আমাদের তো কাজের মধ্যে নামতে হবে। কাজ তো অনেক, অফুরন্ত কাজ আছে।
প্রথম আলো:আপনি যে গতির কথা বললেন, মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা যে দৃশ্যমান উদ্যোগ, গতি যেন তারা দেখতে পায়, বুঝতে পারে। এ রকম একটা অবস্থা। এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
ড. ইউনূস: আমাদেরও মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। যেটা হচ্ছে তাতে আমরাও তো খুব খুশি না। এটা ঠক্কর ঠক্কর করে চলা তো কারও ইচ্ছা না। দেখেন যত দ্রুত আমরা চালু করে ফেলতে পারি, অগ্রসর হতে পারি নরমাল স্পিডে, সেটাই আমাদের চেষ্টা।
প্রথম আলো:এটাও তো বাস্তবতা যে এত পুঞ্জীভূত সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ তারপরও দেখতে চায় যে আপনারা চেষ্টা করছেন।
ড. ইউনূস: কিছু ভালো হচ্ছে। যেমন সবাই বলছেন ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু ভালো হচ্ছে। আবার এদিকে বলে যে পুঁজিবাজারে গোলমাল হচ্ছে। কাজেই একটা ভালো হয় তো আরেকটা খারাপ হয়। একটা শুধরে আসি তো আরেকটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য থেকে আমাদের আসল কাজগুলো করে ফেলতে হবে। আমাদের নিয়মের মধ্য নিয়ে আসতে হবে সবকিছু। নিয়মটা যেন আমরা পালন করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল ছিল, সেগুলো সচল করা ছাত্রদের নিয়ে আসা, ভিসি নিয়োগ করা। অফুরন্ত কাজ। কাজের কোনো শেষ নেই। যেদিকে দেখবেন, এগুলো খালি। অনেক বড় কাজ। এর মধ্যেই গতি সঞ্চার করা। একটা হলো কাজটা শুরু করা।
প্রথম আলো:আপনার এই বড় মেশিনে কাজ চালু করার জন্য আরও কোনো উদ্যোগ নেবেন। নতুন কোনো সদস্য উপদেষ্টা পরিষদে যোগ করবেন? আরও কিছু কমিশন করবেন?
ড. ইউনূস: কমিশনটা আমি অন্যভাবে দেখছি। যন্ত্রটার কথা বলি। যন্ত্রটা চালু করার জন্য মাঝেমধ্যে আলাপ হয়েছে যে আরও কয়েকজন সদস্য নিলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে পাকা কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টা খোলা আছে। এ অবস্থাতেই আমরা আছি। তবে আমরা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যসংখ্যা খুব একটা বাড়াতেও চাই না। এতেও একটা বড় রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়।
প্রথম আলো:আপনি জানেন যে বিগত সরকারগুলোর আমলে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ৬০–৭০ ছিল…
ড. ইউনূস: আমরা ওই ধরনের চিন্তা করছি না। আমরা খুব ছোট আকারে যেতে চাইছি। দেখা যাক আমরা কত দূর পারি। সমস্যা হলো কি, টিম যত বড় হয়, তাতে ইশারা এবং একজনের সঙ্গে অন্যজনের সংগতিপূর্ণ কাজ করাটা মুশকিলের হয়ে যায়। ছোট টিমেও সমস্যা। নতুনভাবে সবাই সবার পরিচিত নয়। কাজেই টিম গঠন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সেটা দ্রুত করতে পারি না। চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু সফল হয়েছি, এ কথা বলার সময় আসেনি।
প্রথম আলো:শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কদের সরকার পরিচালনার অংশ করেছেন। তাঁরা উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন। এটা একেবারেই নতুন এক অধ্যায়। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
ড. ইউনূস: একটা হলো আমার অভিজ্ঞতা। একটা হলো আমার ধারণা। আমি বরাবরই বলে এসেছি যে তরুণদের হাতে পৃথিবী ছেড়ে দেওয়া দরকার। তারা আরেক জগতের মানুষ। আমরা তাদের আটকে রেখেছি। আমরা যারা বয়স্ক, তারা পুরোনো চিন্তা, পুরোনো ধারণা, পুরোনো কাঠামো নিয়ে তাদের আটকে রেখেছি। নতুনেরা তাদের নতুন ধারণা, নতুন চিন্তা, নতুন কাঠামো নিয়ে অগ্রসর হবে। এ পথ ছেড়ে দিতে হবে। কাজেই আমরা বলছি যে যত তাড়াতাড়ি পারি সব দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আমাদের দায়িত্ব বাহবা দেওয়া। এটা আমার বক্তব্য ছিল। এখানে এসে সেই সুযোগ পেলাম। ওরা রাজি আমিও রাজি যে ঠিক আছে, আমরা কাজটা করি। যাঁরা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আছেন, তাঁদের চেয়ে এই ছাত্র দুজন কোনো অংশে কম কেউ বলতে পারবেন না। শুধু আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে না, অতীতেরও উপদেষ্টামণ্ডলীর সঙ্গে যদি তুলনা করেন, কেউ বলতে পারবে না, এঁরা তাঁদের চেয়ে দুর্বল। তাঁরা অনেক সজাগ, সতর্ক। অনেক চিন্তাভাবনা করে কাজ করছেন।
প্রথম আলো:এটাও তো আমাদের দেশের জন্য একটা নতুন ধারণা। ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৯০—এই আন্দোলনগুলো মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বেই হয়েছিল। কিন্তু পরে দেশ পরিচালনা বা এটাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্ররা সেই সুযোগটা পায়নি। কাজেই এটা তো আমাদের জন্য একদমই নতুন।
ড. ইউনূস: আমাদের দেশের জন্য নতুন। অন্য দেশে তরুণদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্য দেশে তরুণেরা প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। ৩০–৩৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট। কাজেই তরুণদের অবহেলা করার কোনো কারণ নেই।
প্রথম আলো:সেটা তো শুধু জুলাই–আগস্ট নয়, কয়েক বছর ধরে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা তারা প্রমাণ করেছে। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা নতুন ধরনের নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
ড. ইউনূস: অবশ্যই।
প্রথম আলো:১/১১–এর সরকারকে সেনাবাহিনীর সরকার বলা হয়ে থাকে। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সেনাবাহিনী ছিল, সামনে কয়েকজন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি। এখন সেনাবাহিনী আপনার সঙ্গে আছে, উদ্যোগ নিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষ দিনগুলো, আগস্টের প্রায় দুই সপ্তাহ। মোটামুটি প্রক্রিয়াটাকে একটা জায়গা নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা তাদের ছিল। এখন নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ভূমিকা আপনি কী দেখেন? কী চান? বা কী মনে করেন?
ড. ইউনূস: আমি যেটা মনে করি, সেনাবাহিনীও সেটা বোঝে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সে ভূমিকা পালন করবে। সেটা সরকারের যেসব নির্দেশ থাকবে, সেটা তারা পালন করে যাবে। সেটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নমুনা। শুরুতেই যদি আমরা সেই ভূমিকাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলি, তাহলে তো গণতন্ত্র আর এগিয়ে যেতে পারল না। এখানেই শেষ হয়ে গেল। তো সেখানে আমাদের আর থাকারই–বা দরকার কী! যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে আমাদের কোনো ভূমিকাও নেই।
প্রথম আলো:এবার কিন্তু আমরা ১/১১–এর চেয়ে অন্য রকম দেখি। সেনাবাহিনী সামনে আসছে না। এটা হয়তো আপনাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস, আস্থা। এটাও একটা বড় কারণ।
ড. ইউনূস: আমিও সে কথাই বলছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সে ভূমিকাই তারা পালন করছে এবং করে যাবে।
প্রথম আলো:সেখানে আপনি তাদের সব সহযোগিতা পাচ্ছেন?
ড. ইউনূস: আমাদের তো এ পর্যন্ত কোনো কমপ্লেইন করার সুযোগ হয়নি। বরং আমি বাহবা দিয়ে এসেছি। বাহবা দিয়েছি এ জন্য যে পরিবর্তনটা হলো, সেনাবাহিনী যদি এগিয়ে না আসত, এটা তো রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেতে পারত। কাজেই তারা এগিয়ে এসেছে। ঠান্ডা মাথায় কাজটা করেছে এবং ছাত্রদের সামনে রেখে। বলেনি যে তোমরা সরো, এবার আমরা নিয়ে নিলাম। বলেনি তারা।
প্রথম আলো:অনেক রক্তারক্তির মধ্যে তারা এসেছে। পরে এসে তারা এটাকে সামাল দিয়েছে। প্রক্রিয়াটাকে অগ্রসর করে দিয়েছে।
ড. ইউনূস: না হলে তো আরও রক্তারক্তি হতে পারত। যদি সেটা তারা সে সময় না করত; ভয়ংকর ব্যাপার হতো।
প্রথম আলো:বিশেষ করে ৩ আগস্ট তাদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জনগণের বিরুদ্ধে তারা গুলি ছুড়বে না।
ড. ইউনূস: এটা মস্ত বড় একটা সিদ্ধান্ত।
প্রথম আলো:আমরা দেখছি যে আপনাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা হয়, হওয়া উচিত। কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, কোনো সিদ্ধান্ত—এতে মানুষের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। এটা সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ কি না, সেটাও আলোচিত হয়। আবার কখনো মনে হয় সমন্বয়হীনতা। এ রকম কিছু সমস্যা কি আপনি দেখেন?
ড. ইউনূস: একেকজন একেকভাবে দেখতে পারে। আমি বলব, সরকারের একটা স্ট্রং পয়েন্ট হচ্ছে, আমরা ভুল করলে শুধরে নিচ্ছি। আমরা গোঁয়ার্তুমি করে ধরে রাখলাম না। আমি সরকার বলে ফেলেছি, এটা আর পাল্টানো যাবে না, যা হওয়ার হবে। এ রকম তো আমরা করছি না। পরে আমরা দেখলাম, এভাবে না করে অন্যভাবে করলে ভালো হয়, পরে সেটা করে দিয়েছি। আমাদের এটা সবলতা মনে করি। আমাদের পুনর্চিন্তা করার শক্তি আছে। ভুল মনে করলে সংশোধন করছি। আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। যেটা যথাযথ, সেটাই করছি।
প্রথম আলো:একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেল। সুযোগ আগেও এসেছিল। ’৯০–এর এরশাদ পতন, কয়েকটা ভালো নির্বাচন, ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ইত্যাদি। তারপরও তো তেমন পরিবর্তন হয়নি। চরম স্বৈরতান্ত্রিক একটা সরকার পেলাম আমরা। আমরা তো শিক্ষা নিই না। এবার কি আমরা শিক্ষা নেব? আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ড. ইউনূস: আমি এভাবে দেখি। মস্ত বড় একটা সুযোগ এসেছে আমাদের জাতির জীবনে। এ রকম সুযোগ অতীতের যত বর্ণনা দিলেন, কোনোকালেই আসেনি। ছাত্ররা একটা সুন্দর বাক্য ব্যবহার করেছে এবং আমরা সবাই সেটা গ্রহণ করি। সেটা হলো সংস্কার। অতীতে আমরা সংস্কারের দিকে যাইনি। শুধু এক সরকার থেকে আরেক সরকারে চলে গিয়েছি। এবার সংস্কারের একটা বিষয় এসেছে এবং সেটাকে আমরা সামনে রেখেছি। এই হলো মুখ্য বিষয়।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় বিষয় হলো সংস্কার। নির্বাচন তো যেকোনো সময় যে কেউ দিতে পারে। আছে নিয়মমাফিক দিলাম, কেউ ভোট চুরি করল, দখল করলাম। কিন্তু এবার হলো সংস্কার। সংস্কার মানে হলো অতীতে যা যা ঘটেছে, আমরা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। এটার জন্য আমাদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলায় ১০০ ভাগ হয়তো হবে না, তবে কাছাকাছি যতটা যাওয়া যায়, সারা জাতিকে একত্র করে করতে হবে। গায়ের জোরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকার বসে কিছু করবে না। সবাইকে নিয়ে করবে। আপনারা বলেন, কী হলে সে জিনিসগুলো ভবিষ্যতে হবে না, সে জিনিসগুলো দিন। আমরা সবাইকে বোঝাই, রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাই, বলেন আপনারা কী কী সংস্কার করতে চান। এ সুযোগ কিন্তু আপনারা আর পাবেন না। নির্বাচিত সরকার এসে গেলে এ সুযোগ আর পাবেন না। সম্ভব হবে না। আইনতই সম্ভব হবে না। আমাদের দিয়ে সেটা করিয়ে নিতে পারেন। যেমন সংবিধান সংশোধন। পারবেন না। এটা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিতে পারবেন। আপনাদের কাজটাই আমরা করে দেব। আমরা একটা খসড়া বানিয়ে দিচ্ছি আপনাদের। কাজের সুবিধার জন্য। এটা ছিঁড়ে ফেলে দিন। আরেকটা বানিয়ে নিন। আমাদের আরেকটা দিন। আপনাদের নিয়ে করি।
প্রথম আলো:এই সংস্কারের কাজে আপনার এক–দুই–তিন লক্ষ্য কী?
ড. ইউনূস: প্রথম হলো সংবিধান, মস্ত বড় বিষয়। সংবিধান সংশোধন করতে হবে। জুডিশিয়ারি সংশোধন করতে হবে। ছয়টা যে কমিশন করলাম, এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আরও কমিশন নিয়ে আসছি। কয়েক দিনের মধ্যে এগুলো পেয়ে যাবেন। সেগুলো আসলে দেখবেন যে অনেকগুলো বিষয় আমরা দিচ্ছি। মনের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে। লেখালেখি আপনারা অনেক করেছেন। শুধু একটা কাগজ সামনে রেখে সবাইকে একমত করে বলেন, কত দূর যেতে চান। আপনারা যেভাবে ঠিক করে দেবেন, সেভাবেই হবে। আমাদের কাজ শুধু ফেসিলিটেট করা। এ সুযোগটা এখন আছে আমাদের কাছে। আপনারাই এটা সৃষ্টি করেছেন। আমরা সৃষ্টি করিনি।
প্রথম আলো:এখন চারপাশে যা দেখেন, এতে কি আপনি আশাবাদী? রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে নিয়ে কমিশনের উদ্যোগে আপনারা কত দূর পর্যন্ত করে যেতে পারবেন?
ড. ইউনূস: আমি এক শ ভাগ আশাবাদী। কারণ, সবাই সংস্কার চায়। মুখে যে যা–ই বলুক না কেন, ভেতরে সবাই সংস্কার চায়। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আপনি পার পেয়ে যাবেন, আপনার ছেলেমেয়ে আটকে যাবে। এই গর্তের মধ্যে আবার পড়তে হবে। যেই গর্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা বের হয়ে এলাম, সেই ধ্বংসস্তূপ আবার সৃষ্টি হবে। কাজেই সংশোধনের দায়িত্ব আপনাদের, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করে যাচ্ছি।
prothom alo