আহমদ শিহাব
১৫ ই অগাস্ট। একটি ঐতিহাসিক দিন। অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পঁচাত্তরের এই দিন একটি সেনা অভ্যুথানে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক শেখ মুজিবুর রহমানের পতন হয়। দুঃখজনক যদিও, সেদিনের সেনা কার্যক্রমে তাঁর মৃতু ঘটে। কিন্তু সেই মৃত্যুতে কারও চোখে সেদিন পানি দেখা যায় নি, ছিল না কোন পরিতাপ। শোনা যায়নি ইন্নালিল্লাহ। স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চায়নি তার অন্তোষ্টিক্রিয়ায়। দেখা গেছে শুধু আনন্দ উৎসবের মিসিল আর মিসিল। যেমনটি লোক দেখেছিল গত ৫ ই অগাস্ট, মুজিব কন্যা, মুজিব অনুসারী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনে। (হাসিনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে, যারা দিয়েছিল তার দু’দশক শাসনামলে প্রভুত্ব)।
শেখ হাসিনা দিনটিকে (১৫ ই অগাস্ট) “শোক দিবস ” ঘোষণা করে এবং তার সরকার সে হিসাবে পালন করে আসছিল। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বাতিল করে দেয়।
মুজিবের পতন কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছিলনা, দেশের জনগণ প্রতিটি মুহূর্তে তা কামনা করেছিল। কিন্তু পরিবর্তনের কোন সাংবিধানিক পথ খোলা রাখেনি মুজিব। শোষিত জনগণ শুধু আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া চাইতো মুজিবের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে রেহাই, একটি শাসরুদ্ধকারী পরিস্তিতে থেকে মুক্তি। আল্লাহ জনগণের সেই আর্জি কবুল করেছেন ১৫ই অগাস্ট ১৯৭৫। একগুচ্ছ সেনা অফিসার ও শ’পাঁচেক সৈনিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সমাধা করে। ঘটনাক্রমে মুজিব সহ ডজন দুয়েক লোক মারা পড়ে। একজন বিদেশী জজ মন্তব্য করেছিলেন, এমন একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তরী ঘটনায় ২২ জন লোকের মৃর্তু বেশি কিছু নয়, যেখানে বিভিন্ন অঘটনে প্রতিনিয়ত লোক মারা যায়।
দেশে বাঁচানো
মুজিব আমলে যারা বাংলাদেশে ছিলেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে মুজিব কেমন জঘন্য সৈরশাসক ছিলেন। সারাজীবন গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করে ক্ষমতা হাতে পেয়েই ওসব মুল্যবোধ বিসর্জন দিলেন এককচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াসে, কোন বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং তার ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে লিখেছিলেন, মুজিব কোন পরামর্শ নিতেন না, শত্রু রাখতেন না। জনগণ থেকে বিশ্রুত, বিমুখ। যারা সামনে তাকে বঙ্গবন্ধু বলতো, পেছনে গিয়ে বঙ্গশত্রু বলে গালাগালি করতো।
মুজিবের ৪৪ মাসের শাসনামলের বৃত্তান্ত, তথা গুম খুন, জেল জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, ব্যাভিচার লিখতে গেলে পাহাড়সম স্তূপ হবে। প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও “ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড বিজেতা” জাগলুল হুসাইনের মুজিবকে নিয়ে লেখার কিছুটা নিচে তুলে ধরলাম।
“মুজিব সরকার ৩০ হাজার দেশপ্রেমিক হত্যা করে। তাদের অপশাসনে দেশে নেমে আসে নির্বিচার হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুণ্ঠন, দখলবাজী, সীমান্ত পাচার ইত্যাদির বিভীষিকা। তাদের অপশাসন, লুণ্ঠন, কালোবাজারী, সীমান্তপাচারের ফলে দেশে যে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ঘটে তাতে সরাসরি মৃত্যু হয় ৫ লক্ষ মানুষের এবং পরোক্ষ ভাবে মৃত্যু হয় আরও ১০ লক্ষ মানুষের। অন্যদিকে, মুজিব নিজে ভারতপন্থী না হলেও, মুজিব সরকার পরিচালিত হয় মূলতঃ ভারতের নির্দেশে, যারা বাকশালতন্ত্র নামক চরম স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করে। মুজিব নিজে ২৫ মার্চ ১৯৭১ নিজের ও নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, ১৯৭১-এ পরিবারের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন।”
১৫ই আগস্টে বিপ্লবের পর অতি শীগ্র দেশে শান্তি আসে, স্থিতিশীলতা আসে, গণতন্ত্র পুন প্রতিষ্ঠা হয়, দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়, বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করে।
সূর্য সন্তান
অথচ, যারা এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছে, সেদিনের সূর্য সন্তানেরা, রয়ে গেল অবহেলিত, বঞ্চিত। ডজন খানেক অফিসারদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত করে বিদেশের ছোট খাট, নিন্ম গুরুত্ব মিশনে নিয়োগ দেয়া হয়। অধিকাংশরাই ছিল পাওনা পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত।
১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রধান মন্ত্রী হয়ে, প্রথম কাজটি করেন তার পিতৃহত্যার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের কার্যক্রম। দেশে বিদেশে যেখানে যাকেই পাওয়া গেছে ধরে আনা হল। লোক দেখানোর জন্য পাতানো ছিল রাজনৈতিক ও একতরফা দলীয় বিচারের প্রহসন। সঠিক সুযোগ ছিলনা কোন আত্মপক্ষ সমর্থন। যেখানে ধরে আনা, বন্দি করে নির্যাতন করা,,অনুসন্ধান করা, প্রসিকিউশন, বিচার ও এক্সেকিউশন একই ব্যাক্তির হাতে, ফল তাই হল। হাতে পাওয়া আধা ডজন সূর্য সন্তানদের ফাঁসিতে ঝুলানো হল। বাকিদের হন্নে হয়ে খুঁজতে থাকে।
শেখ হাসিনার পতনের পর, আশা করা যায় দেশে পুনরায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, যাদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিশ্চিত ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল, দেশ সত্যিকার অর্থে মুক্তি পেয়েছিল, তাদের সঠিক মূল্যায়ন হবে। ১৫ ই আগস্টের অবদান ইতিহাসে যথাযথ মর্যাদার স্থান পাবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।