চীন-ভারত সম্ভাব্য সংঘাত হলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে?

এম সাখাওয়াত হোসেন

ভারতের প্রথম এবং পরবর্তীতে টানা তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববরেণ্য নেতা পণ্ডিত নেহেরু প্রথম ৩ বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্ব দু’বলয়ে বিভক্ত হয়েছিল। পণ্ডিত নেহেরু উভয় বলয় থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে যুক্ত ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পুরোধায়- কিন্তু তেমনটা থাকতে পারেননি। তিনি তার তৃতীয় মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। জোটনিরপেক্ষ হয়েই পণ্ডিত নেহেরু তিব্বতকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সিআইএ (CIA)-এর তৎপরতার কারণে নিরপেক্ষ
থাকতে পারেননি। তিব্বতের কথিত শাসক এবং ধর্মীয় গুরু (টনভিন গিয়াস্তো) যিনি দালাইলামা নামে বিশ্ব পরিচিত, যখন মার্চ ১৭, ১৯৫৯তে তৎকালীন নেফা (NEFA) বর্তমানের অরুণাচল প্রদেশ এবং পরবর্তীতে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন সেদিন থেকেই ‘অতি বন্ধুপ্রতিম’ প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে উষ্ণতা এবং সৌহার্দ্যতে ভাটা পড়তে শুরু হয়।

একদার ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ বৃটিশ রাজের নির্ধারিত পশ্চিমে জনসন লাইন এবং পূর্বে ম্যাকমোহান লাইন বলে পরিচিত সীমান্তের ঐতিহাসিক অধিকার নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। টানাপড়েন সীমান্তে টান টান উত্তেজনা  থেকে সামরিক সংঘাতের পথে ধাবিত হয়। দু’দেশের এই উত্তেজনা প্রশমনে ১৯৬০ সালে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মি. নেহেরুর অতীব নিকটের তৃতীয় বিশ্বের নেতা চৌ এন লাই (Zhou En lai) দিল্লি সফরে তিব্বত বিষয় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দু’দেশের সীমান্ত সংক্রান্ত বিভেদের, বিশেষ করে পশ্চিম সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি প্রশমনে এবং সম্পূর্ণ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সীমান্ত, পূর্ব সীমান্ত সহ একটি গ্রহণযোগ্য (?) ও সমাধানযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়কার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষজ্ঞদের অতি চাহিদার কারণে প্রস্তাবটি পণ্ডিত নেহেরু নাকচ করে দেন। তার পরবর্র্তীতে ভারতের কিছু উচ্চাভিলাষী পরামর্শকদের কারণে দু’দেশের মধ্যে প্রায় ১ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়।

পশ্চিমে লাদাখ-এর আকসাই চীন (Aksai Chin) এবং পূর্বে ম্যাকমোহান লাইন পার হয়ে তৎকালীন নেফা (NEFA) বর্তমান অরুণাচল-এ (২০শে অক্টোবর-২১শে নভেম্বর ১৯৬২) প্রায় একমাস যুদ্ধে চীন পশ্চিম রণাঙ্গনে আকসাই চীন-এর ৩৮০০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি দখলে নেয় আর পূর্ব সীমান্তে আসামের তেজপুর পর্যন্ত দখল করে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।

ওই যুুদ্ধে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চীন থেকে অনেকগুণ বেশি ছিল। আকসাই চীন আজ পর্যন্ত চীনের দখলে রয়েছে। সীমান্ত রেখা টানা রয়েছে লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল (LAC)-এর মাধ্যমে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে ভারতের ব্যাপক পরাজয় শুধু পণ্ডিত নেহেরুর জন্যই নয় ভারতের জন্য আজ অবধি মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে রয়েছে। ওই যুদ্ধের ফলাফল এবং মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের ছাপ বর্তমানে ভারতের বিদেশ ও সামরিক নীতিতে প্রতিফলিত। এমন কি বর্তমানে ভারতের ভূরাজনীতি এবং বিদেশনীতি আবর্তিত হচ্ছে ১৯৬২ সালের গ্লানির প্রেক্ষিতে। বিষয়টি যে ভারতের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে তা ভারতীয় কূটনীতিবিদ থেকে রাজনীতিবিদরাও স্বীকার করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় চীনের সঙ্গে সংঘাতের পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন যে, ভারত চীন এবং পাকিস্তান (আজাদ কাশ্মীর ও উত্তরাঞ্চল) দখলকৃত ভূমি উদ্ধার করতে রক্তের শেষ বিন্দু বিসর্জন করবেন।

আন্তর্জাতিক আইনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমানে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারতের চীন সবচাইতে বড় দেশ হলেও চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। চীন দখলকৃত আকসাই চীন ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতের বর্তমানের অরুণাচল ও আসামের কিছু অঞ্চলকে ঐতিহাসিকভাবে তিব্বতের বহিরাংশ দাবি থেকে সরে আসেনি। ঐতিহাসিকভাবে অরুণাচল (এক সময়ের NEFA) ১৯১৪ সালের আগে চীনের অংশ ছিল এবং ওই সময়ে সিমলা চুক্তিতে চীনের অনুমোদন ছিল না- প্রায় সময়ে ভারতকে মনে করিয়ে দেয়। শুধু মনে করানোই নয়, চীন এই প্রদেশের নাম সিয়াং এবং একই সঙ্গে এ অঞ্চলের ৩০টি স্থানের নাম ঐতিহাসিক তিব্বত তথা চীনের নামে নাম পরিবর্তন করেছে। অপরদিকে ভারতের সেনাবাহিনীও চীনের বিপরীতে ওই অঞ্চলের নাম তাদের মতো করে পরিবর্তন করবে বলে জানিয়েছে।

চীন শুধু নাম পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওই অঞ্চল সফর নিয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে যে, ওই অঞ্চল চীনের অংশ। এর জবাবে ভারতের তরফ থেকে চীনকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ওই প্রদেশ এবং অঞ্চল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিপূর্বে ২০২৩ সালে ওই অঞ্চল থেকে চীনের চেংডুতে ‘বিশ্ব ইউনিভার্সিটি গেম’ ওয়াসু (Washu এক ধরনের চীনা মার্শাল আর্ট গেম) তে অংশগ্রহণকারী ৩ জন খেলোয়াড়কে আলাদা কাগজে ভিসা দেয়াতে ভারত প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর মাধ্যমে চীন ওই অঞ্চল যে বিবাদপূর্ণ তারই বার্তা দিতে চেয়েছিল।

১৯৬২ সালের যুদ্ধ থেকে ভারত যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তারই প্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলে অধিকতর সেনা ও সামরিক সরঞ্জামাদি মোতায়েন এবং চলাচলের ব্যবহার অনেক উন্নতি সাধন করেছে। একই সঙ্গে শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’-এর প্রতিষ্ঠা এবং সরবরাহ লাইনের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। তথাপি প্রশ্ন থাকে যে, ‘ডোকলাম’-এর পর থেকে এ অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং চীনের সরাসরি নজরদারির আওতায় রয়েছে। প্রয়োজন বিকল্প এবং নিরাপদ আপদকালীন সরবরাহ পথের। এ পথের খোঁজেই ভারতের ভূকৌশলবিদরা। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই ভারতীয় সেনার (অক্টোবর ২২, ১৯৬২) ৭ম ব্রিগেডকে নাস্তানাবুদ করে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জন ডালভীসহ যুদ্ধবন্দি করেছিল। (১) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-এর অবস্থান এবং পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণে সৈন্য পশ্চাদপদ হতে সরবরাহ পর্যন্ত দারুণ সংকটের মধ্যে পড়েছিল।
আমি আমার এ লেখায় সংক্ষেপে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দালাইলামা, তিব্বত এবং ভারত চীন (তিব্বত) সীমান্ত সংকট নিয়ে ইতিহাস তুলে ধরলাম এর কারণ এতদাঞ্চলের ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে। বর্তমানে বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান রুখতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং কোয়াড (QUAD)-এর উৎপত্তি এবং ভারতের বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে সহায়কও যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে একমাত্র ভারত যার শক্তি বলে ধারণা করা হয় ভারত মহাসাগরে চীন ঠেকাও শক্তির উৎস এবং একই সঙ্গে উত্তরে চীনের সঙ্গে ৩,৪৮৮ কি.মি. ভারতের সর্ববৃহৎ সীমান্ত। বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক চীনের সংজ্ঞায় সংবেদনশীল দুটি বিষয় এক. তাইওয়ান, দুই. তিব্বত।

১৯৭৫ সালে ভারত কর্তৃক সিকিম দখল ও অন্তর্ভুক্তির পরেও ভারত চীনের এক ধরনের অলিখিত  বোঝাপড়া ছিল যে তিব্বত এবং তিব্বতের দালাইলামার কথিত কর্তৃত্ব এবং দাবি নিয়ে ভারত বিষয়টি এক প্রকার মিটমাট করেছে। অন্তত ১৯৭৯ সালে ওই সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, (পরে প্রধানমন্ত্রী)-এর বেইজিং সফর শেষে তিব্বত বিষয়টি নিয়ে টানাপড়েন সমাপ্তির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দালাইলামা এবং তার কথিত প্রবাসে তিব্বত সরকারও বিষয়টি নিয়ে তেমন সোচ্চার ছিলেন না। ১৯৭১ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের মূল ছিল যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এক চীন নীতি যার অন্তর্গত তিব্বত ও তিব্বতের বহিরাংশ।
তবে অতীতে বিষয়টি যতটাই সুপ্ত থাকুক না কেন বিগত কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র তিব্বত বিষয়টি পুনরায় চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার প্রয়াশ নিয়েছে। যার কারণে চীন শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর প্রমাণ ২০২০-এর গালওয়ান উপত্যকায় দু’দেশের সীমিত সংঘাত। অপরদিকে তিব্বতকে ঘিরে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য জটিল ভূ-রাজনীতি এবং সংঘাতের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তার প্রমাণ গত ১৬ থেকে ২০শে জুন ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় দলের ৭ সদস্যের একটি দল, যার নেতৃত্ব ছিলেন রিপাবলিকান মাইকেল ম্যাককল এবং সঙ্গে প্রাক্তন হাউস স্পিকার ও ডেমোক্রেট ন্যানসি প্যালোসি ভারত ভ্রমণ করেন। প্রথমে দেখা করেন তিব্বতের নেতা দালাইলামা এবং তার কথিত সরকারের সদস্যদের সঙ্গে ধর্মশালায়। হাতে তুলে দেন জুন ১২, ২০২৪ এ পাসকৃত, ‘রিসল্‌ভ তিব্বত অ্যাক্ট- (Resolve Tibet Act) যুক্তরাষ্ট্রের উভয় সংসদ দ্বারা এই সদ্য অনুমোদিত আইনের মাধ্যমে চীনকে আহ্বান করা হয়েছে দালাইলামার সঙ্গে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন তথা সার্বভৌমত্ব নিয়ে পুনরায় আলোচনার দ্বার উন্মোচন করা এবং এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতের কথিত প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতা বজায় রাখবে।

দালাইলামার সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের তিব্বত বিষয়ের এই নতুন নীতির উপর বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই দল তৃতীয়বারের মতো শপথ নেয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে জুন ২০, ২০২৪ দেখা করেন এবং নতুন আইন সম্বন্ধে অবহিত করেন। পুনঃনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সাক্ষাৎকারের পরে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত দৃঢ় কৌশলগত বন্ধুত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রকার সহযোগিতা বজায় থাকবে। লক্ষণীয় যে, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রধান এবং আগামী ৫ বছর মেয়াদে থাকবেন। তার এই যাত্রার শুরুতেই চীনের সঙ্গে নতুন করে উত্তেজনার পথ উন্মুক্ত করেছেন পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত তিব্বত নীতির প্রেক্ষাপটে।

অপরদিকে বিগত বেশ কিছু বছর অরুণাচল সীমান্তে উভয় পক্ষ শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করছে। ধারণা করা হয় এই উত্তেজনা সীমান্ত সংঘাতে রূপ নিতে পারে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় শাসনকালে। ১৯৬২ সালে নেহেরুর তৃতীয় মেয়াদের মতো। তবে এবার ভারতের মতে, তারা চীনের সমকক্ষ জবাব দিতে প্রস্তুত। ভূকৌশলগত কারণেই ভারতের প্রয়োজন কথিত বিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোরের বিপরীতে আরও সুরক্ষিত বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি এবং সুরক্ষা করা। এ কারণেও বাংলাদেশের সহযোগিতায় সরবরাহ পথের নিশ্চয়তা প্রদান। এ ক্ষেত্রে পূর্ব সীমান্ত চীন-ভারত সম্ভাব্য সংঘাত হলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা শুধু ভূ-কৌশলগতই নয় ভূ-রাজনীতিবিদদের ভেবে দেখবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লেখক: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

manabzamin