বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পাচারে অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপ ও এর মালিকদের সম্পদের তথ্য চেয়েছে সিঙ্গাপুরের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে এস আলমের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেশে-বিদেশে সম্পদের তথ্য জানতে চেয়েছে ওই ইউনিট। এস আলম গ্রুপের পাচারের টাকায় সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে সম্পদ কেনার ওপর গণমাধ্যমগুলোর অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে এ তথ্য চেয়েছে সিঙ্গাপুর। এদিকে, এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে করা রিটের আদেশ হবে আগামী রোববার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এক দশক ধরে সিঙ্গাপুরে সাইফুল আলম হোটেল, বাড়ি, বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন। যদিও গত সরকার এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত সরকারের আমলে এস আলমের অর্থ পাচারের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত না করতে উচ্চ আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়।
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে মাসুদ, তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তিন ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। একই দিন তাদের বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়। মূলত তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হলে আইনি ঝামেলা এড়াতেই তিনি গত সরকারের সহায়তায় এ ব্যবস্থা করে থাকতে পারেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে এস আলম, তাঁর স্ত্রী, সন্তান, ভাইসহ পরিবারের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করেছে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুর এফআইইউ এস আলমের তথ্য চেয়ে থাকতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে সিঙ্গাপুরে সম্পদ গড়ার একাধিক রিপোর্ট হয়েছে। এখন অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা না নিলে দেশটি বৈশ্বিকভাবে মানি লন্ডারিং নীতিমালা পরিপালন না করায় অভিযুক্ত হবে। তিনি বলেন, এস আলমের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করছেন। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বৈধ উপায়ে তাঁর কোনো অর্থ বিদেশে পাঠানোর অনুমোদন না থাকার বিষয়টি জানানো হবে। এ ছাড়া অন্যান্য তথ্য দেওয়া হবে। বৈশ্বিক নীতিমালার আলোকে এক দেশ আরেক দেশকে এ ধরনের তথ্য দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিদ্যমান আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। কেউ তা করে থাকলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। এখন পর্যন্ত দেশের ২২টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়েছে। এ তালিকায় এস আলম গ্রুপ এবং তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আর এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ের কাউকে দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফলে বিদেশে তাঁর বিনিয়োগ বেআইনি।
বিগত সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে এস আলম গ্রুপ সরাসরি সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এসব ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে অন্তত দুই লাখ কোটি টাকার ঋণ বড় অংশই পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে দখল নেওয়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি এবং এসআইবিএলের ১৫ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণের বড় অংশই এস আলম গ্রুপের। আর চলতি বছর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে সামান্য কিছু ঋণ তারা বের করে নেয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ঋণ রয়েছে ৯ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব ব্যাংক থেকে যেন নতুন করে আর ঋণ বের করতে না পারে, সে জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো কোথায় কত টাকা ঋণ দিয়েছে, বন্ধকি সম্পত্তির পরিমাণসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ ছাড়াও এস আলমের বিরুদ্ধে সব শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ ছাড়া কর ফাঁকির তথ্য সংগ্রহ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আর্থিক, সামাজিক ও আইনি সহায়তা দিতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়।
সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞার আদেশ রোববার
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আদেশ আগামী রোববার। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লা ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চে রিটের ওপর শুনানি হয়। আদালত আদেশের জন্য রোববার দিন ধার্য করেছেন বলে জানান রিট আবেদনকারী আইনজীবী মো. রুকুনুজ্জামান। দায়ের করা রিটে এস আলম গ্রুপ এবং প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সব স্থাবর সম্পত্তির তালিকা দাখিল করার নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।
এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপের শেয়ারহোল্ডার, পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে মামলা (পিআইএল) করেছিলেন আইনজীবী রুকুনুজ্জামান। রিট আবেদনে এস আলম গ্রুপের আওতাধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এস আলম গ্রুপের শেয়ারহোল্ডার, পরিচালক ও অন্যান্য ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ, চলতি অবস্থা ও দায়-দেনার বিষয়ে তথ্য চাইতে আদালতকে অনুরোধ জানানো হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এস আলমের সঙ্গে আঁতাতকারীদের বাধ্যতামূলক অবসর চেয়ে স্মারকলিপি
বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এস আলম গ্রুপসহ লুটেরাদের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া বাকি দুই ডেপুটি গভর্নরের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গভর্নর বরারবর এ স্মারকলিপি দিয়েছেন। ডেপুটি গভর্নর-৩-এর মাধ্যমে স্মারকলিপি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। গত ৭ আগস্ট তাদের আন্দোলন হয়েছিল তৎকালীন গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউর প্রধান ও নীতি-উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে। গভর্নর, দুই ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউর প্রধান ও নীতি-উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেও বাকি দু’জন এখনও বহাল আছেন। মূলত ওই সময়ের নির্বাহী পরিচালক-১ ও বর্তমান ডেপুটি গভর্নর-৩-এর মৌখিক আশ্বাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্য দু’জন ডেপুটি গভর্নর বহাল ছিলেন। এখন গভর্নর ও দুই ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের ফলে অন্যদেরও পদত্যাগ বা প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য সাধারণ কর্মকর্তারা দায়ী থাকবে না।
দাবির মধ্যে আরও আছে– অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা, আগামীতে ডেপুটি গভর্নর পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরিবর্তে পনোন্নতির মাধ্যমে পূরণ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে গভর্নর নিয়োগ দিয়ে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনগত, আর্থিক পরিচালনগত ও ব্যবস্থাপনা স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা।
samakal