পৃথিবীতে যত রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, তার একটা সহজ-সরল নাম হচ্ছে বিপ্লব। একসময় কমিউনিস্টরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিপ্লব শব্দটি বলতেন। এখন বিপ্লবের কথা তাঁরা আর বলেন না। সময়ে-সময়ে যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি হয় সহিংস। পালাবদলের সব সময় দুটি পক্ষ থাকে। একটি বিজয়ী, অপরটি পরাজিত। জয়ী পক্ষ বলে বিপ্লব। পরাজিত পক্ষ বলে ষড়যন্ত্র।
১৯৭৫ সালে দেশে চেপে বসেছিল একদলীয় (বাকশাল) শাসনব্যবস্থা। সরকার পরিবর্তনের কোনো ব্যবস্থা সংবিধানে রাখা ছিল না। সংবিধানে ছিল—কোনো ধরনের পরিবর্তন হলে, সেটি হবে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী। ১৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হলো হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হলেন।
শেখ মুজিবের সরকার এমন এক সময়ে উৎখাত হয়েছিল, যখন তাঁর জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে এসেছিল। একসময় শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। আর সেখানে তিনি পৌঁছেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই। ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল; কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন হলো, যেটা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো পাঁচ দশক পরে—২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। মোসাহেব ও মৌ-লোভীদের দ্বারা ঘেরা শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন দিন এভাবেই যাবে; কিন্তু মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কী ঘটিয়ে দিতে পারে, সেটা সম্ভবত ২৪ ঘণ্টা আগেও তিনি বুঝতে পারেননি।
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এটিকে বলেছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আমার একটি সরল বিশ্লেষণ হলো—পঁচাত্তরের অভ্যুত্থানটি ঘটিয়েছিল সরকারি দলের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ। তাদের সহযাত্রী হয়েছিল সেনাবাহিনীর একটি অংশ।
একাত্তরে শেখ মুজিব ছিলেন জনগণের নেতা। পঁচাত্তরে তিনি ছিলেন শাসক। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে মানুষের আন্দোলন ও আকাঙ্ক্ষাকে দমাতে চেয়েছিল। তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। পঁচাত্তরে ছিল শেখ মুজিবের শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলেও সমর্থন ছিল। শাসক দলের বাইরে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল পঁচাত্তরের অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিয়েছিল।
এরপর ১৯৯০ সালে আমাদের এখানে আরেকটি রাজনৈতিক পালাবদল হলো। সবার মধ্যে একটা আবেগ ও উচ্ছ্বাস তৈরি হলো—আমরা উর্দিধারী বা উর্দিবিহীন সামরিক শাসনের পর্যায় পেরিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে অভিযাত্রা শুরু করলাম; কিন্তু সেই ভুল ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনের আবরণে স্বৈরশাসন দেখেছি।
সত্তরের দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে যে এক ব্যক্তির শাসন আমরা দেখে আসছিলাম, ১৯৯১ সালের তথাকথিত গণতান্ত্রিক উত্তরণের মধ্য দিয়েও তার পরিবর্তন হয়নি। আমরা সেই ব্যক্তির শাসনই দেখেছি।
পর্যায়ক্রমে খালেদা, হাসিনা, খালেদার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শাসনের যূপকাষ্ঠে পুরো দেশ বলি হয়েছে। এরপর এক–এগারো অনেক কিছু তছনছ করে দিল। কিন্তু এক–এগারো থেকে রাজনীতিবিদেরা কোনো শিক্ষা নেননি।
এক–এগারো পরবর্তী বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত একটানা শাসনক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার সরকার। এই সময়ে তিনটি প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে অথবা একতরফা নির্বাচন হয়েছে। তাঁর দল কয়টি আসন পাবে, বিরোধী দল কয়টি আসন পাবে—সবই ঠিক করে দিতেন শেখ হাসিনা। এমন অবস্থা কোথাও আমরা দেখিনি, শুনিনি।
এক ব্যক্তি, তাঁর আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি, মোসাহেব ও লাঠিয়াল—তাদের দিয়েই শাসনকাজ পরিচালিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছিল; কিন্তু তা প্রকাশের ভাষা পাচ্ছিল না।
আমাদের দেশের যারা সনাতনী ধারার বিরোধী দল, তারা সেভাবে কিছু করতে পারেনি। তারা অনেক মিছিল-সমাবেশ করেছে, আক্রান্ত হয়েছে এবং পিটটান দিয়েছে। কোটা সংস্কারের নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন বোঝা যায়নি এই আন্দোলন এ রকম তীব্র আকার ধারণ করবে।
সরকার এ আন্দোলন দমন করার জন্য যে কৌশলটা নিয়েছিল, সেটি একেবারেই নির্বোধ শাসকদের কৌশল। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকাটা অনেকটাই নির্ভর করত পুলিশ বাহিনীর ওপরে। কিন্তু সেই রক্ষাব্যূহটা একপর্যায়ে ভেঙে পড়ল। কারণ, তরুণেরা এগিয়ে আসছিল, গুলির সামনে বুক পেতে দিচ্ছিল। তখন শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী ডাকলেন। সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিল, তারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না। তাতে করে শেখ হাসিনার স্বপ্নের সৌধ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল।
জনগণের যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে হলো, সেটি শেখ হাসিনা, আওয়ামী সরকার ও তার মোসাহেবদের ছাপিয়ে ধাবিত হলো শেখ মুজিবের ওপরে। শেখ মুজিব এ দেশের মানুষকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের তাঁর বাড়িটি, যেটি একটি জাদুঘর হয়েছিল, সেটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হলো।
গত ১৫ বছর আমরা দেখেছি, ১৫ আগস্ট এলেই ভোর থেকে ধানমন্ডি ৩২-এর রাস্তা আটকে দেওয়া হতো। কারণ, প্রধানমন্ত্রী আসবেন, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে তিনি ফুল দেবেন। তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেখানটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো। সব সরকারি কর্মচারীকে সেখানে ব্যানার নিয়ে আসতে বাধ্য করা হতো। নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক ভাড়া করে নিয়ে আসতেন টাকার বিনিময়ে। শোক প্রকাশে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। এবারের ১৫ আগস্টে দেখলাম, সেই একই ধরনের লোকেরা লাঠিসোঁটা, বাঁশ, চেলাকাঠ নিয়ে রাস্তা দখল করে লোকজনকে মারধর করছে।
শেখ হাসিনার প্রতি যে ক্ষোভ, রাগ, অসন্তোষ এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য তাঁর যে নানা কলাকৌশল, তার খেসারত দিতে হলো মৃত শেখ মুজিবকে। শেখ হাসিনা তো পালিয়ে বাঁচলেন; কিন্তু ধ্বংস করলেন তাঁর পিতা শেখ মুজিবকে।
এ দেশে প্রতিবাদের ভাষা হলো গাড়ি ভাঙা, প্রতিপক্ষের বাড়িতে আগুন দেওয়া, প্রতিপক্ষকে পেটানো; কিন্তু ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি একই কাতারে ফেলা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন আজ হোক, কাল হোক উঠবে। বাড়িটিতে একাত্তরে ছিল গণমানুষের মিছিলের স্রোত, পঁচাত্তরে ঘটেছিল রক্তাক্ত অভ্যুত্থান, পরে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো।
‘ফ্যাসিবাদের প্রতিভূ’ এই স্লোগান দিয়ে হামলার পক্ষে দাঁড়িয়ে একধরনের স্যাডিস্ট আনন্দ পাবেন অনেকে; কিন্তু এর ফলে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের গায়ে একটু হলেও কালো দাগ পড়বে—এ কথা বলে এ মুহূর্তে অনেকেই মেঠো জনপ্রিয়তা হারাতে চাইবেন না।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, কন্যা হাসিনার ক্ষমতার খায়েশ পূরণ করতে নির্বিচার যাঁদের হত্যা করা হলো, তাঁদের লাশের গন্ধ শুকানোর আগে পাঁচ দশক আগের তাঁর একনায়ক বাবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোক প্রকাশ কতটুকু যৌক্তিক। এটা একটা নতুন ডিসকোর্স। শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অনেক ত্রুটি ছিল। তাঁর দুর্বিনীত আচরণ ও প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন অগুনতি মানুষ। অপরাজনীতির এই ধারার অবসান হওয়া দরকার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অনেক ঘৃণা ছড়িয়েছিল। জিয়া যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেটি অস্বীকার করা হয়েছিল। তাতে অনেকে মনে আঘাত পেয়েছিলেন। ফলে তার পাল্টা আঘাত তো আসবেই। সেটি এসেছে ৩২ নম্বরের বাড়ির ওপরে। ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে সুস্থ কিছু হয় না।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
প্রথম আলো