গ্রামাঞ্চলে মুরব্বিরা বলতেন, যিনি তালগাছ লাগান, তিনি ফল খেয়ে যেতে পারেন না। তারপরও আশি বছরের বহু বৃদ্ধকে বহু তালের আঁটি রুয়ে যেতে দেখেছি। আর তাঁর সেই পরার্থপরতাকে নির্বোধ বৃদ্ধের চূড়ান্ত বোকামি মনে করে স্বার্থপর লোকদের হাসাহাসি করতেও দেখেছি।
ইহজাগতিক সান্ত্বনার কথা, কেউ যদি কম বয়সেই তালগাছের মতো ‘জীবনের গাছ’ লাগাতে সমর্থ হন, তাঁর ভাগ্যে ফল খাওয়া সম্ভব হতেও পারে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তরুণ সংখ্যাগরিষ্ঠের এ দেশে সে রকম ব্যতিক্রমী একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সহস্রজনের চেষ্টা ও নেতৃত্বে, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী এবং কোটি জনতার অংশগ্রহণে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লব সফল হয়, কেবল প্রাথমিকভাবে। এ বিপ্লবকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং জনগণের রাষ্ট্র (রিপাবলিক) প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে, অনেকেই সুফল পেতে পারে যৌবনেই, নিদেনপক্ষে জীবদ্দশায়।
প্রাপ্তি যা-ই হোক, যেকোনো পেশাজীবী ও বয়োজ্যেষ্ঠর চেয়ে ছাত্র-যুবকেরা নির্ভয়ে আন্দোলন–সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের না থাকে পিছুটান, তাঁরা না গ্রাহ্য করেন ব্যক্তিস্বার্থ। আর তারুণ্যের দুর্নিবার আবেগ তো থাকেই।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা উপড়ে ফেলার রক্তাক্ত দিনগুলোয় কিশোর-তরুণেরা তাঁদের মা-বাবাকে পর্যন্ত যুক্তি দিয়ে বাধ্য করেছেন মিছিলে যোগ দিতে।
অবশেষে এক নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি তৈরি করেছে হাজারো শহীদের রক্ত।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সময়ের নায়কেরা নিজেরা পারলে উত্তম, না হলে তাঁদের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনার কাজটি সফল করতে প্রয়োজন হয় সেই প্রৌঢ়, বিদগ্ধজনদের, যাঁরা গাছ লাগাতে চান পরার্থপরতার মন্ত্রে।
সে জন্যই ২-৩ জন তরুণ সমন্বয়কারী বাদ দিলে বাকি সব ‘মুরব্বিদের’ আমন্ত্রণ জানানো হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ রচনা করার ভারসাম্যপূর্ণ, দূরদর্শী কর্মযজ্ঞে।
বিশ্বাসটি এ রকম যে মহৎ উদ্দেশ্যে কার্য সম্পাদন করলে এবং দেশ ভালো হলে, ভালোভাবে চললে, সব প্রজন্মই ভালো থাকবে।
আদর্শপ্রবণ বয়সে থাকা নিষ্পাপ (ইনোসেন্ট) মানুষেরা সেটা একটু বেশিই বিশ্বাস করেন এবং অতি সরল লোকেরা বুঝতে পারেন না যে জীবনসংসারটা ‘অনুরোধের গানের আসর চাওয়া-পাওয়া’ নয়।
নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২-১৯৭৫-এ তারুণ্যের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছিল ভয়াবহভাবে। সে সময় যুবকেরা উদ্ভ্রান্ত বনে যান। রাষ্ট্রীয় এবং অ-রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন। জেল, জুলুম, হত্যার রাজনীতির বলি হন। একটি প্রজন্ম সর্বনাশা পরিণতি বরণ করে।
তাই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গণমানুষের আশু কল্যাণ ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রয়োজন হয় যোগ্য, সৎ এবং নিঃস্বার্থ ‘মুরব্বি’, যাঁদের বলতে পারেন ‘উপদেষ্টা’ বা ব্যবস্থাপক। প্রয়োজন হয় তাঁদের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন এবং ‘গায়ে গতরের খাটুনি’।
তারুণ্যের স্লোগান এবং তরুণদের আদর্শিক চাওয়ার সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সংমিশ্রণ হলে মানুষের সুন্দর চাওয়াগুলোর পরিণতি পাওয়ারই কথা।
এ কাজটি সুচারুরূপে করতে ব্যর্থ হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আজকের প্রতিশ্রুতিশীল যুব সম্প্রদায়; যেমন সঠিক কর্ম না করতে পারায় অথবা হঠকারী জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পাল্লায় পড়ে বাংলাদেশেই অনেক উঠতি নেতা হারিয়ে গেছেন।
যেহেতু হতাশ যুবকদের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বলার মতো মুরব্বি আপাতত দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু তাঁদের নিজেকেই বলতে হবে, ‘হুঁশিয়ার’!
তবু আমরা আশাবাদী। এই আশাবাদের কারণ, শুধু পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি বাদে অপরাপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী গোষ্ঠী আজ একমত, আগামীর বাংলাদেশ হবে সব নাগরিকের জন্য কল্যাণকর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
সেই দেশ বর্তমান জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এবং আমাদের বংশধরদের উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে নির্মিত হওয়া চাই।
যেহেতু দুঃশাসনের সংস্কৃতিতে দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ উপেক্ষিত ছিল দীর্ঘকাল, তাই ‘প্রজন্মের শূন্যতা’ (জেনারেশন গ্যাপ) তৈরি হয়েছে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতৃত্বে।
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার এই উপেক্ষার বিরুদ্ধে এক সাধারণ প্রতিবাদ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা বিরাজনীতিকীকরণের ধারক শাসকেরা ভয় দেখিয়ে ও বলপ্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিন্তু চূড়ান্ত গণবিপ্লবের মুখে পালানোর পথ দেখে।
উদ্বেগের বিষয়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে উজ্জ্বল ও মেধাবী প্রজন্মের উত্থান হয়, তাঁরাও পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের যথেষ্ট সুযোগ পায়নি; বরং রুটিরুজির যুদ্ধেই কাহিল হয়ে যায়।
তাহলে এই জেনারেশন গ্যাপ দূর করার এবং বর্তমান তরুণদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে নেতৃত্ব, ক্ষমতা, মেধা-মনন ও সম্ভাবনা যাচাইয়ের সংক্ষিপ্ত উপায় কী? নাগরিকদের অনুন্নয়নের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার বুদ্ধি?
এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক হলে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’-এর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে এবং তা সরকারি তরফ থেকে হলেই সর্বোত্তম।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজের নানা জায়গা থেকে আসা হাজারখানেক কিশোর ও তরুণকে ২৫-৩০ ক্যাটাগরিতে প্রতিবছর মেধা বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলে সমাজের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ পেতে পারি আমরা।
তরুণদের একটি বড় অংশকে সরকারি কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয় করানোও সম্ভব। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ২০-২৫ হাজার ছেলে–মেয়েকে নিয়মিত ভিত্তিতে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে নানাভাবে উপকৃত হবে দেশ।
খানা, কৃষি, ব্যবসা ও শিল্প এবং ট্যাক্সসংক্রান্ত জরিপের কাজে ছাত্রদের স্বল্প মেয়াদে কাজে লাগালে তারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবে।
সরকার উদ্যোক্তা তৈরির একটি বিশেষ তহবিল গঠন করতে পারে এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়নে বাস্তবসম্মত মহাপরিকল্পনা নিয়ে কোটি মানুষকে সংযুক্ত করতে পারে।
তরুণেরা নিজেরা দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা ও অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি দিয়ে ডেটা ব্যাংক তৈরি এবং ঘুষ, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মিছিল করতে পারেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিবেশ রক্ষার মতো বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে জাতিকে পথ দেখাতে পারেন তাঁরা। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা আবাদি জমি ও জলাভূমিকে প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত এবং সব উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
সাম্প্রতিক আন্দোলনে সমন্বয়কারী ছাত্ররা তাঁদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটি খুব সাধারণ কাজ করে ভবিষ্যতের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেন।
সারা দেশে ৬ কোটি দেশীয় ফলের গাছ, ১০ লাখ করে নিম ও তালগাছ, সামাজিক বনায়নে বৈচিত্র্যময় ও বিরল প্রজাতির এক কোটি কাছ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ২ কোটি নারকেলগাছ রোপণের দাবি তুলতে এবং প্রকল্প নিলে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারেন তাঁরা।
ব্যক্তি তরুণের জন্য জরুরি হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা। কিন্তু এ প্রক্রিয়ার কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা (শর্টকাট ওয়ে) এই লেখকের জানা নেই।
আগের দুই প্রজন্ম এক্স এবং মিলেনিয়ালের অনেকটাই নেতৃত্ববঞ্চিত হওয়ার কারণ দর্শাতে পারবে; আগামী পৃথিবীর চ্যালেঞ্জের মুখে জেন-জি কী কৈফিয়ত বা সমাধান হাজির করবে, তা ভাবতে পারলে প্রস্তুতির সময় পাবে তারা।
প্রথম আলো