কোটা সংস্কার ও সরকারের পদত্যাগ দাবির আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সারা দেশের বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলির হিসাব এখনো মেলাতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধারণা, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানা থেকে ৫ শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫০ হাজার গুলি লুট হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, লুণ্ঠিত অস্ত্র-গুলির হিসাব দু-এক দিনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে সেগুলো উদ্ধারে অভিযানে নামবে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে গেলে তা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। যেহেতু পুলিশের পক্ষে এখন স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো প্রায় অসম্ভব, সেহেতু অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে।
পুলিশের বেহাত হওয়া সব আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগামী সোমবারের (১৯ আগস্ট) মধ্যে অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর কারও কাছে লুটের অস্ত্র-গুলি পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র আগামী সাত দিনের মধ্যে থানায় জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপি গত রোববার রাতে লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র অথবা গুলি কারও কাছে থাকলে তা দ্রুত নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার আহ্বান জানায়।
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের হাতে গোনা কয়েকটি বাদে সব থানায় হামলা করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। অগ্নিসংযোগ করা হয় থানায়। পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র-গুলিসহ বিভিন্ন জিনিস লুট হয়। পরে ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান পুলিশ সদস্যরা। ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বিকেলে আজকের পত্রিকাকে বলেন, সারা দেশে লুট হওয়া অস্ত্রের হিসাব করছে পুলিশ সদর দপ্তর। এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তর মনে করছে, অন্তত ৫০০ অস্ত্র ও ৫০ হাজার গুলি লুট হয়েছে।
লুণ্ঠিত কিছু অস্ত্র ও গুলি থানায় ফেরত আসতে শুরু করেছে। কুমিল্লার বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া ২৮টি অস্ত্র ও ৬৬৭টি গুলি গতকাল উদ্ধার করেছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদস্যরা। আনসার-ভিডিপি কুমিল্লার কমান্ড্যান্ট রাশেদুজ্জামান বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ড্রেন, বন-জঙ্গলে খুঁজে পরিত্যক্ত অবস্থায় এসব অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়।
ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে থানায় পুলিশ
নিজেদের নিরাপত্তা, হামলাকারীদের বিচারসহ ১১ দফা দাবিতে পাঁচ দিন কর্মবিরতির পর থানা ও সড়কে দায়িত্ব পালনে ফিরেছেন পুলিশ সদস্যরা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া থানাগুলো এখন সীমিত সেবা দিতে পারছে। পুলিশ সদস্যরা বলছেন, স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হতে আরও বেশ কিছুদিন লাগবে।
দুপুরে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের সামনে ছয়জন সেনাসদস্যের পাহারা। থানা প্রাঙ্গণে ঢুকতেই চোখে পড়ে পুলিশের পুড়ে যাওয়া ৪টি পিকআপ ও ৯টি মোটরসাইকেল। থানা ভবনের মেঝেতে কালো ছাই আর পোড়া কাগজের অবশিষ্টাংশ। নিচতলায় ওসির কক্ষে একজন ডিউটি অফিসার সাধারণ পোশাকে একটি টেবিল পেতে বসে আছেন। টেবিলের সামনে দাঁড়ানো চার যুবক। কক্ষের টেবিল-চেয়ার, হাজিরা খাতা, রেজিস্টার খাতা—সবই নতুন। যুবকেরা একটি মোটরসাইকেল-সংক্রান্ত বিষয় জানাচ্ছিলেন তাঁকে। এরপর ডিউটি অফিসার এক নারীর মোবাইল হারানোর বিষয়ে জিডির পরামর্শ দেন।
ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) মধুসূদন মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কেবল জরুরি বিষয়ের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিচ্ছি। সকাল থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। দুপুর পর্যন্ত ১৩টি জিডি হয়েছে।’
ডিএমপির রমনা বিভাগের সব থানায়ও কাজ শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এই বিভাগের নিউমার্কেট, রমনা ও শাহবাগ থানায় হামলা হয়েছিল। তবে থানাগুলো ব্যবহার উপযোগী রয়েছে।
কলাবাগান থানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর পাহারায় দোতলায় ডিউটি অফিসার এসআই আব্দুল্লাহ আল সাদিক সেবাপ্রার্থীদের সেবা দিচ্ছেন। এক তরুণী জিমেইলে তাঁকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জিডি করতে এসেছেন, তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। পরে আব্দুল্লাহ আল সাদিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন কেবল জিডি নেওয়া হচ্ছে। তবে টহল কার্যক্রম শুরু করতে আরও সময় লাগবে। গাড়ি ও ওয়্যারলেস সেট চালু হলে টহল শুরু হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারা দেশের মোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৬২৮টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১১টি থানা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস, আসবাবসহ অন্যান্য সব সরঞ্জাম ধ্বংস হওয়ায় এগুলোর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা গতকাল সড়কে ফিরেছেন। তাঁদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও ছিলেন সড়কের শৃঙ্খলায়। ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা কাজ করছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করে তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন।
Ajker Patrika